নতুন বাংলাদেশের হাতছানি
রিদওয়ান বিন ওয়ালি উল্লাহ
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমল পেরিয়ে ‘স্বাধীনতা’ নামক একটি শব্দ আমরা পেয়েছিলাম ১৯৭১-এ। কিন্তু বৈষম্য আর পরাধীনতা আমাদের বাস্তবতায় আজও শেকড় গেড়ে আছে। পত্রিকার কলামে, গানে, ভাষণে সর্বত্র ‘স্বাধীনতা’ আর ‘গণতন্ত্র’ শব্দদ্বয়ের পাবলিসিটি। এদিকে অফিস, আদালত, হাট আর ঘাটে দেখি বৈষম্যের বিবিধ চর্চা। অবৈধ ক্ষমতাসীন আর পা-চাটাদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্যে জনজীবন ওষ্ঠাগত। প্রতিবাদের চেষ্টাও বিভিন্ন পর্যায়ে হয়েছে। কিন্তু ফলাফল হতাশাজনক। সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য আর শোষণের পেরেক এতটা গভীরে পুঁতে দিয়েছে যে, নাগরিক ভুলেই গিয়েছে ‘প্রতিবাদ’ করা তার নাগরিক অধিকার। ‘দেশে থাকলে আমাকে এভাবেই চলতে হবে’- এটাই ছিল ডায়ালগ। চাপিয়ে দেয়া সিস্টেমের দাসত্ব একেবারেই গা সয়া হয়ে গেছে। বরং এর উল্টো কিছু বলা অস্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে গেলেই জঙ্গি, না হয় রাজাকার, না হয় স্বাধীনতার চেতনার বিপক্ষ শক্তি অথবা জামায়াত-শিবির। অত্যাচারিত হয়ে ভেতরটা জ¦লে-পুড়ে ছাই হবে, কিন্তু মুখে ফ্যাকাশে এক কৃত্রিম হাসি প্রদর্শন করতে হবে। এ যেন স্বাধীনতা শব্দের চূড়ান্ত বিপর্যয়। ঘোষণায় স্বাধীন, ব্যবহারিক জীবনে দাসত্বের শৃঙ্খল। কী এক অসহনীয় জীবনযাপন!
অবশেষে আলোর দিশারি হয়ে জেগে ওঠল অদম্য তারুণ্য। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০-এর মতো এবারো তরুণরাই হাল ধরল। বাবা-মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ত্যাগ করে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হায়েনারা রক্তখেকো। নরপিশাচরা কেড়ে নিল হাজারো প্রাণ। শেষতক নব্য স্বৈরাচার লেজ গুটিয়ে নির্লজ্জের মতো পালিয়ে গেল।
আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশ সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এসেছে। নানা জাতি, ধর্মের, বর্ণের মানুষ এখানে বসবাস করে। তথাপি এখানে পাশ্চাত্যের মতো সাদা-কালোর বিভাজন কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। উঁচু-নিচুর বিভাজন কখনো এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ছিল না। সদ্য গণধিকৃত স্বৈরাচার এ সংস্কৃতির ধারক-বাহক। ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ একটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ ন্যারেটিভ।
২০২৪ সালে এসে বীর বাঙালি যখন রক্তের দামে দেশটাকে আরেকবার কিনে নিল, ঠিক তখনো রক্তচোষাদের হৃদয় কাঁপেনি। তারা ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। তারা সর্বজনীন বিজয়ের কপালে কালিমালেপন করতে চেয়েছে। দেশ-বিদেশে প্রচার করেছে বিজয়ীরা সংখ্যালঘুদের ধ্বংস করে দিচ্ছে, দেশ ছাড়া করছে। তারপর পৃথিবী দেখল নতুন এক চিত্র। অধিকাংশই ছিল সর্বৈব মিথ্যা আর গুজব। ফলে ওদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেল। সংখ্যালঘু ভাইবোনরা চক্রান্ত বুঝে গেল। এদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা ঘোষণা দিল, সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। আমাদের পরিচয় এক। আমরা বাংলাদেশি। ধর্ম যার যার, দেশটা সবার। দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামি সংগঠনের সুপ্রিম লিডার সবার আগে অন্য ধর্মাবলম্বীদের দুয়ারে হাজির। প্রতিটি মন্দির আর গির্জার নিরাপত্তার দায়িত্ব তারাই নিল। কী অসাধারণ এক বাংলাদেশ। চারদিকে শুধুই মুগ্ধতা।
সর্বশেষ হিংসাত্মক মনোভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র অমানবিক ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিল। অন্তত ১০টি জেলার মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি। এখানেও এক অভূতপূর্ব চিত্র ধরা দিল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপদগ্রস্ত ভাইবোনদের উদ্ধারে। সব ব্যস্ততা পেছনে ফেলে প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে মূল্যায়ন করে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে প্রতিযোগিতায় নেমে গেল। ভ্রাতৃত্বের কী দারুণ চিত্র।
হাজারো শহীদের রক্তে সংঘটিত এই বিপ্লবকে সুসংহত, অর্থবহ ও সফল করতেই হবে। ব্যর্থ হতে দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। প্রতিটি খুনের স্বতন্ত্র বিচার নিশ্চিত না হলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে গাদ্দারি হবে। সর্বজনীন ও শর্তহীন ঐক্যই হবে অমূল্য বিপ্লবকে টেকসই করার প্রধান হাতিয়ার। আত্মতুষ্টি নয়, সর্বোচ্চ পর্যায়ের আত্মসচেতনতা ও আত্মসংযম হোক সবার পাথেয়। ১৭ বছর নিজের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে মুখ খোলার সাহস হয়নি। ছাত্রজনতার রক্ষাকবচ বিপ্লব ঘটেছে। এখন কিছুটা সময় দরকার সিস্টেম সংস্কারে। এদিকে বন্যায় মানবতার হাহাকার চলছে। অথচ কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে অসময়ে নানা দাবি নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এটা সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত। ব্যক্তি স্বার্থের কবর রচনা করে সামগ্রিক স্বার্থ তথা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে পথ চলতে হবে। স্বেচ্ছাচারিতা নয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনে স্বাধীনতা চর্চার টেকসই বন্দোবস্ত করে নতুন বাংলাদেশ গড়ি একসঙ্গে।
রিদওয়ান বিন ওয়ালি উল্লাহ : শিক্ষক, শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ।