উদ্বিগ্ন লেবার পর্টির নেতা স্টারমার
অভিবাসীদের নিয়ে মন্তব্যে অসন্তোষ কমছে না বাংলাদেশি কমিউনিটিতে
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ ডেস্ক : ব্রিটেনের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার দেশটিতে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তার জেরে তোলপাড় চলছে দেশটির রাজনীতিতে। ব্রিটেনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবৈধ অভিবাসী থাকার পরও বাংলাদেশিদের উল্লেখ করে মন্তব্য করায় স্টারমার নিজ দল ও বাংলাদেশি কমিউনিটির তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। অসন্তোষ বাড়ছে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। এ নিয়ে লেবার পার্টি থেকে দেয়া ব্যাখ্যার পরও অসন্তোষ কমছে না। এদিকে এক সাক্ষাৎকারে স্টারমার বলেছেন, তার ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি উদ্বিগ্ন। এই ধরনের বক্তব্য দেয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না।
বিবিসির খবরে বলা হয়, আগামী ৪ জুলাই যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে গত সোমবার ডেইলি সান আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্টারমার ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে উদাহরণ টানতে গিয়ে বাংলাদেশিদের কথা উল্লেখ করেন। তার এ বক্তব্যে বিপাকে পড়েছেন লেবার পার্টির মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা। নির্বাচনের আগে ওই বক্তব্যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্যা টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসী নিয়ে স্টারমারের এই বক্তব্য তীব্র ক্ষোভ তৈরি করেছে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে। এমনকি অভিবাসী ইস্যুতে বক্তব্য দেয়ার পর নিজ দলের সদস্যদেরও তোপের মুখে পড়েছেন লেবার পার্টির এই নেতা। দলীয় নেতার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লেবার পার্টির টাওয়ার হ্যামলেটস-এর ডেপুটি লিডার ও কাউন্সিলর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাবিনা আখতার লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন।
নিজের এক্স একাউন্টে পদত্যাগের কথা জানিয়ে সাবিনা আক্তার বলেছেন, ‘দলের নেতা যখন আমার কমিউনিটিকে আলাদা করে এবং আমার বাংলাদেশি পরিচয়কে অপমান করে, তখন আমি আর দল নিয়ে গর্ব করতে পারি না।’
ব্রিটিশ গণমাধ্যম স্কাই নিউজের
খবরে বলা হয়, বাংলাদেশিদের নিয়ে এমন বক্তব্যে তোপের মুখে এর ব্যাখ্যা দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে স্টারমার। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি কাউকে আঘাত দিতে চাইনি। আপনারা যে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।’
বিতর্কের শুরু যেখান থেকে :
যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচনের আগে ডেইলি সানের ইলেকশন শো-ডাউন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। সেই সময় একজন অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে তার অবস্থান জানতে চান। জবাবের একপর্যায়ে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে স্টারমার বলেন, ‘যারা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এদেশে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। কয়েকটি দেশের মানুষের এখানে আসা বন্ধ করতে পারি আমরা।’ রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যানকে ‘ব্যয়বহুল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে দেশ থেকে তারা এসেছেন, সেখানেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। আমি নিশ্চিত করব সেটা।’
২০২২ সালের এপ্রিলে রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যান নামের একটি অভিবাসন নীতি প্রস্তাব করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে অবৈধ অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পুনর্বাসনের জন্য স্থানান্তর করা হবে।
বাংলাদেশি কমিউনিটি ও লেবার পার্টিতে প্রতিক্রিয়া :
লেবার নেতা স্যার কিয়ার স্টারমারের এই মন্তব্যে বাংলাদেশিদের উল্লেখ করায় ক্ষোভ বাড়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশি যে ৩৪ জন লড়ছেন তাদের মধ্যে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন আটজন। এর মধ্যে আছেন বর্তমানে এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আপসানা বেগম। ব্রিটেনের গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, স্টারমারের সা¤প্রতিক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ কেউ কেউ আবার নির্বাচনে কোনো দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেছে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশি অধ্যুষিত যেসব এলাকায় বর্তমানে লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রয়েছেন, সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কিয়ার স্টার্মারের এই বক্তব্য তুলে ধরে নিজেদের পক্ষে ভোটার টানার চেষ্টা করছেন। পদত্যাগ করা টাওয়ার হ্যামলেটের ডেপুটি লিডার সাবিনা আখতার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছি। আমি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলের প্রথম নারী স্পিকার এবং লেবার পার্টির একজন গর্বিত সদস্য ছিলাম। আমি সারাজীবন দলকে রক্ষা করেছি এবং এর জন্য খুব গর্বিত ছিলাম। কিন্তু এটা স্পষ্ট, আমার এবং আমার কমিউনিটির কাছে এ ধরনের মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।’ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লেবার পার্টির নির্বাচনী প্রার্থী আপসানা বেগমও। গত বুধবার এক ভিডিও বার্তায় আপসানা বেগম বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে বলছি, আমি যতদিন আছি, অভিবাসী স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধে দোষারোপ সহ্য করব না। আমাদের বাংলাদেশি স¤প্রদায় ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনে ইস্ট লন্ডনে ২৫ বছর বয়সি আলতাব আলী নিহত হন। তখন আমাদের সেøাগান ছিল- আমরা এখানে ছিলাম, আমরা এখানে থাকব।’
টানা চারবার নির্বাচিত এমপি রুশনারা আলী ‘কোনো দেশকে এভাবে এককভাবে বলা ঠিক নয়। এটা ভুল হয়েছে। আমি আমার নেতাদের জানিয়েছি, এভাবে এককভাবে বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।’
লেবার পার্টির বিবৃতি ও স্টারমারের দুঃখ প্রকাশ :
দ্য টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তীব্র অসন্তোষের মুখে এর ব্যাখ্যা দিয়েছে লেবার পার্টি। বাংলাদেশের সঙ্গে লেবার পার্টির সম্পর্ক তুলে ধরে দলটি জানায়, স্টারমার কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এমন মন্তব্য করেননি। লেবার পার্টির বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ কমিউনিটির সম্পর্ক অত্যন্ত ‘গভীর ও বন্ধুত্বপূর্ণ’। স্টারমার নিজেও কয়েকবার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন উল্লেখ করেছেন বলেও জানানো হয় এতে। এই বক্তব্যের পর বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার কাছে একটি সাক্ষাৎকার দেন স্টারমার। সেই সাক্ষাৎকারটি নিয়ে রিপোর্ট করেছে ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ। এটিএন বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্টারমার বলেন, এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। এই ধরনের বক্তব্য দেয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি কাউকে আঘাত করে বক্তব্য দিইনি। তিনি আরো বলেন, ‘লেবার পার্টি ও বাংলাদেশিদের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে অনেক সুদৃঢ়। এখানকার বাংলাদেশি স¤প্রদায়ের সঙ্গেও আমার সুসম্পর্ক রয়েছে।’ নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি এটিএন বাংলাকে বলেন, ‘আমি মনে করে আগামীতে লেবার পার্টি সরকার গঠন করলে বাংলাদেশ ও ব্রিটেন দুই দেশ একত্রে কাজ করতে পারব। এর ফলে দুই দেশই উপকৃত হবে।’
টেলিগ্রাফের ওই খবরে বলা হয়, নিজ দলের প্রতিনিধি ও নেতাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পরই ক্ষমা ও ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হন স্টারমার। যেখানে তিনি বৃটেনের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশি স¤প্রদায়ের অবদানের কথা স্বীকার করেন এবং এই অবদানের জন্য দেশটিতে থাকা বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি।
বাংলাদেশ-ব্রিটেন অভিবাসন চুক্তি :
যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে স¤প্রতি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। গত মাসে দেশ দুটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকেই এটি সই হয়। এর ফলে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হওয়া, অন্য দেশের অপরাধী এবং ভিসার মেয়াদ পার হয়ে যাওয়া অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সহজ হবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১১ হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছে।
গত এক দশকে ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়া এক লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছে। এই আবেদনকারীদের মধ্যে সবার উপরে রয়েছে পাকিস্তানি নাগরিকরা। প্রায় ১৭ হাজার ৪০০ পাকিস্তানি আশ্রয় প্রার্থনা করে আবেদন করে। তারপরই বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতীয় ৭ হাজার ৪০০ জন, নাইজেরীয় ৬ হাজার ৬০০ জন এবং আফগানিস্তান থেকে যাওয়া ৬ হাজার জন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছে। যুক্তরাজ্য গত বছর ২৬ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠায়, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৭৪ শতাংশ বেশি।