×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

কারো আচার, কারো অনাচার

Icon

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কারো আচার, কারো অনাচার

স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী এবং প্রধান সংবিধানপ্রণেতা (কথিত নিম্নবর্ণের) ড. আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘যদি জাত-বর্ণ থাকে তাহলে বর্ণবহির্ভূত জাতিও (ড়ঁঃপধংঃব) থাকবে। সমগ্র জাতপ্রথার অর্থাৎ বর্ণাশ্রম ধর্মের বিলুপ্তি না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।’ গান্ধী কিন্তু বরাবরই ছিলেন বর্ণাশ্রম ধর্মের গোঁড়া সমর্থক। তিনি অস্পৃশ্যদের শূদ্র অথবা চতুর্থ বর্ণ হিসেবে গণ্য করার বিধান দিয়েছিলেন। গান্ধী আম্বেদকরের কথার প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “মেথর মেথরই থাকবে, তবে তার ‘আদর্শ ভাঙ্গি’ (মেথর বা ঝাড়–দার) তার পেশাকে পবিত্র কর্তব্যরূপে গ্রহণ করে মলমূত্র শুদ্ধভাবে পরিষ্কার করবে, টাকা-পয়সার আকাক্সক্ষা করবে না, মদ-মাংস ছোঁবেন না। যেসব অন্ত্যজ লেখাপড়া শিখেছেন তারাও পিতৃ-পিতামহের পেশা ত্যাগ করবেন না, তাকেই মহত্ত্বদান করবেন।” গান্ধী বর্ণাশ্রমকে বিজ্ঞানভিত্তিক বলেছিলেন এবং এর মধ্যে সৌন্দর্যও আবিষ্কার করেছিলেন।

ভারতবর্ষের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের সমস্যাকেও গান্ধী দেখেছেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সনাতনী হিন্দু রূপেই, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রূপে নয়। ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে তিনি হিন্দু মহাসভার নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বলেছিলেন, ‘আমি হিন্দু হয়ে জন্মেছি, আমার মৃত্যুও হবে হিন্দু হিসেবে, একজন সনাতনী হিন্দু হিসেবে। আমি যদি মুক্তি লাভ করি তো হিন্দু হিসেবেই করব।’ এর আগে আরো বলেছিলেন, ‘আমার দেশের থেকেও আমার ধর্মকে আমি বেশি ভালোবাসি, তাই আমি প্রথমে হিন্দু, পরে জাতীয়তাবাদী।’

গান্ধীজি ১৯২৬ সালের এপ্রিলে পুঁজিপতি এবং হিন্দু মৌলবাদী রাজনীতির প্রবাদতুল্য ঘনশ্যামদাস বিড়লাকে লিখেছিলেন, ‘...কলকাতার দাঙ্গায় আমি বিচলিত হইনি। আমি আগেই বলেছি হিন্দুরা যদি লড়াই করতে চায় তাহলে আমাদের উচিত হবে তাকে নিষ্ঠুরতার লক্ষণ মনে করে দোষ না দিয়ে গুণ হিসেবে গণ্য করা এবং তার আরো বিস্তার লাভে সাহায্য করা।’ (তথ্যসূত্র : শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দাঙ্গার ইতিহাস।) ঘনশ্যামদাস বিড়লা, বাজাজ, ঠাকুরদাস প্রমুখ পুঁজিপতিরা গান্ধীকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিতেন। ঘনশ্যামদাস বিড়লা প্রসঙ্গে সুভাষ বসুর অগ্রজ শরৎ বসু বলেছিলেন, ‘পলাশীর যুদ্ধে জগৎশেঠের ভূমিকা আর বাংলা বিভাগে বিড়লার ভূমিকা অভিন্ন।’ গান্ধী অবশ্যই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তবে ধর্মনিরপেক্ষও কিন্তু ছিলেন না। রাজনীতিতে ধর্মের সংযোগ ভারতবর্ষের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি। দুঃখজনকভাবে তাকে তার অসাম্প্রদায়িক কাজের কারণেই বর্তমান বিজেপির পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভার সশস্ত্র কর্মীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। যে হিন্দু ধর্মে আনুগত্যের অজস্র নজির তিনি স্থাপন করেছিলেন, সেই হিন্দু মৌলবাদী চক্রই তাকে হত্যা করেছিল।

বিস্ময়কর হলেও সত্য কাশ্মিরের প্রচুর মুসলিম গরুর মাংস খায় না। খাবারের হোটেলগুলোতে লেখা দেখেছি ‘নো-বিফ’। কারণ অনুসন্ধানে জেনেছিলাম শ্রীনগরের সুফি-সাধক নূরউদ্দিন ওয়ালির কথা। নূরউদ্দিন ওয়ালির ধর্ম-মাতা ছিলেন এক হিন্দু সন্ন্যাসিনী। শৈশবে মাতৃহীন নূরউদ্দিনকে তিনি নিজ স্তনপান করেছিলেন। হিন্দুরা নূরউদ্দিন ওয়ালিকে নুন্দঋষি বলে। ধর্ম-মাতা লালেশ্বরীকে মুসলমানরা ডাকে লাল্লাদেদ নামে। মৃত্যুর পূর্বে নূরউদ্দিন তার ভক্তদের উদ্দেশে তার ধর্ম-মাতার স্তনদানের ঋণ পরিশোধে গরু জবাই ও গরুর মাংস খেতে বারণ করে গেছেন। সেই নির্দেশানুযায়ী কাশ্মিরের প্রচুর মুসলিম গরু জবাই করে না। গরুর মাংসও খায় না।

আমাদের সাহিত্যে বিখ্যাত একটি গল্পে গরু প্রসঙ্গ রয়েছে। শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প ‘মহেশ’। গল্পের মূল চরিত্র গফুর। হতদরিদ্র এক মুসলিম। পেশায় ছিল তাঁতি পরে ভাগচাষি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করত। তার পরিবারে মাতৃহীন মেয়ে আমেনা আর বৃদ্ধ ষাঁড় মহেশ। গ্রামটি ব্রাহ্মণ-শাসিত। জমিদারের খাজনা প্রদানের অক্ষমতায় গফুরকে নিগৃহীত হতে হতো। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপে পানির আকাল গ্রামটিতে। হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিক্যের কারণে অস্পৃশ্য মুসলিম আমেনাকে বহুকষ্টে পানি সংগ্রহ করতে হতো। পানির তৃষ্ণায় বৃদ্ধ ষাঁড় মহেশ আমেনার বহুকষ্টে আনা পানির কলসিতে মুখ দিতে গেলে কলসি ভেঙে যায়। এতে ক্ষিপ্ত গফুর কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে লাঙলের ফাল দিয়ে মহেশকে তীব্র আঘাত করলে, মহেশের মৃত্যু ঘটে। নিজের গরুকে নিজে হত্যা করলেও তার নিস্তার নেই। গো-হত্যার অভিযোগে শাস্তি পেতে হবে। আত্মরক্ষার তাগিদে বাপ-মেয়ে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। গল্পের গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের এক প্রান্তিক জনপদের। যেখানে জমিদারের নিপীড়নের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ শাসনে মুসলমান গফুরের পরিণতির বিষয়টিও ফুটে উঠেছে।

গরু নিয়ে অজস্র রাজনৈতিক ঘটনা উপমহাদেশে ঘটেছে। এখনো ভারতে ঘটছে। ফ্রিজে রাখা মাংসকে গরুর মাংস সন্দেহে মুসলমান হত্যার ঘটনাও সাম্প্রতিক। অথচ পরে প্রমাণ মিলেছে ফ্রিজের সেই মাংস গরুর ছিল না। ছিল খাসির। ১৯৭৪ সালে ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার স্তম্ভের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতাকে পরিহার করে সামরিক শাসক এরশাদ প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্মকে সাংবিধানিকভাবে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার চরম পরিপন্থি। সব সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় অধিকার এবং পালনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার পরও এখন ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার সংবিধান উপেক্ষা করে হিন্দুত্ববাদী শাসনে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। জনসমষ্টির একটি বড় অংশ নিরামিষভোজী। হিন্দু ব্যতীত অন্য যারা আমিষ খাবে তাদের জন্য গরু নিষিদ্ধ। পশ্চিম বাংলাসহ মাত্র ক’টি প্রদেশে গরু জবাই করার বিধান রয়েছে। অন্য সব প্রদেশে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিজেপি জনরায় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। বিজেপি শাসনামলে ভারতের সাম্প্রদায়িক অনাচার আরো বিস্তার লাভ করেছিল। অপরাপর ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচার-প্রচারণা চালিয়েই জনগণের ভোট আদায় করেছিল। কাজেই তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা ধীরগতিতে হলেও তারা বাস্তবায়নে চেষ্টার ত্রæটি করবে না।

গরু যে অত্যন্ত উপকারী প্রাণী তা আমরা সবাই জানি। এই গরু কুরবানি ঈদের প্রধান পশু। গরু জবাই করে আমরা কুরবানি দিয়ে থাকি। ভারতের বর্তমান শাসক দল আমাদের গরু দেয়া বন্ধ করেছে। গো-হত্যা হতে দেবে না। এ নিয়ে আমাদের ওপর তারা ভয়ানক নাখোশ। ভারতের গরু না আসায় আমাদের গরু কুরবানি দেয়া কিন্তু বন্ধ হয়নি। অধিক দামে কেবল কিনতে হচ্ছে। কুরবানি দেয়া ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু কুরবানি এখন সামাজিক আচারে পরিণত। মান-মর্যাদা রক্ষায় ও প্রকাশে গরু কুরবানির আবশ্যিকতা প্রশ্নহীন। আমাদের উপমহাদেশীয় ধর্মাচারে-রাজনীতিতে গরুকেন্দ্রিক অজস্র ঘটনা-দুর্ঘটনা ইতিহাসের নানা পর্বে খুবই জাজ্বল্যমান। গরুকে কেন্দ্র করে বহুমাত্রিক রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ছিল। এখনো ভারতে গরুর জন্য মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। গরুতে কী আছে যে, গরু রাজনীতির জন্য এমন গুরুত্ব পেয়েছে? এবং অতীতের মতো আজো পাচ্ছে? তার কারণ অনুসন্ধান করা কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরুর রচনা আবার নতুন করে পাঠ করা এবং নতুনভাবে রচনা লেখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নিরীহ গৃহপালিত গরু আমাদের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এত যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমাদের অনেকের নিশ্চয় জানা ছিল না। গরুর মর্যাদা-সম্মান এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রয়েছে; সে কারণে গরু সম্পর্কে পুনর্পাঠ কেবল আবশ্যক নয়, অপরিহার্যও হয়ে পড়েছে।

এক সম্প্রদায়ে আচার, অপর সম্প্রদায়ের অনাচার। এ নিয়ে বিরোধ-বিভক্তি, দাঙ্গা-হাঙ্গামার অগণিত ঘটনার ধারাবাহিকতা থেকে পরিত্রাণের উপায়টি হচ্ছে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকা। রাষ্ট্র যদি তার ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে বাস্তবানুগ রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে; তাহলেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। পাশাপাশি ধর্মকে রাজনীতিতে যুক্ত করা, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে নির্বাচনী রাজনীতিতে নিয়ামক হিসেবে সঙ্গী করার ঘৃণিত অবস্থান পরিত্যাগ করাও অতি-আবশ্যিক। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রভাব সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হলে এই সংকটের নিরসন ঘটবে। মানুষে-মানুষে ধর্মীয় বিরোধ-বিভক্তিতে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বলিষ্ঠ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিকতায় সমাজের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক বিরোধ-বিভাজনের অবসান সম্ভব। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সব ধরনের অধিকার ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত হলে ধর্মীয় বিরোধ-সাম্প্রদায়িকতারও অবসান সম্ভব। শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক অভিপ্রায়েই সমাজ জীবনে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটে। সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত একমাত্র রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতেই সম্ভব।

রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক জোরালো অবস্থান এবং ভূমিকাই ধর্মীয় সংঘাতের বিনাশ সাধনের একমাত্র উপায়। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক শক্ত-পোক্ত অবস্থানে ব্যক্তি ও সমাজকে সঠিক পথানুসন্ধানে পরিচালিত করতে পারে। একের আচার আর অপরের অনাচার সহিষ্ণুতার জন্ম দিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিকল্প নেই।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

১৩ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

১৩ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

ডোনাল্ড লু’র নেতৃত্বে আজ ঢাকায় আসছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

ডোনাল্ড লু’র নেতৃত্বে আজ ঢাকায় আসছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশকে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত

রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশকে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত

বিএনপি নেতা আশফাকের নেতৃত্বে বায়রার ইসি বৈঠকে হামলা-ভাঙচুর

বিএনপি নেতা আশফাকের নেতৃত্বে বায়রার ইসি বৈঠকে হামলা-ভাঙচুর

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App