×

প্রথম পাতা

ভ্যাট আরোপে ভাড়া বাড়বে

ছন্দপতন হবে মেট্রোরেলের

Icon

দেব দুলাল মিত্র

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ছন্দপতন হবে মেট্রোরেলের

 বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির এই সময়ে মেট্রোরেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে সাধারণ যাত্রীদের জন্য চলাচল কষ্টদায়ক হবে। মেট্রোরেল যাত্রী হারাবে। এখনো উত্তরা বা মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসের ভাড়া কম থাকায় যাত্রীরা আবারো বাসমুখী হবে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষও বলছে ভ্যাট আরোপের কারণে ভাড়া বাড়লে এখনকার মেট্রোরেলের ছন্দপতন ঘটবে। খোদ সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও ভ্যাট আরোপের বিরোধিতা করে বলেছেন, এটি এনবিআরের ভুল সিদ্ধান্ত।

মেট্রোরেল থেকে বছরে ১০০ কোটি টাকা আদায় করতে চায় এনবিআর। এ কারণে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকেই মেট্রোরেলে ভ্যাট বসানোর চেষ্টা করে আসছে সংস্থাটি। গত বছরের বাজেটেও মেট্রোরেলে ভ্যাট বসাতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সচেতন দৃষ্টির কারণে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। আসন্ন বাজেটে মেট্রোরেলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর জন্য আবারো উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। ভ্যাট আরোপ করা হলে ১০০ টাকার বর্তমান ভাড়া ১১৫ টাকা হবে। এই টাকা মেট্রোরেলের যাত্রীদের পকেট থেকেই আদায় করা হবে। ইতোমধ্যেই বিষয়টি সব মহলে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ, যাত্রী স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও সাধারণ যাত্রীরা ভ্যাট আরোপের উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করেছেন। সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কর্তৃপক্ষ ভ্যাট আরোপের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

ওবায়দুল কাদের গতকাল রবিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন অর্জনে ঢাকা সিটি এখন বিশ্বের বিস্ময়। মেট্রোরেল আমাদের সম্পদ। ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের টার্গেট ৬টি এমআরটি লাইনের কাজ শেষ করা। ১ ও ৫ নম্বর লাইনের গ্রাউন্ড ম্যাপিং হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনায় মেট্রোরেল, এলিভ্যাটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এটা বাংলাদেশ নিয়ে তার বহুমুখী পরিকল্পনার অংশ। এই ঢাকা পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মেট্রোরেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ

করেছে। এটা হতে পারে না, ভুল সিদ্ধান্ত হবে। ভ্যাট বসলে মেট্রোরেলের সুনাম নষ্ট হবে। ভারতে মেট্রোরেলে কি ভ্যাট আছে? ভারতে ভ্যাট নেই। আমরা কেন ভ্যাট বসাবো। মেট্রোরেলের সুনাম নষ্ট করব? আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

এনবিআরের ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবনায় খোদ ডিএমটিসিএলও নাখোশ। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হলে ডিএমটিসিএলের ওপর চাপ বাড়বে। তখন এটা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এর আগে মেট্রোরেলে ভ্যাট বসানো হয়েছিলো। তখন আলোচনার মাধ্যমে জুন মাস পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়। এখন সেটা আবার ১ জুলাই থেকে কার্যকরের কথা বলা হচ্ছে। যদি ভ্যাট দিতে হয়, তাহলে তা যাত্রীকে দিতে হবে। ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব পুনর্বিচেনার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, এমআরটি-৬ লাইন চালু হওয়ায় ১২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অন্য ৫টি লাইন চালু হলে আরো হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর বিদ্যুতের দাম ২২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, তবে সরকারের উদারতায় এটা ভাড়ার সঙ্গে যোগ হয়নি। বিদ্যুতের দাম, ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ডিএমটিসিএলের কমিশন যোগ হলে ভাড়া অনেক বেড়ে যাবে। এই টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা কঠিন হবে। ভাড়া বাড়লে মেট্রোরেলের ছন্দপতন হবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক বলেন, এই মেট্রোরেল বানাতে গিয়ে সময় ও খরচ এমনিতেই বেশি হয়েছে। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শুরুতেই পাশের দেশগুলোর তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে তা সাধারণ যাত্রীদের পক্ষে বহন করা কষ্টদায়ক হবে। ভাড়া বাড়ানোর কারণে যাত্রী কমে গেলে এটা মোটেই জনবান্ধব গণপরিবহন হবে না। মেট্রোরেলকে সেবা খাত হিসাবে দেখতে হবে। এক সঙ্গে এত বেশি পরিমাণ ভ্যাট আরোপ না করে ধাপে ধাপে করা যায় কিনা সেটা সরকার ভেবে দেখতে পারে।

তিনি বলেন, যেসব যাত্রী উত্তরা বা মিরপুর থেকে ভালো বাস বা সিএনজিতে যাতায়াত করতেন; তারা এখন মেট্রোরেলে যাতায়াত করছেন। ভাড়া বাড়লেও তারা মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়ালে ভাড়া বাড়বে; তখন নিম্ম আয়ের মানুষের পক্ষে মেট্রোরেলে চলাচল করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান অবশ্য মনে করেন মেট্রোরেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে এর খুব একটা প্রভাব যাত্রীদের মধ্যে পড়বে না। তিনি বলেন, মেট্রোরেল থেকে যাত্রীরা এখন অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। যাতায়াতে তাদের সময় বেঁচে যাচ্ছে। তবে মুদ্রাস্ফীতির এই সময় ভাড়া বেড়ে গেলে অনেকের জন্যই তা কষ্টদায়ক হবে।

মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী মিরপুরের রুমানা বেগম। তিনি বলেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর উত্তরা ও মিরপুরবাসীর যাতায়াতে সময় কম লাগছে। সুবিধা থাকলেও ভাড়া যে একেবারে কম, তা নয়। শুরুতেই ভাড়া একটু বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রুটে বাসের ভাড়া এখনো কম। তারপরও সময় বাঁচানোর জন্য সব শ্রেণির মানুষ মেট্রোরেল ব্যবহার করে। এখন ভ্যাট বাড়ানো হলে ভাড়া বাড়বে। ভাড়া বাড়লে নি¤œ আয়ের মানুষ মেট্রোরেল ব্যবহার করতে পারবে না। তখন কম খরচ করে গন্তব্যে যাতায়াতের জন্য তাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। এতে মেট্রেরেলের যাত্রী কমে যাবে। নি¤œ আয়ের নাগরিকরা তাদের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এই মুহূর্তে মেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপ করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মেট্রোরেলে এই মুহূর্তে ভ্যাট আরোপের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, নিয়ম না মানার কারণে এখনো গণপরিবহন সেবা খাত হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি। মেট্রোরেল সরকারের একটি সেবা খাত হিসাবে গড়ে উঠেছে। এখানে এমনিতেই যাত্রীর ভাড়া বেশি ধরা হয়েছে। এখন আবার ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে ভাড়া বাড়বে এবং যাত্রীদের কাছ থেকেই এই টাকা আদায় করা হবে। অর্থনৈতিকভাবে এখন মানুষ খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় সেবা খাত মেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপ বা ভাড়া বাড়ানো কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। সব দেশের সরকার প্রয়োজনে তাদের সেবা খাতে ভর্তুকি দিয়ে পরিচালনা করে থাকে। প্রয়োজনে মেট্রোরেলেও সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App