×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

অন্তর্বর্তী সরকার, সংস্কার ও ৩১ দফা

Icon

মাজহার মান্নান

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

 অন্তর্বর্তী সরকার, সংস্কার ও ৩১ দফা

কোটা সংস্কার আন্দোলনে মহাক্ষমতাধর হাসিনা সরকারের করুণ পতন হবে এমন ধারণা হাসিনা সরকারের কেউই করতে পারেনি। হাসিনা সরকারের এমন আত্মবিশ্বাস ছিল, তাদের প্রবল দাপটে যে কোনো আন্দোলন খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। সরকার পতনের যে কোনো আওয়াজকে তারা চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম। ১৫ বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, সেটাকে উপড়ে ফেলা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সাধারণ মানুষ হয়তো কল্পনা করত, শেখ হাসিনার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর কিছু পরিবর্তন এলেও আসতে পারে। কিন্তু কে জানত, একটি টর্নেডো এসে হাসিনা সরকারকে তছনছ করে দেবে।

জনগণের চাওয়া-পাওয়া আর রাজনৈতিক মাঠের হিসাব কখনই এক হয় না। ভোটের রাজনীতি যতটা সহজ মনে হয় বাস্তব ঠিক তার উল্টো। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি অদ্ভুত প্রকৃতির হয়ে থাকে। জনগণের চাওয়ার মূল্য সেখানে উপেক্ষিত হওয়ার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এখনো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর হতে চলল। কিন্তু একটি শক্তিশালী নির্বাচনী কাঠামো কেন গঠন করা গেল না? কোথায় দুর্বলতা, তা সবাই কম-বেশি বুঝে। কিন্তু সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন সেটাতে রয়েছে চরম ঘাটতি। যারাই সরকার গঠন করেছে তারা দেশের উন্নয়নে যথেষ্ট কাজ করেছে, কিন্তু নির্বাচনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জনগণ বারবার আশাহত হয়েছে। আজও সেই নির্বাচন নিয়ে দ্ব›দ্ব-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ডামাডোলে আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন হয়েছিল। ভালোই চলছিল। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির টালমাটাল অবস্থার কারণে সেই ব্যবস্থাটিও ভেঙে পড়ল এবং সেটা এখন বিলুপ্ত। ২০২৪-এর একতরফা নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল। প্রদত্ত ৩১ দফা রূপরেখা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

বিএনপির দাবি- তারা রাষ্ট্র মেরামত, গণতান্ত্রিক সংস্কার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এই দফাগুলো ঘোষণা করেছে। বিএনপি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি তারা জয়লাভ করতে পারে তবে তারা জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু তাদের জাতীয় সরকারের বিস্তারিত ধরনটি কেমন হবে তা এখনো প্রকাশ করেনি। তারা ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেটা অব্যাহত রাখবে। অর্থাৎ তাদের ভাষ্যমতে, দলীয় সরকারের অধীনে আর নির্বাচন হবে না। নির্বাচন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নয়, তার সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনও তারা গঠন করবে; যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহযোগিতা নিয়ে স্বাধীনভাবে নির্বাচন করবে। এমন একটি নির্বাচনী কাঠামো প্রকৃতপক্ষে যদি দাঁড় করানো যায় তবে নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিনের যে ঝামেলা সেটা মিটবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। বিএনপি প্রদত্ত রূপরেখায় বলা হয়েছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করা হবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠন করা হবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের রাজনীতির মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে রেখেছে। ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদের মধ্যে সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত আমাদের এখানে সেটা নেই। বিরোধী দলের প্রতি ক্ষমতাসীনদের আচরণ এমন হয়ে থাকে যে শুধু তিক্ততাই বাড়ে। এর ফলে চরম বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ক্ষমতার পালাবদলের ওপর সেটার প্রভাব পড়ে। ৩১ দফা রূপরেখায় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়টি খুবই যৌক্তিক একটি বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা একটি জন দাবি। জনগণের দীর্ঘদিনের চাওয়া এটি। প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য এই দুয়ের ভারসাম্য অতীব জরুরি।

প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুনিশ্চিতকরণে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে রূপরেখায়। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমনে নানামুখী পদক্ষেপ ও ন্যায়পাল নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। দুর্নীতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরতে পরতে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছে। দুর্নীতির মহাকূপ থেকে কোনোমতেই যেন আমরা বের হতে পারছি না। তবুও ন্যায়পাল নিয়োগ করে যদি দুর্নীতির লাগাম টানা যায়, সেটাও তো অনেক কিছু। রূপরেখায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে মিডিয়া কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে। আমরা খুব ভালোমতোই জানি গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য পূর্ব শর্ত হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।

রূপরেখায় আরো বেশকিছু ঘোষণা আছে। সেগুলোর মধ্যে বেকার ভাতা চালুকরণ, শিক্ষায় সংস্কার ও বাজেটে বেশি বরাদ্দ রাখা, জনস্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন, কৃষি ভর্তুকিসহ নানা ধরনের উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। যা হোক, বিএনপির রূপরেখা পড়ে ক্ষুদ্রজ্ঞানে যতদূর বুঝেছি সেটা হলো বিএনপি ক্ষমতায় গেলে হয়তোবা রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবে। এসব কিছু নির্ভর করছে বিএনপির সরকার গঠনের ওপর। কিন্তু বিএনপি যদি সরকার গঠন করতে না পারে সেক্ষেত্রে এই দফাগুলোর কী হবে? সেগুলো কি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে, নাকি এই দফাগুলো আদায়ে তারা রাজপথে থাকবে? আবার বিএনপি সরকার গঠন করলেও যে এই রূপরেখা মসৃণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেটার নিশ্চয়তা কতটুকু? নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিভিন্ন প্রতিশ্রæতি দিয়ে থাকে। কিন্তু সরকার গঠনের পর তারা সেগুলো খুব একটা আমলে নিতে চায় না। ক্ষমতা পাকাপোক্তকরণেই যেন তাদের নজর বেশি।

হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনায়। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে কোনো সরকারকে অভেদ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান অন্যান্য অভ্যুত্থানের মতো নয়। এই অভ্যুত্থানে প্রচুর মানুষকে হত্যা করা হয়, প্রচুর মানুষ আহত হয় এবং পুলিশি কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পুলিশহীন রাষ্ট্রে একটি সরকার গঠিত হয়। ভাবা যায় কত কঠিন ছিল পথটি। শপথের পরই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রæতি দেয়। ১৫ বছরের পচনকে সাধারণ কোনো ওষুধ দিয়ে সারিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। তাই সময় নিয়ে চিকিৎসা চালাতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মনে হচ্ছে তর সইছে না। যত দ্রুত নির্বাচন হয় তত দ্রুত তারা সরকার গঠন করে আগের সব হিসাব কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে নেবে। কেন এত তাড়াহুড়া? রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর কি দায় নেই? আমাদের ভোটের সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। দেশের ৯০ শতাংশ ভোট দুটি দলে বিভক্ত। তৃতীয় কোনো শক্তিশালী দল এখনো গঠিত হয়নি। ধরে নিই, রাষ্ট্র সংস্কার করে ইউনূস সরকার নির্বাচন দিল এবং বিএনপি বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। তারা ৫ বছর রাষ্ট্র চালাবে। এই ৫ বছরে দলটির নেতাকর্মীরা অনেক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে। এতে জনগণ আবার ক্ষিপ্ত হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। তখন কী হবে? ফ্যাসিবাদ কি পুনরায় শুরু হবে? এভাবে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলতে পারে না। তাই এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কোনোভাবেই কোনো দল স্বৈরাচার হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না পায়।

বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা কোনোভাবেই সংসদ সদস্যদের হাতে দেয়া যাবে না। এ ক্ষমতা থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে, যেটা বিচারপতি এস কে সিনহা চেয়েছিলেন। বিচার বিভাগ স্বাধীন করতে হলে এটার কোনো বিকল্প নেই। নিম্ন আদালত উচ্চ আদালতের নির্দেশে চলে। কিন্তু আমাদের দেশের সব সরকারই কমবেশি নিম্ন আদালতকে নিজেদের কব্জায় নিতে চেয়েছে। এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চরমভাবে খর্ব হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে, যেন সেটাকে কোনো সরকার বগলদাবা করতে না পারে। নির্বাচনে বড় ধরনের অনিয়ম হলে পুরো নির্বাচনটিকে বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে দিতে হবে। ভোটিং সিস্টেম এমনভাবে করতে হবে যেন কারো ভোট জাল করার সুযোগ না থাকে। সুপ্রিম কোর্ট এবং নির্বাচন কমিশন এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে, যেন কোনো সরকার হাজার চেষ্টা করেও সেগুলোকে কব্জায় আনতে না পারে। যেমন ভোটের সময় নির্বাচন কমিশন যদি সেনা মোতায়েন চায় তবে সরকার সেটা দিতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশের জনগণ শান্তি চায়। আর এই শান্তির জন্য যা যা করা প্রয়োজন ইউনূস সরকার সেটা করবে বলে জাতি বিশ্বাস করতে চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে ইউনূস সরকারের পেছনে। তাই সরকার এই বৃহৎ শক্তিকে ইতিবাচক শক্তিতে পরিণত করে সংস্কার করতে পারবে বলে আশা করি।

মাজহার মান্নান : কবি ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

৯ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

৯ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

সীমান্ত হত্যা ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক জোরদারে বড় বাধা: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সীমান্ত হত্যা ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক জোরদারে বড় বাধা: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

শাহরিয়ার আলম ও দিলীপ আগরওয়ালার ব্যাংক হিসাব তলব

শাহরিয়ার আলম ও দিলীপ আগরওয়ালার ব্যাংক হিসাব তলব

র‌্যাবের গাড়ি থেকে আ’লীগ নেতাকে ‘ছিনিয়ে নিলো’ বিএনপি নেতারা

র‌্যাবের গাড়ি থেকে আ’লীগ নেতাকে ‘ছিনিয়ে নিলো’ বিএনপি নেতারা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App