ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরি
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইতিহাস হলো যে কোনো দেশ ও জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়, সামনের চলার পথটা নির্মাণ করতে হয়। অতীতের ভুল, ব্যর্থতা, অনিয়ম কিংবা দায়িত্বহীনতার বিষয়গুলো অনুধাবন ও পর্যালোচনা করে নির্মাণ পরিকল্পনা তৈরি ও তার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা লাগে। এর জন্য প্রয়োজন হয় উপযুক্ত মেধা, জ্ঞান ও জনসমর্থনের, আবেগ নয়। ব্যক্তির আবেগ হলো, তার এমন একটি আচরণ, যা তাকে কোনো কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে। যেমন দ্রুত, ঠিক তেমনি কাজটির প্রতি অতি দ্রুত তার অনীহা জাগায়। সাধারণত আবেগের ক্ষেত্রে বোধশক্তি ও যৌক্তিকতা খুব একটা কার্যকর থাকে না, কাজ করে না। ব্যক্তি না বুঝে, শুনেই আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক কিছু করে ফেলতে পারে, করে থাকে। আবেগকে অবদমিত করে রাখা ব্যক্তির পক্ষে অনেক সময় প্রায় কঠিন একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ধরুন, চলার পথে যদি একজন ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির পেছনে দৌড়ে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করে দেয় যে, সে তার মানিব্যাগ ছিনতাই করে পালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কী হতে দেখা যায়? পথে চলাচলকারী অন্য ব্যক্তিরা সেই অভিযুক্ত ব্যক্তির পেছনে ছুটতে থাকে, ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে ধাওয়াকারীরা অভিযুক্তকে ধরে পেটাতে শুরু করে দেয়। পেটাতে পেটাতে অনেক সময় মেরেও ফেলে। সাধারণত এমনটি প্রায়ই হতে দেখা যায়। পথে উপস্থিত ব্যক্তিদের এখানে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের তাড়নার চাইতে অভিযুক্তকে ধরে পেটানোই মুখ্য হয়ে ওঠে। তাছাড়া পথে অত সময় কারইবা থাকে। চিন্তা-শক্তিও থাকে না। তাদের আবেগ কথিত অন্যায় রুখতেই জেগে ওঠে, সক্রিয় থাকে। আর যদি অভিযোগকারী ব্যক্তি অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে একজন নিরীহ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে এমন কাজটি করার পরিকল্পনা করে থাকে, তাহলে কী দাঁড়ায়? পরিষ্কার যে, নিরীহ ব্যক্তিটি উপস্থিত সবার আবেগের নির্মম শিকার হয়ে যায়। অর্থাৎ ব্যক্তির আবেগকে কেউ কেউ তার অসৎ উদ্দেশ্যে বা প্রতিহিংসা হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর কোনো বারতা আনে না, আনতে দেখাও যায় না।
তবে মানবীয় গুণাবলি প্রকাশের জন্য আবেগ লাগে, দরকার হয়। কেউ কাউকে কতটা ভালোবাসে কিংবা ঘৃণা করে তা প্রকাশের জন্য আবেগীয় অভিব্যক্তির বিকল্প নেই, হয় না। হাসি, কান্না, অভিনয় ইত্যাদি সবই আবেগীয় বৈশিষ্ট্য। ভালোর প্রতি আনুগত্য, আসক্তি ইত্যাদি ইতিবাচক আচরণের জন্য আবেগ যেমন কার্যকর থাকে তেমন মন্দের প্রতি আগ্রহ, যেমন প্রতিশোধ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা এসব নেতিবাচক আচরণের জন্য আবেগ কার্যকর থাকে। এক কথায় আবেগ হলো ব্যক্তির এমন এক আচরণ, যা তাকে দৃশ্যমান হতে সহায়তা করে। মেধা ও জ্ঞান ব্যক্তির ভেতর ইতিবাচক আবেগ জাগাতে সাহায্য করে। অপরদিকে নেতিবাচক আবেগের জন্য মেধা ও জ্ঞান খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। তবে মেধা ও জ্ঞান থাকলেই যে একজন ব্যক্তি উন্নত মানসিকতা ও আবেগসম্পন্ন হবে, সেটাও না। শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তির চারিত্রিক কাঠামোর অন্যতম ভিত্তি। কে কীভাবে দেখছে, তার দেখার ওপরই তার শিক্ষার প্রয়োগ ঘটে থাকে। যা হোক, বলছিলাম, ইতিহাসকে উপলব্ধির জন্য আবেগের চেয়ে উপযুক্ত জ্ঞান ও মেধার দরকার পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতার অর্জন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব মানচিত্রে একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমা পেয়েছি। একটা পবিত্র সংবিধান ও পতাকা পেয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে আমাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জন, তা বেমালুম বিস্মৃত হবার অজস্র, অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এসব করেছে এ দেশেরই নাগরিকরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধীষ্ট হওয়ার বাসনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্পষ্ট, বিকৃত করার পাঁয়তারার যে ঘটনা, সেটাও সম্ভব হয়েছে এ দেশের কতিপয় ব্যক্তি দ্বারা, যা কখনোই কাম্য ছিল না। যারা এসব করেছে তাদের একটা পরিকল্পিত উদ্দেশ্য ছিল এবং পরবর্তীতে যারা তাদের এই কাজকে সমর্থন করেছে, তারা যে খুব ভেবেচিন্তে সমর্থন করেছে, তা কিন্তু নয়। বরং এখানে অনেকের ভেতরই আবেগটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। শোনা তথ্য ও গল্পে তারা আবেগপ্রবণ হয়ে নিজের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার অবস্থান তৈরি করেছে।
একটা কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে। আমার বাবা সাংবাদিক আসফ উদ দৌলা রেজা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। সম্বোধন ছিল তুই-তোকারীর, প্রবীণ সাংবাদিকরা সেই বিষয়ে বলেছেন বহুবার। কলকাতার বেকার হোস্টেলে তারা থাকতেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা করতেন। বাবার মুখে শোনা, বন্ধুত্বের সূত্রে তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশে জাতির পিতা হয়ে থাকতে, প্রেসিডেন্ট না হতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন সেই সময়ে। ক্ষমতার চেয়ারে বসে তিনি দেশ পরিচালনার কথা ভেবেছেন। ক্ষমতার বাইরে থেকে তিনি দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ভাবেননি। হয়তো ভাবতে পারেননি। তিনি আমার বাবাকেও বহু প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিভিন্ন পদে আসীন হওয়ার, বাবা বিনয়ের সঙ্গে সেসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবই বাবা ফিরিয়ে দেননি, তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রস্তাবও বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বাবার দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যে, ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা, তা সংরক্ষণের জন্য তার নৈতিক শিক্ষা ও মেধাই ছিল অন্যতম। সঙ্গে ছিল দেশকে ভালোবাসার আবেগ, যেটা দৃশ্যমান হয়েছিল সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার মাঝেই। তিনি আমৃত্যু একজন নির্র্ভীক সাংবাদিক হয়েছিলেন। পদ বা ক্ষমতা তাকে আকৃষ্ট করেনি।
ক্ষমতার চেয়ারে উপবিষ্ট হয়ে তারপর যতগুলো সরকার এসেছে দেশ পরিচালনার জন্য, প্রতিটি সরকারকেই দুঃখজনকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। সামরিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামরিক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা, ওয়ান-ইলেভেনে সামরিক অভ্যুত্থানে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার শাসনামলের পরিসমাপ্তি ঘটে।
প্রতিটি শাসনামলে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে, ঘুরেফিরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক চেতনা ও রাজনৈতিক চর্চাই মুখ্য থাকায় পরিণতি প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক হয়ে গেছে। সব সরকার আমলেই রাষ্ট্রের সব বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে ও হতো, যেন ক্ষমতায় উপবিষ্ট থাকাটা নিরাপদ হয়, নিরাপদ থাকে। শেষ অবদি নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করা হয়নি প্রতিটি সরকার আমলেই, যেখানে সাধারণ জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারত। দলের স্বার্থ, দলীয় লোকের স্বার্থ দেখা হয়েছে অকাতরে। ফলে সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে, হতাশ হয়েছে। হয়েছে বঞ্চিত। জনগণ যেসব ক্ষমতার উৎস ও তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে যে আর ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না, সেই সত্যটা রাষ্ট্র শাসনামলে কোনো সরকারই মনে রাখেনি। শাসনামলের শুরুটা বুঝেশুনে করলেও শেষ অবদি আর ঠিকমতো থাকে না। সোজাকথায়, কোনো সরকারই অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি, করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
ক্ষমতার ভেতর সবাই এমন কিছুর সন্ধান পেয়ে গেছে বা পেয়ে যায় যা তাদের উন্মাদ, উন্মাসিক ও আদর্শচ্যুত করে ফেলে এক পর্যায়ে। ফলে ক্ষমতায় আসীন অবস্থায় কোনো ব্যর্থতার দায়ে কাউকে দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এই চেষ্টা হয়েছে বহু কৌশলে, উপায়ে।
ক্ষমতার প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর মোহটা দেশের প্রতি দায় ও দায়িত্বের চাইতেও বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে, দৃশ্যমান হয়েছে। ইতিহাস বলে, ক্রমেই রাজনীতি হয়ে উঠেছে অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ ও প্রাপ্তির এক অন্যতম মাধ্যম, যেখানে অভিজ্ঞতা, মেধা, যোগ্যতা বা দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে না। শুরুতে শিক্ষিত ব্যক্তিরা রাজনীতিতে আসত, পরবর্তী সময় দেখা গেছে যে শিক্ষা নয়, পেশি, প্রভাব আর চাটুকারিতার প্রয়োজন হয় রাজনীতিতে। বেহিসেবী অর্থ কামাই, ধনসম্পদের মালিক হওয়া যায় অতি অল্প সময়ে রাজনীতিতে। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনটা ছিল উল্লেখ করার মতন একটা আন্দোলন। স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির আপোসহীন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমারও সমর্থন ও শ্রদ্ধা ছিল তার নেতৃত্বের প্রতি। তখনকার ছাত্রনেতাদের প্রতিও ছিল আস্থা। কিন্তু পরবর্তী সময় সেই ছাত্রনেতাদের ভূমিকা হতাশা ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বৈরাচার বিদায় করে নতুন স্বৈরাচারের আবির্ভাবটা মেনে নেয়া একজন সচেতন নাগরিকের পক্ষে কঠিন হয় বৈকি। মনে হয়েছিল, ক্ষমতায় উপবিষ্ট হওয়াটাই আসলে রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হয়। আর রাজনীতির ক্ষমতা সবাইকে ভুলতে সহায়তা করে অতীতকে, অতীত ইতিহাসকে।
পরিশেষে বলব, ইতিহাসকে পাশে রেখে সামনে এগোলে ভালো। এই ভালো দেশ ও দশের।
স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।