×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়

Icon

সাইফুজ্জামান

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়

মানুষের জন্মগ্রহণ, বেড়ে ওঠা এবং আনন্দ-বেদনায় অবগাহিত হওয়া যেমন সত্য, তেমন সত্য কঠিন বাস্তব জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুতে পতিত হওয়া। সৌন্দর্যময় এই পৃথিবীতে মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে। ব্যাধি, জরা, মৃত্যু তিন সহচর পাশাপাশি হেঁটে এসে প্রাণ পিঞ্জিরা ছিনিয়ে নেয়। কেন এ ধরনের তাত্ত্বিক বিষয়ের অবতারণা করতে যাচ্ছি? দ্রুত অবনতিশীল সমাজে মানুষে মানুষে যোজন যোজন ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। আমাদের ধৈর্য ধরার মানসিকতা উধাও হয়ে গেছে। প্রাধান্য বিস্তার, একে অপরকে সহ্য না করা, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেখা যায় কি নিষ্ঠুর পরিহাস! হাসপাতালে চিকিৎসক, রোগী ও নার্সদের মধ্যে চলে এক অস্থিরতা। চিকিৎসা নিতে কেউ এলে সে যে মৃত্যুবরণ করবে না- এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায়ও অনেকে মারা যাচ্ছে। আস্থার স্থানটির অভাব দীর্ঘদিন অনুভূত হচ্ছে। চিকিৎসা এক মহান পেশা। সেখানেও ব্যবসা, অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিনবত্ব প্রতারণার জাল বিস্তৃত। চিকিৎসকের ভালো ব্যবহারে অর্ধেক রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। সেই আস্থাভাজন চিকিৎসক ওষুধ, প্রেসক্রিপশন ও ব্যবহারে রোগীর হৃদয়ে স্থান করে নেবে এই প্রত্যাশা সবার। রোগীর অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকের অনুপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায় অহরহ। চিকিৎসক, রোগী, সাংবাদিক ও নার্সদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি পরবর্তী সময়ে অনেক সংঘর্ষ, ভাঙচুর এবং অনভিপ্রেত ঘটনায় সম্প্রতি উদ্বেগের সঞ্চার করেছে।

হাসপাতালগুলোতে চলমান অস্থিরতা দিনের পর দিন উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। এই যে চিকিৎসক, রোগী কিংবা রোগীদের স্বজনের মধ্যে অসহিষ্ণুতা- তার কারণ কী? প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে না পারা। আবেগ, প্রতিপত্তি ও ভুল বোঝাবুঝি যে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চিকিৎসকরাও মানুষ। মানুষের ভুল হয়। হতে পারে অনেক রোগী সামলানোর ধকল সহ্য করতে না পেরে চিকিৎসকরাও তাদের দায়িত্বে অবহেলা করছেন। ভুলে কিংবা নিরাময় ক্ষমতা কার্যকর না থাকায় মৃত্যু হতে পারে অনেক রোগীর। চিকিৎসকের ওপর চড়াও হওয়া যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমন সঠিক নয় চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে যাওয়া। যে মানুষটির স্বজনের মৃত্যু হয়, তার মানসিক বিষয়টি সবার আগে অনুধাবন করা প্রয়োজন। মৃত্যু এক অমোঘ সত্য, যা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারোর নেই। গ্রামে চাকরি মিললেও চিকিৎসকরা গ্রামের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা যেতে চান না। গ্রাম-শহর সর্বত্র বেসরকারি ক্লিনিকের ব্যবসা রমরমা। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা উচ্চ ফি নিয়ে নিজস্ব ক্লিনিকে রোগী দেখে থাকেন। ক্লিনিকগুলোর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। অদক্ষ অশিক্ষিত কর্মী বাহিনী ক্লিনিকের ব্যবসা করছে। রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষার নামে ব্যবসার ব্যাপ্তি ঘটছে। ভুয়া চিকিৎসক, ভুয়া প্যাথলজিস্ট আর কম্পিউটার অপারেটর এই ক্লিনিকগুলো চালাচ্ছে। অনুমোদিত ক্লিনিকে চিকিৎসকদের ডিগ্রি, যা লেখা থাকে তা বিস্ময়কর। সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি অযতœ, অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। চিকিৎসক সংগঠনের চাপের মুখে দায়িত্বে অবহেলারত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় না। ঢাকা শহরের নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য কেবল অল্প কিছু মানুষেরই আছে। অধিকাংশ মানুষ নিয়তির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও সংঘর্ষের খবর আমরা জেনেছি। চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে সংঘর্ষ ও দূরত্বের সৃষ্টি হওয়া ভালো লক্ষণ নয়। চিকিৎসকের মহান পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি সমাজে সেবার পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে অবিরাম পরিশ্রম করছেন। তার বেতন, সুবিধা ও আনুষঙ্গিক সমর্থন বৃদ্ধি করা জরুরি। পুরো বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও পেশাজীবীরা স্ব-স্ব শিবিরে বিভক্ত হয়ে যা করছে তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। সৎ মানুষের অভাব দিন দিন বাড়ছে। হিংস্রতা, বর্বরতা ও তাণ্ডবতার অবসান করতেই হবে।

গবেষণার সুযোগ নেই। রুটিন দায়িত্ব পালন করে যাদের জীবনের সিংহভাগ কেটে যায়। অভাব, অনটন ও ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা বঞ্চনা নিয়ে যাদের দিন কাটে তাদের কাছ থেকে আমরা কি সেবা ও ভালো ব্যবহার আশা করতে পারি না? পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিনিময়ের ধৈর্য, সহনশীলতার ক্ষেত্র চিকিৎসক, রোগী, রোগীদের স্বজন ও নার্সদের সৃষ্টি করতে হবে। বঞ্চনা, দুর্ব্যবহার ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য চিকিৎসকরা দাবি জানাতেই পারেন। ইমার্জেন্সি বিভাগ ও জরুরি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র যেন বন্ধ না থাকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। একজন চিকিৎসকের সেবায় অনেক রোগী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসে। চিকিৎসকদের আরো কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে। এক কাঠি কখনো বাজে না। এই যে অচলাবস্থা চলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়-দায়িত্ব রয়েছে। সম্পর্ক উন্নয়ন হওয়ার জন্য উভয় পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজন সহানুভূতিশীল আচরণ। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা চিকিৎসা ক্ষেত্রে ধস সৃষ্টি করুক তা কারো কাম্য নয়। আচরণ ও ভালো ব্যবহার দিয়ে বিশ্ব মানবের মন জয় করা সম্ভব। বিষয়টি যেন কোনো পক্ষই বুঝতে পারছে না। হাসপাতালগুলোকে সুন্দর, সজ্জিত ও সেবাপ্রবণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন চিকিৎসকরা। রোগীরা ভদ্র আচরণ, উপর্যুক্ত অর্থ বিনিয়োগে সেবা পাবেন- এইতো নিয়ম। চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, ভালো ব্যবহার যেমন কাম্য, তেমনি রোগীর স্বজনদের হামলা ও সংঘর্ষ কাম্য নয়। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে উঠতে হবে মানবকল্যাণে।

আমাদের সমাজে চিকিৎসকরা অনেক সম্মানিত। একজন চিকিৎসকের দায়িত্বশীল আচরণের ওপরে একজন রোগীর বাঁচা-মরা নির্ভর করে। চিকিৎসকদের জীবনের নিরাপত্তা আলাদাভাবে দেয়া সম্ভব নয়। এ দেশে কারোর জীবনেরই নিরাপত্তা নেই। চিকিৎসকরা কর্মবিরতি কিংবা ধর্মঘট দিয়ে অনেক সময় অমানবিক আচরণ করে। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বাইরে প্র্যাকটিস করার নিষেধাজ্ঞা একবার জারি হয়েছিল, পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। বিশেষায়িত হাসপাতালে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ নেয়ার সুযোগ এখনো বহাল আছে। নীতিবোধ জাগ্রত থাকা একজন বিবেকবান মানুষের স্বাভাবিক গুণাবলি। চিকিৎসকদের যদি নীতিবোধ বিসর্জনের বিষয়টি গুরুত্ব না পায়, তা দুঃখজনক। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা রাষ্ট্রীয় সুযোগ বঞ্চনা নীতিবোধ ও দায়িত্বশীল আচরণের পক্ষে কাজ করতে কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পেশাজীবীদের সংগঠন আছে। এসব সংগঠন প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ধর্মঘট, কর্মবিরতি চাকরিবিধি লঙ্ঘনের শামিল। সমাজে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান আগের মতো আর নেই। পরিবার, সমাজ থেকে আমরা ভালো আচরণের যে শিক্ষা পেয়েছিলাম, তা আমাদের মানবিক গুণাবলিকে পরিপুষ্ট করতে পারেনি। আমরা বিপদে এগিয়ে যাওয়া, পরমতসহিষ্ণু হওয়া ও মানবিক গুণাবলিতে পুষ্ট হইনি। রাস্তায় বের হলেই প্রতারণা, সড়ক দুর্ঘটনা ও আততায়ী মৃত্যুর কাছে সমর্পিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতিশীল হচ্ছে। ‘ভালো ব্যবহারে বংশের পরিচয়’ এই আপ্ত বাক্য আগে বাসে লেখা থাকত। বংশ পরিচয়, ভালো ব্যবহার এসব মানুষের অভিধান থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আজকাল। একতরফা কিছুই হয় না। চিকিৎসক রোগীর সম্পর্ক উন্নয়নে পরস্পরকে এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘ সময় কর্মপালন বিরক্তি উৎপাদন ও কর্মবিমুখ করতে পারে। একঘেয়েমি কাজ ও হাজারো সমস্যা শুনতে শুনতে চিকিৎসকরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তবু একজন চিকিৎসকের ভালো আচরণ, সুপরামর্শ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে অনেক মুমূর্ষু রোগীকে। মেধাবীরা চিকিৎসকের পেশায় নিয়োজিত থাকে। এসব মেধাবী মানুষ অন্য দশজন মানুষ থেকে আলাদা নয়। আবেগ, অভিমান, ভালোবাসা, ক্রোধ, হিংস্রতা, কল্যাণ চিন্তা এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে। রোগীর স্বজনের আচরণও অনেক ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সৃষ্টি করে, যা কাম্য নয়। আমরা চাই চিকিৎসার মহান ব্রত নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা মানবিক ও নীতিবোধ সংলগ্ন থাকবেন।

একজন চিকিৎসক তৈরি করতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়। জনগণের করের টাকায় হাসপাতালের ব্যয়ভার ও চিকিৎসকের বেতন মেটানো হয়। একজন অভিভাবকের স্বপ্ন, সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা থেকে একজন চিকিৎসকের সৃষ্টি। তারা কেন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে শামিল হবেন-কেন ক্রোধের আগুনে পুড়বে হাসপাতাল!

যে দেশের কোটি কোটি মানুষের শ্রম, ঘামে ও মেধায় উন্নয়ন ঘটছে। কেন রক্তপাত, অবহেলা আর বিধ্বংসী হয়ে ওঠার খবর আমরা প্রতিদিন পড়ব? যেখানে খাঁটি মানুষ সোনার বাংলার চেহারা বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, সেখানে কেন আত্মঘাতী সংঘর্ষ, অবহেলা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার জন্ম হবে? চিকিৎসক, রোগী, নার্স, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে চিকিৎসা ক্ষেত্রের নৈরাজ্য দূর হোক- এই আমাদের প্রত্যাশা।

সাইফুজ্জামান : লেখক ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

‘অন্তর থেকে ভুল বুঝতে পারলে সুযোগ পেতে পারে আ.লীগ’

‘অন্তর থেকে ভুল বুঝতে পারলে সুযোগ পেতে পারে আ.লীগ’

সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গ্রেপ্তার

সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গ্রেপ্তার

ইউএইয়ের মধ্যস্থতায় রাশিয়া-ইউক্রেনের ২০৬ যুদ্ধবন্দী বিনিময়

ইউএইয়ের মধ্যস্থতায় রাশিয়া-ইউক্রেনের ২০৬ যুদ্ধবন্দী বিনিময়

১৪ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

১৪ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App