গডফাদার বদি কারাগারে
বীরদর্পে ঘুরছে তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিরা
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সৈয়দুল কাদের, কক্সবাজার থেকে : কক্সবাজার-৪ আসন (উখিয়া-টেকনাফ) থেকে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুর রহমান বদি। ২০১৪ সালেও একই দল থেকে সংসদ সদস্য হন তিনি। দুবার সংসদ সদস্য হওয়ার পর নানা বিতর্ক ও দুর্নীতির মামলার কারণে নিজে না পেলেও স্ত্রী শাহিন আকতারের নামে মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। শেষ দুবার ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে তার স্ত্রীই এ আসনের সংসদ সদস্য হন। সেই সুবাদে টানা ১৫ বছরের আধিপত্যে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের ডন হয়ে উঠেন বদি। তিনি নিজে সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের করা প্রথম ইয়াবা কারবারিদের একটি তালিকা প্রকাশ হয়। ওই তালিকায় সীমান্তে ইয়াবা-সংশ্লিষ্ট ৭৬৪ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। ২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এর পেছনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উল্লেখ ছিল ওই সময়ের আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম। প্রতিবেদনটির প্রথম পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা ৬-এর ৩০ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে প্রেরিত পত্রে এই তালিকাটি তৈরি করা হয়। ওই প্রথম তালিকাটি প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় পৃথকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত অন্তত ৫টি তালিকায় ঘুরে-ফিরে ইয়াবার প্রধান ডন হিসেবে আবদুর রহমান বদির নাম উল্লেখ ছিল। যদিও সর্বশেষ গত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইয়াবা কারবারির সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১ হাজার ২৭৫ জনকে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবদুর রহমান বদিই সীমান্তের ইয়াবা নিয়ন্ত্রক এবং সব কারবারি তার নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হয়। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে রয়েছেন বহুল আলোচিত এই সাবেক সংসদ সদস্য। এরপর থেকে আলোচনায় আসছে সীমান্তের অন্য ইয়াবা কারবারিরা কে, কোথায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ভাটাসহ নানা কারণে বহুল আলোচিত ইয়াবা ডন বদি কারাগারে থাকলেও থেমে নেই ইয়াবা পাচার। চিহ্নিত শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা পুরোদমে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে দুই লক্ষাধিক ইয়াবা, ৩ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস, বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করে বিজিবি। পৃথক অভিযানে র্যাব উদ্ধার করে আরো অন্তত দেড় লাখ ইয়াবা। টেকনাফ সীমান্তের একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পটপরিবর্তনের প্রভাব পড়েনি সীমান্তে। বীরদর্পে ইয়াবা কারবার অব্যাহত রেখেছে চিহ্নিত চক্র। এর মধ্যে নিজেকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে স্বীকার করে আত্মসমর্পণকারীরাও পুরোদমে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রেখেছেন। আবার এদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সুবিধা আদায়ের জন্য বিএনপিতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। টেকনাফে একাধিক ব্যক্তির দেয়া তথ্য বলছে, সরকারের একটির পর একটি তালিকা প্রণয়ন, টেকনাফ থানায় ওসি হিসেবে প্রদীপ কুমার দাশের যোগদানের পর একের পর এক ক্রসফায়ারের নামে নিহত হওয়ার ঘটনায় টেকনাফ আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন এবং ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন নিজেকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে স্বীকার করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের উপস্থিতিতে ১০২ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি ও গডফাদার সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা, ৩০টি দেশীয় তৈরি বন্দুক ও ৭০ রাউন্ড গুলিসহ আত্মসমর্পণ করেন। ওইদিনই আত্মসমর্পণকারী ১০২ জনকে আসামি করে টেকনাফ মডেল থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা করেন টেকনাফ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) শরীফ ইবনে আলম। তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হয় পরিদর্শক এবিএমএস দোহাকে। মামলা দায়েরের দিনই আদালতের মাধ্যমে সব আসামিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। ১০২ জন আসামির মধ্যে মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট মোহাম্মদ রাসেল নামে এক আসামি অসুস্থ হয়ে মারা যান। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্ন ফারাহর আদালতে ১০১ আসামির বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল চার্জ গঠন করেন। বিচার শেষে ২৩ নভেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ওই রায়ে মাদক মামলায় প্রত্যেককে ১ বছর ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে অস্ত্র মামলায় সবাইকে খালাস দেন আদালত। ঘোষিত রায়ে ১০১ আসামির হাজতবাস সাজার অধীনে হওয়ায় নতুন করে সাজা ভোগ করতে হয়নি। ফলে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে করা ২০ হাজার টাকা জরিমানা পরিশোধ করেই খালাস পেয়ে যান তারা।