×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

বণিকদের সিনা টানের এখনই সময়

Icon

মোস্তফা কামাল

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বণিকদের সিনা টানের এখনই সময়

রাজনীতিতে জড়াতে চান না, আবার না জড়িয়েও পারেন না- এমন একটি কমিউনিটি হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে তারা চান ব্যবসা করতে। লাভ গুনতে। বাস্তবে এই ‘কিছু ব্যতিক্রমই’ পাকিয়ে দিচ্ছেন যত গণ্ডগোল। রাজনীতির চোরাগলিতে আয়-উন্নতিকে তারা পেশা বানিয়ে ফেলেন। অন্যদেরও এই গলিতে টেনে এনে ছাড়েন। আর নিজেদের নামান ক্ষমতাসীন দলের মহল্লা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের চেয়েও নিম্নমানে। তাদের শুদ্ধ-বিশুদ্ধ হওয়ার এখন একটি সোনালি সময়। কেবল সহি-শুদ্ধ নয়, নিজেদের মান-মর্যাদাও বাড়াতে পারেন। সিনা টান করে বলতে পারেন, পলিটিক্যাল আইটেম বা রাজনীতির পণ্য আর হবেন না। কেউ যেন আর তাদের সিন্ডিকেট, কালোবাজারি ধরনের গাল দিতে না পারে। এই সুযোগটি বেশি দিন থাকবে কিনা, সেই সংশয় কাটার আগেভাগেই যথাযথ পদক্ষেপ তারা নিতে পারেন। আর সুযোগটি নেয়া, না নেয়া তাদের ওপরই নির্ভর করছে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশে আরো কয়েকবার হয়েছে। এবারেরটি একদম আলাদা। কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে এ সরকার গদিতে বসেনি। এই সরকার নির্বাচনের মাধ্যমেও ক্ষমতায় আসেনি। তারা ব্যবসাবান্ধব বা ব্যবসায়ীবান্ধব টাইপের কোনো ওয়াদাও দেয়নি। দিতে হয়নি। একটা রক্তস্নাত বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারটিকে ঘিরে তাই ব্যবসায়ীদের কেবলা-সেজদা বদলের দরকার করে না। অতীতের দলবাজিসহ নানা অপরাজনীতির জন্য ক্ষমা চাওয়ারও পর্ব থাকে না। নিজেদের মর্যাদা-সম্মান বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিজেরাই কার্যকর করতে পারেন। সে লক্ষ্যে শুরুতেই তাদের নিজস্ব ফোরামগুলোকে শক্তিমান করতে পারেন। এ জন্য বাইরের কারো সহযোগিতা, বুদ্ধি, পরামর্শ বা কানপড়া লাগে না। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে একটি মর্যাদার কাঠামোতে আনতে চাইলে কারো কারো মন খারাপ হলেও বড় কোনো বাধা দেয়ার ক্ষমতা এখন কারো নেই।

জন্মের পর থেকেই এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্ব নির্বাচন হয় সিলেকশনের মাধ্যমে। প্রক্সি বা দলবাজিতে নেতা বানানোর নিয়ত নিতে হবে নিজেদেরই। ১৯৯৪ সালে প্রক্সি সিস্টেম উঠে গিয়েছিল নিজেদের মর্যাদা বাড়ানোর আশায়। এর মাঝেও ঢুকে পড়ে ছোট প্রক্সি। ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ আওয়াজে সরাসরি ভোটে সালমান এফ রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৮ সালে আব্দুল আওয়াল মিন্টু। তখন আওয়ামী লীগ করতেন তিনি। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন বিএনপিপন্থি নেতা রউফ চৌধুরী। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরুর সম্পৃক্ততায় এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন ব্যবস্থায় বেশ পরিবর্তন আনা হয়। সরাসরির ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়। সেই সঙ্গে নমিনেটেড পরিচালকদের বিধান চালু করলে এক প্রকার তাদের ভোটেই প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার ব্যবস্থা হয়। সাধারণ সদস্যদের তুমুল বিরোধিতা তা আটকে রাখতে পারেনি। এই সিস্টেমে আব্দুল আওয়াল মিন্টু আবার প্রেসিডেন্ট হন। তখন তিনি বিএনপি নেতা। এরপর ২০০৫ সালেও কোনোরূপ নির্বাচন ছাড়া বিএনপির আরেক নেতা মীর নাসির প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। এরপরে এক-এগারো সরকার জমানায়ও পরোক্ষ নির্বাচন। সেই সঙ্গে কিছু অনিয়মও। এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট হয়ে যান আনিসুল হক।

এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপির বানিয়ে যাওয়া নিয়মে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের লোকরা প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে থাকেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই কোন পদে কে বসবেন তা ঠিক করে দেয়া হতে থাকে। এসবের মধ্য দিয়ে এফবিসিসিআই সরকারি দলের একটা অঙ্গসংগঠন হয়ে যায়। তা হতে হতে তারা সরকারকে টিকিয়ে রাখার ক্যাডার হয়ে যান। যার নোংরা রূপ তারা দেখিয়েছেন গেল সরকারের পতনের মাত্র কয়েক দিন আগে। বাংলার জমিনে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই, তাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা লাগে সব তারা করবেন ধরনের বক্তব্য তখন আওয়ামী লীগের খাস নেতারাও কমিয়ে দেন। বক্তব্য দেয়ার চেয়ে তখন তাদের পালানোর রাস্তা খোঁজা হয়ে পড়ে বেশি জরুরি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা পাকালেন গণ্ডগোল। একদিকে শিশু-কিশোরদের লাশ পড়ছে, আরেকদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন তারা সরকারের সঙ্গে আছেন। তাদের যত আস্থা সব শেখ হাসিনাতেই।

এ কাজটি করে ব্যবসায়ীরা আচ্ছা রকমের দলবাজিতে চিহ্নিত হয়েছেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ক্ষোভ গিয়ে পড়ে তাদের ওপর। ছোট মাপের ব্যবসায়ীসহ বিক্ষুব্ধ মানুষ চড়াও হয় কিছু ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর। এফবিসিসিআইয়ের হাটখোলা রোডের অফিসে ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিছু মানুষের হস্তক্ষেপ আর প্রতিরোধে মতিঝিলের মূল বিল্ডিং রক্ষা পায়। হাতে ধরে বিপদ ডাকার মতো কাজের পরিণতিতে অনেক ব্যবসায়ী এখন গা-ঢাকায় আছেন। ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা এ পরিণতির জন্য তাদের নেতাদেরই দুষছেন। সাধারণ সদস্যরা এফিবিসিসিআইতে রাজনীতি চান না। মর্যাদা চান। এখন মর্যাদা পাওয়ার পথও তারা নিশ্চয়ই জানেন।

তা জেনেই সেদিন বিএনপি নেতা আব্দুল আওয়াল মিন্টুর ডাকা মেলদরবারে যাননি ব্যবসায়ীদের অনেকেই। যা এখন থেকেই ব্যবসায়ীদের দলবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার একটি নমুনা। ক্ষুদ্র-মাঝারি মিলিয়ে তারা সংখ্যায় অনেক। আর কারো মুরিদ না হয়ে নিজেরা নিজেদের আমল-আখলাক শুরু করলে বণিকদের আমলনামা পরিষ্কার হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। বিষয়টা নির্ভর করছে নৈতিকতা ও মর্যাদার। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নৈতিক জয় ৫ আগস্টের ঢের আগেই। তাদের ওই জয় মানে সরকারের পরাজয় ছিল না। কারণ এ আন্দোলনকারীরা ক্ষমতার প্রার্থী ছিলেন না। সরকারকে হটানো তাদের এজেন্ডাও ছিল না। তাদেরটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে নিরীহ-নির্দোষ একটি সামাজিক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত। কিন্তু সরকার বিষয়টিকে সেভাবে না নিয়ে তাদের কেবল প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। শেষতক তারা প্রতিপক্ষই হলো।

এবারের আন্দোলনটি কোটা নিয়ে সূত্রপাত হলেও তা আর কোটাতে ছিল না- তা সামান্য বুঝজ্ঞাসম্পন্ন মানুষও বুঝেছে। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে। একে সঙ্গী করেই এখন দেশকে একটি অবস্থানে নেয়ার অভিযাত্রা নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সরকারের। স্থানিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে থাকা বিশাল পরিচিতি থাকলেও কাজটা অবশ্যই কঠিনের চেয়েও কঠিন। দেশের মূলধারার কোনো দলই দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত নয়। তাই আশাবাদী হয়েও আশাহত হতে হয়। আরব বসন্তের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা ‘আরব শীত’ হয়ে যাওয়ার কথা সামনে চলে আসে। আরব বিশ্বের গণ-অভ্যুত্থান আংশিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ সেখানকার রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা খুবই সীমিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এই জেনারেশন-জেড (জেন-জি) আন্দোলন থেমে যায়নি। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার আগে সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং বয় স্কাউটরা ট্রাফিক পুলিশ, নগর পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মীর দায়িত্ব পালন করেছেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকছেন। ব্যবসায়ীরা কেন পিছিয়ে থাকবেন। গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন ও রক্ষা এখন তাদেরও দায়িত্ব। ছাত্র-জনতা, ব্যবসায়ীসহ সব পক্ষের উচিত হবে এই বিজয় ও ঐক্যকে সংরক্ষণ করা। সেই সঙ্গে নিজেদের ভাব-মর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং ক্রমান্বয়ে আরো বাড়ানো। দেশের বিজনেস কমিউনিটিও নিশ্চয়ই তা পারে। তাদের সবাই দলবাজ নন। বাজার সিন্ডিকেটের সদস্য নন। কালোবাজারিতে আসক্ত নন। রাজনৈতিক লেজুড়ে অনেক পাপ তাদের জমেছে। অনেক দায়ও রয়েছে। এখন সময় এসেছে পাপ মোচনের, দায় মেটানোর।

কাজের ভলিউম বেশ মোটা অন্তর্বর্তী সরকারের। তা আরো দীর্ঘতর হচ্ছে। এগুলোর কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাজার পরিস্থিতি বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার সঙ্গে অন্যগুলো না মেলানোই ভালো। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর দিনকয়েক হুট করে কিছু পণ্যের দাম কমে। ধীরে ধীরে দাম আরো কমবে বলে আশ্বাস শুনিয়েছে বিক্রেতারা। বাজার মনিটরিং করা শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তারা বাজার ঘুরে দাম নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছেন। চেষ্টায় কিছুটা ফলও দিয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান ঘোষণা দিয়েছেন, বাজারব্যবস্থাপনার অনিয়ম ও অবৈধ সিন্ডিকেটের নথিপত্র তুলে দেয়া হবে ছাত্রদের হাতে। শুনতে তাৎক্ষণিক সুন্দর মনে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এসে যায়, এসব নথিপত্র এতদিন কাউকে দিয়েছিলেন তিনি? নাকি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন? অথবা দায়িত্বশীল কাউকে দেয়ার পর কী রেসপন্স পেয়েছিলেন? পরিষ্কার করলে তা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হতে পারত?

অনেকদিন থেকেই এ পদে আছেন এই ডিজি। এখন বলছেন, বাজার সিন্ডিকেটের মূল হোতা করপোরেট গ্রুপ। যেখানে হাত দিচ্ছেন, সেখানেই অনিয়ম। এতদিন তা জানতেন না তিনি? এখন বলছেন শিক্ষার্থীরা যেখানে হাত দেবে, সেখানে সোনা ফলবে। শুনতে এসব কথাও বড় মধুর। বাস্তবতাটা নিদারুণ। যত দোষ ব্যবসায়ীদের কাঁধে চাপানো কতটা ন্যায্যতা? উচ্চমূল্যস্ফীতিতে দেশের মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের বুক মাটিতে লাগিয়ে দিতে পারার এই স্মার্ট-ক্যারিশমেটিকরা সবাই কি ব্যবসায়ী? কেন যত বদনামটা তাদের ললাটেই? তা উপলব্ধিতে ব্যবসায়ীদের সময়োচিত সুমতি আসতেও পারে। বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করলে মজুতদার, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব এমনিতেও কিছুটা কমতে বাধ্য। চাওয়ার মতো চাইলে এ কাজে বনেদি বণিকরা নিজ থেকেই ভূমিকা রাখতে পারেন।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন ড. ইউনূস

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন ড. ইউনূস

বিচ্ছেদের জল্পনার মধ্যেই নতুন পদক্ষেপ অভিষেকের!

বিচ্ছেদের জল্পনার মধ্যেই নতুন পদক্ষেপ অভিষেকের!

চাঁদা না দেয়ায় বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর পা ভেঙে হাসপাতালে পাঠালেন বিএনপি নেতা

চাঁদা না দেয়ায় বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর পা ভেঙে হাসপাতালে পাঠালেন বিএনপি নেতা

সাংবাদিক দেওয়ান হাবিব আর নেই

সাংবাদিক দেওয়ান হাবিব আর নেই

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত
নির্বাহী সম্পাদক: এ কে সরকার

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App