×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

লোকজ্ঞানে আস্থা চাই

Icon

ফরিদ আহমদ দুলাল

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লোকজ্ঞানে আস্থা চাই

আধুনিকতা এবং প্রাগ্রসরতার মধ্যে যদি যথাযথ সমন্বয় না থাকে, তাহলে দুই-ই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বিষয়টি কিছুটা সূ² বটে, কিন্তু অকার্যকর নয়। যখন আপনাকে আমি আধুনিক এবং প্রাগ্রসর ভাবছি, তখন ধরেই নিতে হবে চিন্তা-চেতনায় আপনি উৎকর্ষ অর্জনের পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সৃজনানন্দের পরম্পরাকে বুকে ধারণ করেন; আবার কথাটিকে যদি উল্টো করে বলি, তাহলে বলতে পারি, আধুনিক ও প্রাগ্রসর ভাবছি বলেই তো আপনাকে নিয়ে আলোচনা! অন্ধ-কূপমণ্ডূকের সঙ্গে তো আলোচনায় আসার সুযোগ নেই; এ কথার সূত্র ধরেই প্রশ্ন আসে ধর্মাচার-লোকাচার-কুসংস্কার বিষয়ে আপনার ভাবনাটা কী? সেদিন দেখলাম, বন্যার্তদের সাহায্য করতে গিয়ে কতিপয় ব্যক্তি, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবার কোমর-গলা এবং বাজু থেকে তাবিজ-কবজ যা-ই আছে কাঁচি দিয়ে সুতা কেটে পানিতে ফেলে দিচ্ছে; পাশে তাদেরই একজন মাইকে উচ্চস্বরে ঘোষণা করছেন, তাবিজ পরা শিরক, আর যারা তাবিজ দেন তারা বেদাত করছেন; বলছেন বিজ্ঞানও তাবিজের ব্যবহার অনুমোদন করে না; বলছেন তাবিজ না-কি কুফরি! ইত্যাদি। বিষয়টি আমার মনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিল-

ক. বাংলাদেশের মানুষের কতজনের গায়ে তাবিজ আছে?

খ. এসব তাবিজের রকমফের কত প্রকার?

গ. তাবিজ পরে মানুষ কি কোনো উপকার পায়? যদি পায়, তার সংখ্যা কত? আর যদি না পায়, তারপরও বংশপরম্পরায় কেন মানুষ যুগ যুগ ধরে তাবিজ ব্যবহার করে আসছে?

আমরা যে জেনে আসছি, পবিত্র কুরআনের ‘অমুক’ সুরা পড়ে ফুঁ দিলে বালা মুসিবত কেটে যায়; অমুক দোয়া বলে খেতে হবে, অমুক দোয়া বলে যাত্রা শুরু করতে হবে; অমুক দোয়া বলে সিঁড়িতে উঠতে হবে; অমুক দোয়া বলে নামতে হবে; সবই কি ‘ভুয়া’? আমরা আমাদের শৈশব-কৈশোরে যাদের কাছে কায়দা-সিপারা পড়েছি, পবিত্র কুরআন পড়তে শিখেছি, তারা কি তবে আমাদের ভুল শিক্ষা দিয়েছেন? ধরে নিলাম আমাদের শৈশব-কৈশোরে বাংলায় কুরআন হাদিস পড়ার সুযোগ বেশি ছিল না; কিন্তু যখন বড় হলাম, তখন তো আমাদের সামনে জানার অনেক দুয়ার খুলে গেছে, আমরা তো এখন চাইলেই অনেক তথ্য-উপাত্ত জেনে নিতে পারি; আমরা তো জানি মানুষের বিশ্বাস ভাঙা পাপ; যদি আমরা শত শত বছর ধরে ভুল জেনে থাকি, তাহলে তা সংশোধন করার পদ্ধতি এমনটি হওয়া কিছুতেই উচিত নয়। যদি কেউ বলেন, বিপ্লব করতে চাইলে প্রচলিত বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের সৌধকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েই তা করতে হবে। এ চিন্তার সঙ্গে আমি কিছুতেই একমত হতে পারছি না। সব লোকাচারকেই অমূলক-অপ্রয়োজনীয়-অর্থহীন ভাববার কারণ নেই, যুক্তিও নেই। লোকাচারেও কল্যাণ লুকিয়ে থাকতে পারে; ভালো করে না জেনে, না বুঝে লোকাচারকে খারিজ করে দেয়া কিছুতেই। ভালো করে জেনে বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এ ফাঁকে একটি প্রাসঙ্গিক কবিতা পড়া যাক-

হাতের আঙুল তোমাকে কি দেখাবো আয়নায়

বোঝোনি কি কোন বিপর্যয় হবে পরিপার্শ্বের বাস্তবতায়

ভেঙে যাচ্ছে সৌধ বহু যুগের বিশ্বাস

নিরাপত্তার আড়ালে মোছে রামায়ণ কীর্তিবাস

মন্দিরে বিগ্রহ ভাঙে দরগাতে ভাঙে অলির কবর

বিশ্বাসীর দিল-ক্বাবা ভাঙে হয় ভাইরাল খবর!

শিক্ষক-সংস্কৃতিকর্মী-মুক্তিযোদ্ধা কে কার টার্গেট

সংখ্যালঘু-খেলোয়াড়-সাংবাদিক বিদ্ধ করে মেধাবি পাপেট

পাপেটেরা অদৃশ্য সুতোর টানে এক গান গায়

বিমুগ্ধ দর্শক অপলক অপেক্ষায় অসহায়।

জীবনে স্বস্তির প্রয়োজনে অন্ধকার গ্রন্থি খুলে নিতে হয়

দলবদ্ধ অন্ধেরা যখন সর্বত্র ছড়াচ্ছে ভয়;

প্রতিটি শোভন স্বপ্ন ভেঙে চোখে চোখে সেঁটে

দিতে চায় মোহ

বোধিবৃক্ষের সমস্ত ডাল ছেঁটে দেয় যেখানে ফুটেছে দ্রোহ

একপেশে স্বৈরশাসন যেমন সর্বত্র বিকার গড়ে

দরিদ্রের রক্ত শুষে ওরা অট্টালিকা গড়ে ঘরে ঘরে

ঘোলাজলে শিকারের যাবতীয় কলা ক্রিয়াশীল

যতেœ দৃষ্টি মেলে দেখো দৃশ্যমান হবে গোঁজামিল

উত্তরাধুনিক একবিংশের বিমূর্ত পৃথিবীতে ইঙ্গিতের দোলাচাল

পরাজিত হতে হতে সত্য খুঁজে নেবে প্রাগ্রসর মহাকাল।

(প্রাগ্রসর মহাকাল \ ফরিদ আহমদ দুলাল)

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তাবিজ-কবজ, ঝাড়-ফুঁকের প্রচলন হতে পারে অনেক দেশের তুলনায় বেশি; তার পেছনে নিশ্চয়ই নানান কারণ আছে; সেসব কারণ খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠী মানুষ হিসেবে যেসব অধিকার পাওয়ার অধিকারী, তার ক’টি তারা পাচ্ছে? বাংলার মানুষ কি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা- এসব কি পাচ্ছে? অসংকোচে আমরা বলতে পারি, এখানে বৈষম্যময় সমাজে, যেখানে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে লুটেরা শ্রেণি, যেখানে যুগ যুগ ধরে মানুষ দেখছে, স্বল্পসংখ্যক মানুষ সংখ্যাগুরু মানুষকে বঞ্চনা দিয়ে গড়ে নিচ্ছে সম্পদের পাহাড়, লাখ লাখ কোটি টাকা তারা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। যেখানে ডাক্তাররা রোগীদের সাহস না দিয়ে বলেন, ‘আমার কিছু করার নেই! আমি তো নিমিত্তমাত্র, যা করার আল্লাহই তা করবেন। আল্লাহর কাছে ফানাহ চান! দোয়া করুন, আল্লাহ চাইলে ভালো হতেই পারেন।’ সেখানে তাবিজ-কবজ ব্যাপারীরা শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে আপনাকে গলায়-কোমরে বা ডান হাতের কব্জিতে কিংবা বাজুতে বেঁধে দিচ্ছে ধন্বন্তরী তাবিজ; শিশু জন্মাবার পর দিন থেকেই তার কোমরে-গলায় বেঁধে দেয়া হচ্ছে কালো সুতোর তাগা, যে কোনো অশুভ দৃষ্টি থেকে নিরাপদ থাকছে নবজাতক। কী করবে অসহায় শিশুর হতদরিদ্র বাবা-মা? বাধ্য হয়েই শরণাপন্ন হচ্ছে তান্ত্রিক সাধুর।

তাছাড়া মানুষের অসুখ-বিসুখ অনেক সময় মানসিক দুর্বলতা থেকেও হয়; সে ক্ষেত্রে যদি তাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তোলা যায়, তাহলে সে ওষুধ ছাড়া ভালো হয়ে যেতেই পারে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, আমাদের দেশে সর্প দংশনে যত মানুষ মারা যায়, তার সামান্যই বিষক্রিয়ায় মরে, অধিকাংশই মরে ভয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। বিশ্বাসে-আদরে-যতœ-ভালোবাসায় নিরন্ন-দরিদ্র মানুষের সন্তান যদি মুক্তি পায়, ক্ষতি কী? লক্ষ করা যায় কিছুসংখ্যক কট্টরপন্থি মাওলানা, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে এতটাই বাড়াবাড়ি করেন, যাতে স্বল্পশিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ বিপাকে পড়ে যায়। বাংলার বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ব্যঙ্গ-রস রচয়িতা আবুল মনসুর আহমদের সুন্নত নিয়ে বাড়াবাড়ির গল্পটি মনে পড়ে গেল, যেখানে টুপি পরতে হবে না-কি পাগড়ি পরতে হবে তাই নিয়ে দ্ব›েদ্ব পড়ে যায় একজন তালবে এলেম। একটা হাদিসের কথা মনে পড়ে গেল, যেখানে ইসলামের নবী বলছেন, পৃথিবীর যেখানেই ইসলামের আলো পৌঁছাবে সেখানে সেই দেশের লোকাচার ও সংস্কৃতির কথা বিবেচনায় রেখে মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে। মহানবীর এই দূরদর্শিতার জন্যই তিনি বিশ্বনবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লোকাচার নিয়ে আরো কিছু বলার আছে, আশা করি আগামীতে লোকাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা নিশ্চয়ই বলব। আজ লোকাচারের গুরুত্ব ও ইসলামের নবী মুহম্মদ (সা.) বিষয়ে অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করে, লোকাচারের বিরুদ্ধাচরণ না করতে সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানাব। আমরা জানি নবুয়ত লাভের পর মক্কার মানুষ, বিশেষত নবীর বংশের লোকজনের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে আল্লাহপাকের নির্দেশে মুহম্মদ (সা.), আবুবকরকে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিযরত করেন; মদিনায় পৌঁছার পর, তার জাদুস্পর্শে তিনি মদিনাবাসীকে আপন করে নেন; প্রতিদিন মানুষ তার কথা শোনার জন্য ভিড় করতে থাকে এবং দ্রুত তার ভক্ত-অনুরাগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মানুষ তার কথা শোনে এবং তাকে মান্যতা দেয়। মদিনায় যাওয়ার পর মুহম্মদ (সা.) লক্ষ করলেন, যখন খেজুরের ফুল ফোটার মৌসুম আসে; খেজুরের ফুল তার বাতাবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মুহম্মদ (সা.) খেয়াল করলেন, ফুলগুলো ছড়িয়ে পড়ার পর খেজুর চাষি ফুলগুলোকে কোমল হাতে চিকন দড়ি দিয়ে বেঁধে দেন; মুহম্মদ (সা.) ভাবলেন, মানুষ কেন এমনটি করে? উত্তর খুঁজে পেলেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল নিবৃত্তি করতে বেশ ক’জনকে প্রশ্ন করে জানতে চান, কেন ফুলগুলোকে বেঁধে দেয়া হচ্ছে? সবার কাছেই একই উত্তর পেলেন, ‘জানি না কেন! পূর্বপুরুষরা এমনটি করেছেন, আমরাও করছি।’ মুহম্মদ (সা.) ভাবলেন- নিছকই এটা কুসংস্কার! সবাইকে ডেকে তিনি পরামর্শ দিলেন, ‘এমনটি আর করো না, প্রকৃতিকে তার নিয়মে চলতে দাও।’ সবাই মানল তার কথা; ফলন শেষে সবার সঙ্গে নবীও অবাক হয়ে দেখলেন, অন্যবারের তুলনায় ফলন অর্ধেকে নেমে এসেছে। কেন এমনটি হলো তার কারণ নবী বুঝতে পারলেন না; তারপর নবী সবাইকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা ফুলগুলোকে আগের মতোই বেঁধে দাও, দেখো আগামী বছর কী ফল আসে।’ আবার সবাই তার কথা শুনলেন, পরের বছর আবার যথারীতি ফলন বেড়ে গেল।

এ ঘটনার নেপথ্য কারণ, সে সময় ফুলে-ফুলে পরাগায়নের বিষয়টি হয়তো তিনি তখন জানতেন না; অথবা কিছু সময়ের জন্য বিস্মৃত হয়েছিলেন; ঘটনা যাই হোক পূর্বপুরুষের লোকজ্ঞান এবং লোকাচারকে তিনি সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন বলেই সে যাত্রায় পরিত্রাণ পাওয়া গেল। এভাবেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় বারবার; কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি না। তবুও বলি লোকজ্ঞানকে সম্মান করি আসুন।

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও লেখক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

শেখ হাসিনার পতনের চল্লিশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈশভোজ

শেখ হাসিনার পতনের চল্লিশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈশভোজ

অতিরিক্ত ডিআইজিসহ ৪৫ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি, জানা গেলো সবার নাম

অতিরিক্ত ডিআইজিসহ ৪৫ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি, জানা গেলো সবার নাম

চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে যা বললেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে যা বললেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App