লিটন-শাহরিয়ার দ্বন্দ্বে রাজশাহী উত্তপ্ত
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ প্রতিবেদক, রাজশাহী : আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের দ্ব›েদ্ব উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজশাহীর রাজনীতি। মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন এ দুই নেতা। ফের যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত থাকলেও বড় দুটি গ্রুপের প্রায়ই বাকযুদ্ধ হয়। দলীয় কর্মসূচিতেও বিভেদ দেখা গেছে। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল ও তার সমর্থকরা এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের অনুসারী। লিটন ও কামালের প্রধান প্রতিপক্ষ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার রয়েছেন লিটনের সমর্থনে। এ গ্রুপের প্রধান প্রতিপক্ষ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারা ও তার অনুসারীরা। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম রয়েছেন প্রতিমন্ত্রী দারার এ গ্রুপে।
জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় সংসদীয় আসন ৬টি। এর মধ্যে রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা এবং রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ রয়েছেন মেয়র লিটনের সমর্থনের। বাকি ৪ জন সংসদ সদস্য ও কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য লিটনের বিরুদ্ধে একাট্টা। বেশির ভাগ কর্মসূচিতেই এ দুই গ্রুপের প্রকাশ্য বিরোধ সামনে আসে।
সর্বশেষ জেলার বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল নিহতের ঘটনায় লিটন ও শাহরিয়ার দ্ব›দ্ব জটিল আকার ধারণ করে। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজশাহীর পরিস্থিতি। গত মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বাঘা মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বাবুলের জানাজার আগে বক্তব্যে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের সাংসদ শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বাবুলের অপরাধ ছিল তিনি শাহরিয়ারের সঙ্গে রাজনীতি করেন! খুনি আক্কাস ও মেরাজ বহিষ্কারের ঘোষণা দুই বছর আগে লিটনই দিয়েছেন। অথচ ঘোষণার সাত দিন পরই লিটনের গাড়িতে তাদের দেখেছি। হত্যাকাণ্ডে দুজন সশরীরে ছিলেন। কিন্তু মদত দিয়েছেন লিটন, আসাদ ও লাভলু। তাদের নামে মামলা করা হবে। তাদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব। আমাদেরও দায়িত্ব আছে।’
এ সময় শাহরিয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সংসদ-সদস্য আবদুল ওয়াদুদ দারা, রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিন এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার।
শাহরিয়ারের এমন বক্তব্যের পর ওইদিনই বিকালে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘আমার বয়স এখন ষাটের উপরে। আমার রাজনৈতিক জীবনে এ ধরনের ঘটনায় মদত দেয়ার ইতিহাস নেই। মনে হচ্ছে যেন লাশটি কারও দরকার ছিল। একজনের লাশ দরকার ছিল। যেটাকে পুঁজি করে রাজনীতি করা যায় এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়।’
এরপর দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করে যাচ্ছেন লিটন সমর্থিত নেতাকর্মীরা। বাবুলের জানাজায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকারকে লাঞ্ছিত করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। তারা নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে শাহরিয়ার আলমের কুশপুত্তলিকা দাহ করে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এছাড়া গতকাল সোমবার সকালে নগরীর কুমারপাড়ায় মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও শাহরিয়ার আলমের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়। এতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসলাম সরকার বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি রাজশাহী অঞ্চলের আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধ্বংস করতে একটি কুচক্রী মহল দীর্ঘদিন থেকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। বিষয়টি কেন্দ্রে জানানো হয়েছে। আমরা শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে আর কর্মসূচি দেব না। এ সময় রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামালসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
তবে প্রতিমন্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারা ও চার সংসদ সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার অনুসরারীরাও ছাড় দেবে না বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। সূত্রটির দাবি, এ গ্রুপের নেতাকর্মীরাও রাজপথের কর্মসূচিতে নামবেন। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে পারে। এরই মধ্যে জেলার বাগমারায় লিটনের পক্ষে কর্মসূচিতে নেমে সংঘর্ষ হয়েছে। গত শনিবার উপজেলার ভবানীগঞ্জ নিউ মার্কেটের প্রধান ফটকে নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ বের করেন। এ সময় রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের অনুসারীরা সমাবেশে বাধা দেন। উভয়পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি হয়। এতে কয়েকজন আহত হন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ও সৃষ্ট ঘটনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল আলম। তিনি বলেন, বাঘার ঘটনায় ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। তদন্ত শেষে দোষীদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে।