ঢাকা-দিল্লি-ইসলামাবাদ নয়া ত্রিকোণমিতি
মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নতুন এক আবহ বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে নানা চ্যালেঞ্জ যোগ হওয়ার কথা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। পাকিস্তানে রীতিমতো উচ্ছ¡াস। শুক্রবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দুই দেশের মানুষের স্বার্থে সম্পর্ক উন্নয়নের আশাবাদ জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর গরজও জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি দুদেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে সার্ককে সর্বোচ্চ ফোরাম রূপে পুনরুজ্জীবন দেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস। এর বিপরীতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন স্বীকার করে বলেছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনে সম্পর্কে কিছুটা বিঘœ ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনাকাক্সিক্ষত বেশ কিছু ঘটনায় বেশ সরব ভারত। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশে যেসব ভারতীয় প্রকল্পের কাজ চলছিল তা স্থগিত আছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ভারত প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম আবার শুরু করতে চায় জানিয়ে তিনি বলেছেন, নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতেই ঢাকা-দিল্লি পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে আগ্রহী ভারত। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক উন্নয়নমূলক প্রকল্পে যেসব ভারতীয় কাজ করতেন, তারা দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে উল্লেখ করে রণধীর জয়সওয়াল ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ার জন্য বাংলাদেশে বন্যা হয়েছে- এমন অভিযোগ নাকচ করে দেন। বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় চলমান বন্যা পরিস্থিতির জন্য ত্রিপুরার গোমতী নদীর ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়া নিয়ে চলমান আলোচনা সঠিক নয়।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর অধিকাংশই ভারতে উৎপন্ন। ভাটির দেশ হিসেবে ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় বারবার বন্যা বাংলাদেশের জন্য বিধিলিপির মতো। হিমালয়ের ধার বেয়ে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা অববাহিকার বিপুল আয়তনের পানি শেষমেশ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া স্বাভাবিক। এই তিন নদীর মিলিত প্রবাহ যখন মেঘনা হয়ে সমুদ্রে নামে, এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম; প্রথম আমাজন। ভারতের তিন দিক থেকেই পানি বাংলাদেশে নামে। উত্তরে হিমালয়ের বিশাল অববাহিকা, আবার পূর্বেও ভারত ও মিয়ানমারের পাহাড়ি ঢাল বেয়ে পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবারকার বন্যার পানি এসেছে পূর্ব দিক থেকে। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টির ধরন বদলেছে।
চুক্তি বা আইন দিয়ে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এখানে দরকার আস্থা-বিশ্বাস। সেখানে মারাত্মক একটা দোলাচল। যার জেরে পানি হয়ে উঠেছে দু’দেশের রাজনীতি-কূটনীতির অন্যতম ইস্যু। এবার প্রেক্ষিতে আরো ভিন্নতা। পানি ঠেলে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এবার ভারতবিরোধিতার তীব্রতায় পাল্টা বাঁধ দেয়ার কথাও উচ্চারণ হচ্ছে। যেই জেদ পূরণ বাস্তবে অসম্ভব। বাংলা ‘বাঁধ’ শব্দটির ইংরেজিতে তিন ধরনের অর্থ আছে। ইংরেজিতে এর তিনটি প্রতিশব্দ ‘ড্যাম’, ‘ব্যারাজ’ আর ‘এমব্যাংকমেন্ট’। প্রতিটিরই বাংলা করা হয়েছে ‘বাঁধ’ নামে। ড্যাম নির্মাণ করতে গেলে পাহাড় লাগবে। পশ্চিম আর উত্তরে পাহাড় বাংলাদেশে নেই। পাহাড়ের পর সমতল অংশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। সব পাহাড় ওপারে, পূর্বে কিছু আছে। কর্ণফুলীতে কাপ্তাই ড্যাম তেমনই একটি অঞ্চলে। ড্যাম নির্মাণ করা যেতে পারে সাঙ্গু বা মাতামুহুরীতেও। তবে বেশি প্রয়োজন সুরমা, কুশিয়ারা বা এ অঞ্চলের আরো কিছু নদনদীর ওপরে। গঙ্গা আর তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় অনেক দিন থেকেই, ফারাক্কা বাঁধের ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই গঙ্গা বাঁধের পরিকল্পনা হচ্ছে সেই ষাটের দশক থেকে। ক্ষমতার পট বদলের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার ২২ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও বন্যা পরিস্থিতি সামাল দেয়া ও পানি বণ্টন নিয়ে কিছু কথা উঠে এসেছে। সেখানে ড. ইউনূস কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে যে ধরনের বোঝাপড়া ও ‘মেকানিজম’ (ব্যবস্থা) রয়েছে, সেই ধাঁচে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্যোগী হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি। এর জবাব এসেছে ভারত থেকে। অভিন্ন নদীর কারণে বাংলাদেশের প্লাবন রোধে ওই দেশের নতুন প্রস্তাব বিবেচিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। তাদের পানিসম্পদ ব্যবহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বহুদিন ধরেই স্বীকৃত কিছু ‘মেকানিজম’ এর কথা জানান তিনি। বার্তা হিসেবে এটি নতুন। নানা কারণে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শীতল সময়ে এটি মোটা দাগের ঘটনা।
বেশ ভিন্নতা পাকিস্তানের দিক থেকেও। তা নতুন সরকার শপথ নেয়ার আগ থেকেই। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ সরকারবিহীন থাকার সময় যারপরনাই উচ্ছ¡াস পাকিস্তানের। ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দেয় ইসলামাবাদ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিরিখে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীনের অর্ধশত বছর পার হলেও বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ভাসা ভাসা সম্পর্ক। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের কার্যত উন্নতি হয়নি। এবার পাকিস্তানের আগ বাড়ানো ভূমিকা, সম্পর্ক উন্নত করার আগ্রহ জানান দেয়া, প্রধান উপদেষ্টাকে ফোনে সদালাপ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক মহলের কাছে। ড. ইউনূসের সঙ্গে ফোনালাপের কথা শাহবাজ শরিফ এক্স হ্যান্ডলে পোস্টও করেছেন। শেখ হাসিনা জমানায় বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সমীকরণ গোপন বিষয় ছিল না। বরাবর ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখেছেন তিনি। কিন্তু ইউনূস সেই পথে হাঁটছেন না। কিছুদিন আগেই বিএনপির প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসলামাবাদের প্রতিনিধিদের সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে নতুন এক ত্রিকোণমিতি স্পষ্ট। বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কিছু ভিডিও-ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে পাকিস্তানিদের বাংলাদেশের পতাকা হাতে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও আনন্দ মিছিল, এমনকি বাংলা গানও গাইতে শোনা গেছে। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখলের পর বাংলাদেশের পতাকার পাশাপাশি সেখানে কেউ কেউ ফিলিস্তিনের পতাকা উড়িয়েছেন। চাহিদা বাড়ায় পাকিস্তানের ফুটপাতে বিক্রেতারা বাংলাদেশের পতাকা রাখছেন। সেসবের বিক্রিও ভালো। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় আনন্দ মিছিল হয়েছে। মিষ্টি বিতরণও হয়েছে। ‘তুমি কে আমি কে, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ সেøাগানও শোনা গেছে।
বাংলাদেশের ছাত্রদের বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বেলুচিস্তানে বড় ধরনের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়। এর আগে বেলুচিস্তান প্রদেশে আন্দোলনটি ছিল চীন-সমর্থিত বিমানবন্দর প্রকল্পের বিরুদ্ধে। কিন্তু ক্রমেই তা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নেয়। বর্তমানে বেলুচিস্তান স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্সের নেতৃত্বে সেখানে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন হচ্ছে। বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরে আসার খবরেও সেখানে অনুপ্রেরণা ছড়াচ্ছে। কোয়েটায় গুম হওয়া বেলুচ নেতাদের সন্ধানের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন স্বজনরা। পৃথকভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকরাও নতুন করে মাঠে নেমেছেন। তারা ইমরান খানের মুক্তি এবং সরকার পতনের দাবিতে রাজপথে শক্তি দেখানোর পরিকল্পনা করছেন। এ আন্দোলনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ছাত্র সংগঠন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দলটির আন্দোলনের প্রচারেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের গণভবনের মতো পরিস্থিতি শিগগির পাকিস্তানে হতে যাচ্ছে। গোটা পরিস্থিতির মধ্যেই একটা ‘কেমন কেমন আলামত’!
গোটা বিষয়টি একদম কাকতালীয় নয়। তা কিছুটা বিশ্বের দেশে দেশে রাজনৈতিক যুবকম্পের ঢেউয়ের ছিটেফোঁটার মতো। বিভিন্ন দেশে নানা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন মাঠে মারা গেছে ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়নে। পরে অন্য কোনো ইস্যুতে কুপোকাত হয়েছে যুবক-তরুণদের মাধ্যমে। বাংলাদেশে হয়েছে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে ইস্যু করে। পরে সেটির নাম হয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। অপজিশনের নেপথ্য সহায়তায় ধারণাতীতভাবে সাফল্য এসেছে তরুণদের ব্যানারে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ‘আরাগালিয়া’খ্যাত গণবিক্ষোভের তোড়ে রাজাপাকসের পতন নিশ্চিতের পেছনেও ছিল এমন কিছু ছাপ। গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানেও কিছুটা আলামত দেখা যাচ্ছিল। মার্চে সেনেগালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তরুণদের ভূমিকাও একটি সমসাময়িক বিশ্বে একটি ঘটনা। জুনে কেনিয়ায়ও কম্পন ঘটিয়েছে তরুণরা।
এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে তরুণরাজের ঘটনাগুলো হয়তো ভবিষ্যতে আরো বিশ্লেষণ হবে। তবে এর মধ্যে উপলব্ধি বা বোধবুদ্ধি খাটানোর একটা তাগিদ রয়েছে। এটাই প্রথম প্রজন্ম, যারা ইন্টারনেটের আগের জীবন দেখেনি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পর্যন্ত খাটিয়েছে তারা। ক্ষমতাসীনরা রাস্তা বা রাজপথ নিষিদ্ধ করে তাদের দমাতে গেলে তারা ভার্চুয়াল অ্যাকশনে গিয়ে পিলে চমকে দিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান এই পিলে চমকানো রাজনীতি-কূটনীতিতে অন্যভাবে পারঙ্গম। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে চর্চা শুরু হয়েছে। অকৃত্রিম আর কৃত্রিম যেটাই হোক আগামীতে এই তিন দেশে কোন ত্রিকোণমিতির কূটনীতি চলবে, ভাবনার বিষয়।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।