×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Icon

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সময় সময় আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হয়। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, হেনস্তার ঘটনা প্রায় নিত্যদিনকার হতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের মতো শিক্ষকরাও রাজনৈতিক মতাদর্শগতভাবে বিভাজিত হয়ে বিরাজমান থেকেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে পাশবিকভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকারও হতে হয়েছে, লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা কখনোই বিচলিত হতো না, হতো না ভীত। বরং তারা সবসময়ই বেপরোয়া ছিল, থাকত। থাকবে না সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট রুম বা টর্চার সেলের কথা কার না মনে আছে। হলে আবাসিক সুবিধা পাওয়ার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল সব ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের হাতে জিম্মি। হল কর্তৃপক্ষ ছিল কেবলই সাইনবোর্ড। সেখানেও দলীয় রাজনীতির দাপট। কতশত করুণ আর অমানবিক ঘটনার গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ক্যাম্পাসজুড়ে- তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। এই তো মাত্র কিছুদিন আগ পর্যন্তও তেমনটাই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এ নিয়ে বেশ হতাশাও ছিল। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে গর্ব করে কিছু বলার মতো ঘটনা বা গল্প হয়ে উঠত না সহজে, তেমনটা বললেই চলে। মনটা ছোট হয়ে আসত। যদিও আশার প্রদীপটা জ¦লত এই ভেবে যে, বিভিন্ন সময়ে ছাত্র আন্দোলনের সূচনা ও সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের পরিবর্তন আনার মূল কাজটার বীজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই বপন করা হয়েছে। ’৯০ ও ’২৪-এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান বা আন্দোলন তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও ধারাবাহিকতা। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিজয়ের পর কি ছাত্রদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছিল, তারা কি নির্মোহ দেশপ্রেমিক হয়েই থেকেছে শেষ অব্দি, এমন প্রশ্নের উত্তর কিন্তু পরবর্তী ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সহজেই দৃম্যমান হয়ে উঠবে। ছাত্ররা কিন্তু শেষ অব্দি ছাত্রত্বের লাবণ্য নিয়ে জনগণের পাশে থাকতে পারেনি, উপরন্তু ক্রমান্বয়ে একেকজন শাসক হয়ে উঠেছে এবং সেটা গতানুগতিক। বাংলাদেশের ইতিহাস সেই কথাই বলে। শাসন আর শোষণের কায়দা কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে কেবল। যদিও ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে তা দেখার জন্য সময় লাগবে। কারণ পরিবর্তন তো আনতে হয় মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি আদর্শিক জগতে প্রথম। যা কর্ম প্রক্রিয়াকে করবে স্বচ্ছ, গতিশীল এবং সংবিধানসম্মত। কল্পনায় লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না, লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, অর্থ, কর্মকৌশল, জনবল এবং মেধা ও দক্ষতা লাগে। রাষ্ট্র সংস্কার বিশাল এক কাজ। এটা কোনো পুরনো অট্টালিকার সংস্কারের মতো কাজ নয়, যেখানে নতুন রড, ইট কিংবা সুরকিরই কেবল প্রয়োজন পড়ে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অপরিহার্য প্রকৃত চেতনার।

যাহোক, রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র বা তরুণ সমাজ নিয়ে সমাজ ও অভিভাবকদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। বেপরোয়া প্রযুক্তির ব্যবহার, মোবাইল ডিভাইসের অত্যধিক প্রচলন, মাদকে আসক্তি, টিকটক কালচার, কিশোর গ্যাং ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণের কারণে তরুণদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। তরুণ সমাজ নিয়ে সংশয়পূর্ণ ধারণা জন্ম নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলতে সাধারণত তিন ধরনের শিক্ষার্থীর ছবি ভেসে উঠত- এক. ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ব্যানারের শিক্ষার্থী, দুই. বিরোধীয় রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষার্থী এবং তিন. অরাজনৈতিক সাধারণ শিক্ষার্থী। ত্রিভুজ চেতনাগত পরিস্থিতিতে প্রায়ই ক্যাম্পাস থাকত উত্তপ্ত। যদিও সবসময় সর্বময় ক্ষমতাধর থাকত ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীরা। অনেকে মনে করে যে, সেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া এখন স্বচ্ছ, ছাত্র বা তরুণরা আদতেই তাদের দেশকে ভীষণ ভালোবাসে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে যে, ক্যাম্পাস এখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের দখলে। ক্ষমতাসীন শিক্ষার্থীদের অবস্থান বা অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অন্যান্য রাজনৈতিক মতাদর্শের এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন একই প্ল্যাটফর্মে। তারা রাষ্ট্রের সংস্কার চায়, পরিবর্তন চায়। সেই আলোকে তারা কাজ করছে।

ছাত্রদের দেখা গেছে পুলিশের অবর্তমানে পাড়া-মহল্লায় ডাকাতকে প্রতিহত করার জন্য পাহারা দিতে, রাস্তায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে। এমন অবস্থার পরপরই দেখা গেছে দেশে ভয়াবহ বন্যার। বন্যা বাংলাদেশের একটা নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অতিবৃষ্টি, ভারি বৃষ্টি তথা জলবায়ু পরিবর্তন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণে অবহেলা ও দুর্নীতি, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদির কারণে প্রতি বছর বন্যা দেখা দেয় আমাদের দেশে। সম্প্রতি সময়ের যে বন্যার সৃষ্টি তার নেপথ্যে ইন্ডিয়ার পানি আগ্রাসন মনোভাব রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছে, দাবি করছে। তাদের মতে, ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দেয়ায় বাংলাদেশ প্লাবিত হয়েছে। যদিও ইন্ডিয়া এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল উপদেষ্টা বলেছেন, ইন্ডিয়া বাঁধ খুলে দেয়ার আগে বাংলাদেশকে অবহিত করেনি। ইন্ডিয়া বাঁধ খুলে দেয়ার সংবাদ জানালে বাংলাদেশ সতর্ক অবস্থা গ্রহণ করতে পারত। যাহোক, বাংলাদেশের ১১টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বসে নেই ছাত্রসমাজ। তারা ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণের কাজটি করছে অন্যদের পাশাপাশি। টিএসসিতে গেছে এমন অনেকেই তাদের সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ছাত্রদের আহ্বানে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে অসংখ্য মানুষ অর্থ ও জরুরি সামগ্রী নিয়ে ছুটে গেছে, যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবনে। তরুণ সমাজ যেখানে নারী ও পুরুষ সম্মিলিতভাবে কাজ করছে বন্যার্তদের জন্য, দেখে ভালো লাগল। একসঙ্গে, এক হয়ে কাজ করছে তারা দেশের মানুষের জন্য। ভুলে যেতে হলো যে কখনো আমাদের দেশের নারী, শিশু, কিশোরী বা তরুণীরা কোনো তরুণের যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের মতো ঘটনার শিকার হয়েছে। আজ তারা যেভাবে, যে অবস্থায় অবস্থান করে কাজ করছে তা অত্যন্ত কাক্সিক্ষত ও শ্রদ্ধার। সম্মান ও মর্যাদাকর তো বটেই। এমন শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষার্থী তো চাই আমরা। সাম্প্রতিককালে বন্যায় তাদের ভূমিকা সামাজিক দায়বদ্ধতাকে দৃশ্যমান করে তোলে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো যেন ক্ষমতার মোহ তাদের পেয়ে না বসে, সেই কামনাই করি। ক্ষমতার মোহ প্রবল গতিতে সংক্রমিত হতে দেখা যায়। ব্যক্তি, গোষ্ঠীর স্বার্থপরতাকে মুখ্য হতে সহায়তা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ ধরনের মানবিক আচরণ কিন্তু নতুন নয়। ইতোপূর্বে ১৯৯৮ সালের বন্যায় শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে হাতে রুটি, স্যালাইন বানিয়ে বন্যাদুর্গতদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে।

সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে এখন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কার্যকলাপের ছবি। কিছুদিন আগেও টিকটকের ছড়াছড়ি ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখন ততটা নেই। যাওবা আছে বিগত সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের নিয়ে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ করা কিছু ভিডিও ক্লিপ এবং বর্তমান ছাত্রদের গুণগান ও সাফল্য নিয়ে প্রচারণা। একটা ভিডিও ক্লিপ বেশ চোখে পড়ল। ক্লিপে দেখা গেল যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফের সঙ্গে পরিচয় পর্ব হচ্ছে বিসিবির কর্মকর্তাদের। প্রবীণ, বয়স্ক যারা এক সময়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন হয়তো বিসিবির দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়ে গেছে, তারা এক এক করে দাঁড়িয়ে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে এবং সেটা স্যার সম্বোধন করে। বয়স ও অভিজ্ঞতায় বড়দের চেয়ার থেকে উঠে পরিচয় দেয়ার বিষয়টি মোটেও ভালো লাগেনি। বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় এটা বেমানান লেগেছে। এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত। উপদেষ্টা আসিফের চেয়ার হয়তোবা সেটা ডিজার্ভ করে, কামনা করে। সে নিজেও হয়তোবা সেটাই চাইছিল। কিংবা চায়নি। তবে এমন হুজুরে সংস্কৃতিই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, যেটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। পরিচয় পর্বের কৌশল সহজ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ হলে পদমর্যাদা বাড়বে, কমবে না। যে কোনো কাজে সুন্দর ও ইতিবাচক আন্তঃসম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয় এবং যেটা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে সৃষ্টি হতে পারে।

ছাত্ররা যা পেরেছে, রাজনৈতিক দলগুলো তা পারেনি। এই পারার পেছনে ছিল ছাত্রদের অদম্য সাহস এবং পরিবর্তনের জন্য জনগণের সমর্থন। ছাত্রদের সাফল্য যেন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, পুরাতনের পুনরাবৃত্তি না ঘটায় সেইদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ হোক মানবিক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ এবং সর্বোপরি দেশ ও দশের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

জাপানের শীর্ষ ১৬০০ কোম্পানিতে নারী সিইও মাত্র ১৩ জন

জাপানের শীর্ষ ১৬০০ কোম্পানিতে নারী সিইও মাত্র ১৩ জন

চ্যাম্পিয়নস লিগে রাতে মাঠে নামছে ম্যানসিটি-ইন্টার মিলান-পিএসজি

চ্যাম্পিয়নস লিগে রাতে মাঠে নামছে ম্যানসিটি-ইন্টার মিলান-পিএসজি

মব জাস্টিস কী, কেন ঘটে, বন্ধের উপায় কী?

মব জাস্টিস কী, কেন ঘটে, বন্ধের উপায় কী?

বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা, গর্ভপাতে দাবি করেন ৭৫ লাখ টাকা

বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা, গর্ভপাতে দাবি করেন ৭৫ লাখ টাকা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App