×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

নির্বাপিত হোক রাগের আগুন!

Icon

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাপিত হোক রাগের আগুন!

রাগ একটি নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক আবেগ। রাগ থেকেই বিদ্বেষ ও সহিংসতার সূচনা হয়। সভ্যতার শুরু থেকে এই রাগ, বিদ্বেষ ও সহিংসতা মানুষের মাঝে বিরাজ করছে। অনেক সময় আমরা বুঝতেও পারি না যে আমরা রেগে যাই। আবার রেগে গেলেও আমরা রাগকে স্বীকার পর্যন্ত করি না।

মানুষের স্বভাব হলো সুখের অন্বেষণ এবং দুঃখ বর্জন করার উপায় অনুসন্ধান করা। সুখের অন্বেষণ করতে গিয়ে আমরা ভবিষ্যৎকে সব সময় নিজেদের মতো করে প্রত্যাশা করি; কিন্তু প্রত্যাশা সব সময় পূরণ হয় না। আর প্রত্যাশা পূরণ না হলে রাগ করি। রাগের নেতিবাচক শক্তি ভাবনার উসকানিতে জ্বলে ওঠে। ভাবনার উসকানি কখনো খুব স্পষ্ট আবার কখনো দুর্বোধ্য এবং বিভ্রান্তিকর হয়। ধরা যাক, আপনার খিদে পেয়েছে। আপনি একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাবার অর্ডার করলেন। কিন্তু ওয়েটার খাবার পরিবেশন করতে দেরি করছে। এদিকে আপনার খিদেও বাড়ছে। আপনি খেতে চাইছেন কিন্তু খাবার আসছে না। এ অবস্থা আপনার মধ্যে রাগ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ আপনি যা চাইছেন বা প্রত্যাশা করছেন সেটি পাচ্ছেন না। সে কারণে আপনি রাগ করতে পারেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভাবনার উসকানিটা বোঝা সহজ। কিন্তু অনেক সময় আমাদের অহমের চাওয়াকে সহজে বোঝা যায় না। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, আমরা খাবার শেষে মিষ্টিও খেতে চাই আবার ওজনও কমাতে চাই। আমাদের দুটো চাওয়া পরস্পরবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। মিষ্টিও খেতে চাইছি আবার ওজনও কমাতে চাইছি। পরস্পরবিরোধী চাওয়া আমাদের মাঝে দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি করে। দ্ব›দ্ব বা বিরোধ মানুষের মাঝে অসহায়ত্ব সৃষ্টি করে। অসহায় অবস্থা থেকে বেরোতে না পেরে মানুষ রাগে ফেটে পড়ে।

রাগ, বিদ্বেষ এবং সহিংসতা আমাদের প্রাণশক্তির নেতিবাচক প্রকাশ ঘটায়। রাগের নেতিবাচক আবেগকে বোঝার জন্য আমাদের মনোযোগকে অন্তর্মুখী করতে হবে। কিন্তু আমাদের মনোযোগ সব সময় বহির্মুখী অবস্থায় বিরাজ করে। সেজন্য গ্রিক দর্শনে নিজেকে জানার কথা বলা হয়েছে। যখন আমরা রাগ করি তখন আমরা সাধারণত বাইরের জিনিসগুলোকে দোষারোপ করি। বাইরের ঘটনাগুলো উসকানি প্রদান করে; কিন্তু রাগ সৃষ্টি হয় আমাদের অন্তর্জগতে। সে কারণে অন্তর্জগতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই কেবলমাত্র আমরা আমাদের রাগকে সামলাতে পারব।

রাগ আমাদের মনের মধ্যে দুই ধাপে সম্পন্ন হয়। রাগ সৃষ্টি হওয়ার প্রথম ধাপে আমরা আহত বোধ করি। কারো কথা, আচরণ, কোনো ঘটনা বা কোনো পরিস্থিতি আমাদের মানসিকভাবে আহত করে। আহত হওয়ার ফলে আমরা মনে মনে একটু ব্যথা অনুভব করি। এই ব্যথাটা কিন্তু শারীরিক নয়, মানসিক। কারণ আপনি কিছু পেতে চেয়েছিলেন; সেই চাওয়াটা পূরণ হয়নি। তাই আপনি মনে মনে একটু ব্যথা অনুভব করছেন। এই যে আপনি মনে মনে একটু ব্যথা অনুভব করছেন এটিকে বলা যেতে পারে রাগের জ্বালানি বা ফুয়েল।

রাগের দ্বিতীয় উপাদান হলো পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন বা আপনার ভাবনা। এ উপাদানকে বলা যেতে পারে ম্যাচ স্টিক বা দেয়াশলাইয়ের কাঠি। এককভাবে শুধু জ্বালানি অথবা শুধু দেয়াশলাইয়ের কাঠি আগুন ধরাতে পারে না। আগুনের জন্য জ্বালানি এবং দেয়াশলাইয়ের কাঠি দুটিরই সমন্বয় প্রয়োজন।

একটা উদাহরণ দিয়ে আমরা বিষয়টিকে পরিষ্কার করতে পারি। ধরা যাক, ভীষণ রকম ব্যস্ত দিন শেষে দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে আপনি ঘরে ফিরেছেন। আপনি খেয়াল করলেন যে, আপনার মাথাটা ব্যথা করছে। আপনি একটু বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ সময় আপনার ১০ বছরের মেয়েটি আপনাকে বারবার বলতে শুরু করল, ‘বাবা বাজারে চলো! জামা কিনে দেবে বলেছিলে!’ মেয়েটি জেদ করছে এবং কান্নাকাটি করছে। এটিকে আমরা বলতে পারি রাগের জ্বালানি।

মেয়েটির জেদ অথবা কান্নাকাটি এককভাবে কিন্তু আপনার মধ্যে রাগ সৃষ্টি করতে পারবে না। রাগের আগুন জ্বালানোর জন্য আপনার একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি লাগবে। এ রকম অবস্থায় আপনি যখনই ভাবতে বসলেন বা বিশ্লেষণ করলেন যে, মেয়েটির কোনো বিবেচনাবোধ নেই! আমি যে এত ক্লান্ত সেটি সে বুঝতেই চাইছে না! এই ভাবনাটিই হলো দেয়াশলাইয়ের কাঠি। এই ভাবনা রাগের জ্বালানিকে প্রজ¦ালিত করবে।

আপনি প্রথমে মানসিকভাবে আহত হয়েছেন। মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন। তারপর ভাবনা-চিন্তা আর বিশ্লেষণ করে ঠিক করেছেন যে, এই কষ্টের কারণ কে হতে পারে। কে আপনার কষ্টটাকে আরো বাড়াচ্ছে? তারপরে দেখা গেল আপনি গলা চড়িয়ে চিৎকার করছেন এবং আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে রাগের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ঘটনা নয় ঘটনার বিশ্লেষণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ঘটনা বা পরিস্থিতির ওপরে আমাদের সাধারণত কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কোনো একটি বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিণতি কী হবে সেটি নির্ভর করে সেই ঘটনা বা পরিস্থিতিকে আমরা কীভাবে বিশ্লেষণ করছি তার ওপরে। এই বিশ্লেষণটা হলো আপনার ভাবনা। কিন্তু আমাদের মনোযোগ সব সময় বাইরের দিকে নিবব্ধ থাকে বলে অন্তর্জগতে চলতে থাকা ভাবনার স্রোত আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। পর্দার অন্তরালে চলতে থাকা এই ভাবনা বা বিশ্লেষণ নির্ধারণ করে যে, পরিণতিটা কী হবে। অর্থাৎ যে কোনো পরিস্থিতি কী পরিণতি সৃষ্টি করবে তা নির্ভর করে আমাদের ভাবনার ওপরে। ঘোলা পানিতে যেমন কিছু দেখা যায় না তেমনি রাগের অনুভূতিতে আপনি যখন প্লাবিত হচ্ছেন তখন রাগের কারণকে আপনি সহজে চিহ্নিত করতে পারবেন না। ভাবনার স্রোত বইছে আমাদের মনের অন্তরালে। আর এই ভাবনা অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। আর অনুভূতি আমাদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। তাহলে আমরা বলতে পারি যে, আমাদের ভাবনাই মূলত আমাদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। রাগের অনুভূতিগুলো রাগের মুহূর্তে এতটা প্রবল আকার ধারণ করে এবং এতটা আবেশ সৃষ্টি করে যে, মানুষ তখন রাগের অনুভূতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সেজন্য রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাগের ভাবনা এবং রাগের অনুভূতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে শেখা। মেডিটেশন বা ধ্যানে আমরা মূলত আমাদের ভাবনা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করি। রাগের ভাবনা আসতেই পারে; আমাদের অন্তর্জগতে রাগের অনুভূতি সৃষ্টি হতেই পারে; কিন্তু আমরা রাগের ভাবনা বা অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে যেতে চাই না, প্রতিরোধ করতে চাই না বা ঠেলে সরাতেও চাই না। আমরা রাগের ভাবনা বা অনুভূতিকে অনুভব করব, স্বীকৃতি দেব এবং তারপরে চলে যেতে দেব। রাগের অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে ঝুলে থাকব না।

যখন বুঝতে পারলেন যে, আপনি রেগে যাচ্ছেন তখন একটা লম্বা একটা দম নিন। নিজেকে প্রশ্ন করুন এমন কিছু কি ঘটেছে, যা আমাকে আহত করছে? আপনি দেখবেন আপনি আহত হননি। কিন্তু আপনি আহত বোধ করছেন। তাহলে ব্যথাটা লাগছে কোথায়? উত্তর খুঁজতে গেলে দেখবেন যে, আপনার ভাবনা আহত হয়েছে। আপনি আহত হননি। আপনার ভাবনাটা কল্পনা বা মিথ্যা। কিন্তু আপনি সত্য।

তারপরে নিজেকে প্রশ্ন করুন এই মুহূর্তে আমার প্রত্যাশা কী? আমি আসলে কী পেতে চাইছি? আর যা পেতে চাইছি তা কতখানি যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত। আপনি খেয়াল করলেই দেখবেন, আমাদের যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবসম্মত চাওয়া খুব কম থাকে। হতে পারে কোনোটা যুক্তিসঙ্গত আবার কোনোটা বাস্তবসম্মত। কিন্তু একই সঙ্গে যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তবসম্মত চাওয়া খুব কম থাকে। রাগের মুহূর্তে আমাদের প্রত্যাশা সম্পর্কে সচেতন হয়ে আমরা রাগকে সহজেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারি। কারণ অধিকাংশ সময় এই বিশ্লেষণটুকু না করে আমরা রাগের আগুনে ঘি ঢেলে দিই।

রাগ মুক্তির জন্য আমাদের ক্ষমা করতে শিখতে হবে। একমাত্র ক্ষমার মাধ্যমেই আমরা রাগের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি। যখন একজন মানুষ ক্ষমা করে তখন সে তার প্রাণশক্তিকে ধ্বংসাত্মক আবেগ তৈরির বদলে দেহে সুস্থতা ও নিরাময়ের প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করার কাজে ব্যবহার করতে পারে। এভাবে ক্ষমা করার মাধ্যমে একজন মানুষ তার প্রাণশক্তিকে পুনরুদ্ধার করে।

রাগকে ব্যাহত করার জন্য হাসি দারুণ কাজ করে। রাগ করে হাসা যায় না আবার হাসতে হাসতে রাগ করা যায় না। তাই হাসতে চেষ্টা করুন। রাগের প্রকোপে আমাদের অন্তরের সৌরভ চাপা পড়ে গিয়েছে। রাগ একটু একটু করে পোড়াচ্ছে আমাদের সুকোমল বৃত্তিগুলোকে। তাই আমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে আমরা আমাদের রাগ এবং বিদ্বেষ এড়াতে নিজেরাই ভূমিকা রাখতে পারি।

আসিফ হাসান চৌধুরী : পিএইচডি; মলিকুলার বায়োলজি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

হঠাৎ আলোচনায় জেসিয়া ইসলামের গ্ল্যামার, সমালোচনা ও ব্যক্তিগত জীবন

হঠাৎ আলোচনায় জেসিয়া ইসলামের গ্ল্যামার, সমালোচনা ও ব্যক্তিগত জীবন

উত্তাল সাগরে ২১ ট্রলার ডুবে জেলে নিখোঁজ

উত্তাল সাগরে ২১ ট্রলার ডুবে জেলে নিখোঁজ

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বন্ধে এবার রাশিয়ার উদ্যোগ!

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বন্ধে এবার রাশিয়ার উদ্যোগ!

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আজ

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আজ

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App