×

প্রথম পাতা

ধান সংগ্রহের নীতিতেই গলদ

Icon

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধান সংগ্রহের নীতিতেই গলদ
সরকার যেদিন বোরো ধান ও চাল সংগ্রহের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাল- তার অন্তত সাত দিন আগেই দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা মিল মালিক ও ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। লটারিতে নাম উঠানোসহ নানা কানুনের কারণে কৃষকরা সরকারে কাছে ধান বেচতে খুব একটা আগ্রহী নন। 

এই সুযোগে স্থানীয় বাজারের মৌসুমি ব্যবসায়ী, মিল মালিক ও ফড়িযারা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে নেন। এরপর সরকার যখন কিনতে যায়; তখন আর কৃষকদের কাছে ধান থাকে না। ধান চলে যায় মহাজনের গোলায়। এই মহাজনরা বছরজুড়ে ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত সরকারের ঠিকঠাক নীতির অভাবে যেমন কৃষকরা ধান-চালের দাম পান না; তেমনি ফুলে ফেঁপে ওঠে মহাজনের ভাড়ার। 

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে জানান, সরকার চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান, চাল, গম সংগ্রহ শুরু করছে। এবার প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা, আতপ চাল ৪৪ টাকা এবং গম ৩৪ টাকা। তিনি আরো বলেন, যেসব কৃষক অ্যাপসের মাধ্যমে আবেদন করেছেন তাদের বাড়িতে কৃষক প্রতিনিধি যাচ্ছেন। কৃষি কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি মেশিন নিয়ে গিয়ে ধানের আর্দ্রতা মেপে দেখছেন। যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ করা যাবে বলে আশা করছি। 

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গেল কয়েকবারের মতো এবারো সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল কিনতে পারবে না। কারণ গুদামে ধান দিতে গিয়ে হয়রানি, ধানের আর্দ্রতা না হওয়া এবং লটারির নামে প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বসহ নানা কারণে গুদামে ধান দিতে আগ্রহী নন কৃষকরা। এছাড়াও একদল মধ্যস্বত্বভোগী কৃষকদের কার্ড নিয়ে মাঝখান থেকে লাভবান হয়ে যাচ্ছেন। তাদের মতে, ধান কিনতে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতার শর্ত তুলে দিলেই সরকার কৃষকদের কাছ থেকে দেদারছে ধান কিনতে পারবে। কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে সরকারই চাতালে শুকিয়ে ধানে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা রাখতে পারে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবে। 

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন খাদ্য নিয়ন্ত্রক ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার এবার প্রতি কেজি ধানে ২ টাকা এবং চালে ১ টাকা দাম বাড়িয়েছে। ধান-চালে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা হয়নি। এর ফলে সরকার যেমন কৃষকদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান কিনতে পারবে না; তেমনি মিলাররা সিন্ডিকেট করে সময়ে সময়ে চালের দাম বাড়িয়ে দেবে। এতে বছরজুড়ে ভোক্তাদের কষ্ট বাড়বে। তার মতে, সরকার যদি ধান ও চালে সমানভাবে দাম বাড়িয়ে দিত তাহলে মিলাররা সিন্ডিকেট করতে পারত না। 

নাম প্রকাশে আরেকজন খাদ্য নিয়ন্ত্রক ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের কাছে ধান বেচতে হলে ধানে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা থাকতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ কৃষকই তার ধানে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা রাখতে পারেন না। কেন পারেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাটিতে ধান শুকালে কখনোই ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা হবে না। চাতালে ধান শুকালে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা হয়। এ কারণে মিলাররা ধান কিনে চাতালে ধান শুকিয়ে আর্দ্রতা নিশ্চিত করতে পারেন। আর এখানে মিলাররা সরকারি দামের চেয়ে মণপ্রতি এক দেড়শ টাকা কম দিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে নেন। সেই ধান দাম বাড়িয়ে পরে তারা বিক্রি করেন। 

আরেকজন খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলেন, একজন কৃষক যখন গুদামে ধান নিয়ে যান বেচার জন্য, তখন এই ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা না থাকলে সরকারের কাছে তারা ধান বেচতে পারেন না। কিন্তু গুদামে কর্মরত লোকজনকে হাজার-পাঁচশ টাকা ঘুষ দিলে আর্দ্রতা পূরণ না হলেও ধান বেচতে পারেন। যারা ঘুষ দেন না তারা সেই ধান ফেরত নিয়ে আসেন। সব মিলিয়ে সরকারের কাছে ধান বেচতে গিয়ে একধরণের ‘লোকসান’ হয় কৃষকদের। এর ফলে ফড়িয়া কিংবা মিলারদের কাছে অনেকটা কমদামে ধান বেচে দেন তারা। মিলাররা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার পর সরকার কেনার ঘোষণা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে কৃষকদের গোলা শূন্য হয়ে পড়ে। ভরে যায় মহাজনের গোলা। 

তার মতে, ধান-চাল কেনার নীতি যদি পরিবর্তন হয় এবং সময়মতো সরকার কেনার ঘোষণা দেয়- তাহলে হয়তো কৃষকরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারবেন। তবে সরকারি গুদামে ধান দিতে এসে কোনো কৃষক যাতে ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষায় বা অন্য কোনো কারণে হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, কৃষক যাতে হয়রানি না হয়, সেজন্য প্রতি ইউনিয়নে তিনজন কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তার কাছে একটি করে ময়েশ্চার মিটার (ধানের আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র) দেয়া হয়েছে। 

যে কৃষকরা ধান দেবেন বলে আবেদন করেছেন, তালিকা পাঠিয়েছেন, তাদের বাড়ি গিয়ে মিটার দিয়ে ধানটা পরীক্ষা করে আসবেন। আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি থাকলে- তাদের বলবেন আরো শুকিয়ে ১৪ শতাংশে নিয়ে আসেন। যাতে কৃষক হয়রানি না হয় সেজন্য এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছি এডিবি ফান্ডের কৃষির অংশ থেকে আরো ময়েশ্চার মিটার কিনে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দেয়ার জন্য। 

এবার কৃষকের আগ্রহের ভিত্তিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে জানিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, গোডাউনে ধান দিতে এসে কোনো কৃষক যেন হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য ডিসি ও কর্মকর্তাদের নজর রাখতে বলেছি। যদি সেটা (কৃষককে হয়রানি) করে, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। অভিযোগ জানাতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দুটি নম্বর দিয়ে দেয়া হবে। ওই নম্বরে কৃষক বা কোনো ব্যক্তি ফোন করে হয়রানির কথা জানাতে পারবেন। 

খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন জানান, এবার বোরো মওসুমে ১৭ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে সরকার। সংগ্রহ কার্যক্রম ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চললেও জুনের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ অর্জনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কৃষকদের হয়রানি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সব মিলিয়ে বোরো সংগ্রহ মওসুমে কেনাকাটা বাবদ সাড়ে ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। 

সরজমিন দেখা গেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বোরো ধান আবাদ হয় সুনামগঞ্জ জেলায়। সেখানে এবার দুই লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। রোপণ করা ধানের প্রায় ৯৪ শতাংশ কাটা শেষ হয়ে গেছে। রোদের কারণে সহজেই কাটা ধান শুকিয়ে গোলাজাতও করেছেন কৃষক। অনুকূল আবহাওয়ায় সঠিক তাপমাত্রায় ধান শুকিয়ে গোলাজাত করায় গুণাগুণও সুরক্ষিত হয়েছে। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা অনেকটা কম দামেই ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। 

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষ্মণশ্রী গ্রামের কৃষক সাদির মিয়া বলেন, আমি এ বছর প্রায় ৭০ কেয়ার (প্রতি কেয়ার ৩০ শতাংশ) জমিতে ধান করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। বিভিন্ন কারণে কৃষকরা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। দেখার হাওরের ইসলামপুর গ্রামের কিষানি আলমচান বিবি বলেন, আমি ৯ কেয়ার জমিতে ধান লাগিয়ে ছিলাম। সব ধান কাটা শেষ। আমার মতো অন্য কৃষকরাও কম দামে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে হাসি ফুটেছে এ অঞ্চলের কৃষকদের মুখে। এ বছর জেলায় ধানের উৎপাদন বাড়লেও সরকার নামমাত্র লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ ধান কিনছে। জাওয়ার হাওরের কৃষক আমির হোসেন। অনেক পরিশ্রম করে তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রায় ৭০ মণ ধান উৎপাদন করেছেন। তবে সেই ধানগুলো তিনি বিভিন্ন ফরিয়া ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। শুধু আমির হোসেন নয়; একই অবস্থা সুনামগঞ্জের অন্য কৃষকদেরও। এ জেলার সদর, শান্তিগঞ্জ দোয়ারাবাজারসহ সাত উপজেলা থেকে ৬ লাখ কৃষক ৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করেছেন। কিন্ত সেই ধান সরকারের গুদামে বিক্রি করার জন্য কৃষক অ্যাপস দিয়ে অনলাইনে আবেদন করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার ৩৩১ জন ধান বিক্রি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। 

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলা থেকে সরকার ২৯ হাজার ৮১১ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে মিলারদের কাছ থেকে ৯ হাজার ৬৮৪ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ও ৯ হাজার ৯৫৪ মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহ করার কথা রয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালে এ জেলার কৃষকদের কাছ থেকে ১৭ হাজার ৪৮৩ মেট্রিক টন ধান কেনার কথা থাকলেও সরকার মাত্র ১৫ হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন ধান কিনতে সক্ষম হন। তবে সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম ভূঞা বলেন, চলতি মৌসুমে ধানের দাম বাড়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App