পাটের ফলন ও দাম কম
লোকসানে মেহেরপুরের চাষিরা
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মর্তুজা ফারুক রুপক, মেহেরপুর থেকে : বিগত কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনতে হচ্ছে মেহেরপুরের পাটচাষিদের। বৈরী আবহাওয়া, জাগ দেয়ার জায়গার অভাব ও শ্রমিক খরচ বৃদ্ধির ফলে আবাদ খরচ বেড়েছে অনেক। খরচ বাড়লেও কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় বিঘাপ্রতি লোকসান ৫-৭ হাজার টাকা। চাষিরা বলছেন, এ বছর পাটের অঁাঁশ কম এবং দামও কম। খরচের টাকা উঠছে না। পাটের মূল্য না বাড়লে আগামীতে পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন বলে জানিয়েছেন তারা। এমনিতেই বিগত কয়েক বছরের তুলনায় পাটের আবাদ কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। চলতি মৌসুমে যে পরিমান পাট চাষ হয়েছে তা বেশির ভাগই পাটখড়ির জন্য। পাটের লোকসান পাটখড়িতে কিছুটা পূরণ হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে মেহেরপুরের গাংনী, মুজিবনগর, সদরসহ তিনটি উপজেলায় মোট ১৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে, যা বিগত দুই বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কম। জেলায় এ বছর ২ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৬ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না বলে জানায় কৃষি বিভাগ। জমি থেকে পাট কেটে পুকুর ডোবা কিংবা জমিতেই স্যালো মেশিন দিয়ে পানির ব্যবস্থা করে পাট পচানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় পাটের রং হচ্ছে কালো। এতে দাম কম পাচ্ছেন চাষিরা। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের পাটের অঁাঁশ তুলনামূলক কম ও রঙের পার্থক্য থাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাট ব্যবসায়ীরা জানান, এই বছর শুকনা পাট বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা। ভেজা পাট বিক্রি হচ্ছে প্রতি বেল (গাইট) ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
পাটচাষিরা বলছেন, পাটের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেক চাষি পাটের আবাদ ছেড়ে দিয়েছেন। পাট উৎপাদনে যে টাকা খরচ হয়েছে তা উঠছে না। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে পাট চাষে ভাটা পড়বে মেহেরপুরে।
সদর উপজেলার শোলমারী গ্রামের পাটচাষি রিপন আলী বলেন, তিন বছর ধরে পাটে লোকসান গুনতে হয়েছে। আগামীতে আর পাটের আবাদ করব না। অন্য আবাদে ফিরে যাব।
গাংনী উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের পাটচাষি ইদ্রিস আলী মাস্টার জানান, তিনি চৈত্র মাসের শেষের দিকে দুই বিঘা জমিতে পাট বীজ রোপণ করেছিলেন। অতি খরার কারণে দুই দিন পরপর সেচ দিতে হতো। নিড়ানি, সার, বিষসহ প্রতি বেলে খরচ হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকা। বিক্রি করেছেন ৯০০ টাকা করে।
মাইলমারি গ্রামের পাটচাষি হবিবুর রহমান বলেন, এক বিঘা জমির পাট কাটতে এবং বহন করে পুকুরে পচানো পর্যন্ত খরচ হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। সেই পাটের আঁশ ছাড়াতে শ্রমিক খরচ হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে পাট হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ বেল। এতে খরচের টাকা উঠছে না। পাটকাঠি বিক্রি করে খরচের টাকা তুলতে হচ্ছে।
ভাটপাড়া গ্রামের পাটচাষি আব্দুল আলিম বলেন, ভারতের মহারাষ্ট্র জাতের পাট লম্বা হয় সাত থেকে আট ফুট। কিন্তু এই বছর অনাবৃষ্টির কারণে পাট বাড়তে পারেনি। চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হয়েই জমিতে শুকিয়ে গেছে। ফলে পাটে ফলন কম এবং আঁশ হয়েছে পাতলা।
পাটের আঁশ ছাড়ানো শ্রমিক লোকমান হোসেন জানান, সকাল ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পাটের অঁাঁশ ছাড়ানোর মজুরি ৬০০ টাকা। প্রায় একমাস ধরে পাট সংগ্রহের ভরা মৌসুম। পাট মোটা না হওয়ায় আঁশ ছাড়ানোর শ্রমিক ও সময় লাগছে বেশি।
মেহেরপুরের বেশ কিছু পাট ব্যবসায়ী বলেন, শুকনা পাটের বর্তমান বাজারমূল্য ১ হাজার ৯৫০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা। কঁাঁচা পাট বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা বেল। মেহেরপুরের পাট বড় না হওয়ায় ও রঙ ভালো না হওয়ায় পাটের চাহিদা কম। পাট শুকিয়ে গোডাউনে রেখে দিচ্ছি। আগামীতে দাম পেলে বিক্রি করব। আর যদি দাম আরো কমে যায়, তবে লোকসান হবে।
পাট ব্যবসায়ী ইমাদুল হক বলেন, মেহেরপুর জেলায় খাল-বিল বা পুকুরে পানি না থাকায় পাটের রং সোনালি হওয়ার পরিবর্তে কাদাযুক্ত কালো হচ্ছে। ফলে এখানকার পাটের চাহিদা একেবারেই কম। প্রক্রিয়াজাতকরণ কোনো কোম্পানি পাট কিনতে চাচ্ছে না। এছাড়া গত বছরের বিক্রীত পাটের দাম এখনো কিছু কোম্পানির কাছে পাওনা আছে। যার কারণে এ বছর পাট কিনতেও ভয় লাগছে।
মেহেরপুর কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, জেলায় অনাবৃষ্টির কারণে পাট বাড়তে পারেনি। আঁশ হয়েছে পাতলা। ওজনও কম হচ্ছে। খালবিলে পাট পচানোর জন্য পানি না পেয়ে কৃষকরা গর্ত করে সেচ দিয়ে পাট পচানোর ব্যবস্থা করছেন। এতে পাটের প্রকৃত রঙ হচ্ছে না। ফলে নদী এলাকার পাটের তুলনায় দাম কম পাচ্ছেন। তারপরেও সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাট পচানো এবং আঁশ সংগ্রহে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।