বে-টার্মিনাল নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত
মিঞা জামশেদ উদ্দীন
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বব্যাংকের কথা বললেই যেন নড়েচড়ে উঠতে হয়। অনেকটা আঞ্চলিক প্রবাদ বাক্যের মতো- ‘যার মাকে কুমিরে খাইছে, সে ঢেঁকি দেখলে ভয় পায়।’ যদিও বিশ্বব্যাংক আগের জায়গা থেকে সরে এসেছে, তারা অনেকটা নমনীয় মনে হয়; নতুন করে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী এবং ঋণের প্রস্তাবনাও রয়েছে বড় অঙ্কের- চট্টগ্রাম বন্দরের মেগা সম্প্রসারণ প্রকল্প বে-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৬৫০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৬৫ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। যা দেশীয় মুদ্রায় ৭ হাজার ৬৩৮ কোটি ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। গত ২৯ জুন ব্যাংকটির বোর্ড অব এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরস এই ঋণ অনুমোদন দেয়। সরকারেরও এ প্রকল্পের আওতায় দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল, একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং একটি তেল ও গ্যাস টার্মিনাল-উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংক বে-টার্মিনাল, মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে অর্থায়নের যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল, ওই প্রকল্পের অধীনে সমুদ্র স্রোত ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া থেকে বন্দরকে রক্ষা করতে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে জলবায়ুসহিষ্ণু বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া প্রকল্পের অংশ হিসেবে বন্দরের প্রবেশদ্বার, অববাহিকা ও সংযোগ-চ্যানেলগুলো খনন করা হবে। এতে আরো বলা হয়, এই বে-টার্মিনালের মাধ্যমে প্যানাম্যাক্স জাহাজের মতো বড় আকারের জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করতে পারবে। সেই সঙ্গে এসব জাহাজে মালামাল ওঠা-নামার সময়ও কমবে। ফলে প্রতিদিন আনুমানিক ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে।
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ট্রান্সপোর্ট স্পেশালিস্ট এবং প্রকল্পপ্রধান হুদা টান বলেন, বে-টার্মিনাল বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর অবকাঠামো আধুনিকায়ন এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর সংযোগ উন্নত করতে অবদান রাখবে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বন্দর কর্তৃপক্ষ বে-টার্মিনালের যে পৃথক চারটি টার্মিনাল নির্মাণ করার কথা ছিল, এর মধ্যে সেগুলোরও পরিবর্তন এসেছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মাল্টিপারপাস টার্মিনালটি নির্মাণ ও পরিচালনা করবে আবুধাবি পোর্টস গ্রুপ। দ্বিতীয় টার্মিনাল পিএসএ সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগে নির্মাণ- পরিচালনার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তৃতীয় টার্মিনালটি আমিরাতভিত্তিক আরেক প্রতিষ্ঠান, ডিপি ওয়োর্ল্ডোর মাধ্যমে নির্মাণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চতুর্থ টার্মিনালটি হবে তেলভিত্তিক বা ট্যাঙ্ক টার্মিনাল। সেটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টকোস্ট গ্রুপ।
এর মধ্যে বন্দরের বে-টার্মিনালের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে আবুধাবি পোর্টস গ্রুপ। ১৬ মে ঢাকার একটি হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল এবং আবুধাবি পোর্টস গ্রুপের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার আল মাজরুই সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এই বে-টার্মিনাল বাংলাদেশের মোট কন্টেইনারের ৩৬ শতাংশ হ্যান্ডলিং করবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা।
২০১২ সালের প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক) ও জাইকা (জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা) পদ্মা বহুমুখী সেতুর ঋণের প্রস্তাবনা স্থগিত করে, সে কথা আমাদের সবার জানা আছে- হঠাৎ করে প্রকল্পটি দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে। বলতে হয়, অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ। বিষয়টি এখানে যে শেষ হয়েছে তা নয়, সঙ্গে প্রকল্পের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এবং কানাডার আদালতে একটি মামলাও দায়ের হয়। শেষতক সরকারকে আইনগত লড়াই চালাতে হয়। একই সঙ্গে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করতে হয়, কয়েকজনকে জেলে যেতে হয় এবং তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকেও পদত্যাগ করতে হয়। অবশ্য এ মামলায় সরকার নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পান। কিন্তু পদ্মা সেতুর বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে থুবড়ে পড়ে। এরপর সরকার বহু চেষ্টা করেও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারেনি। সর্বশেষ মালয়েশিয়াকে আহ্বান করা হয়। তাদের ছিল উচ্চহারে সুদ। সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অবশেষে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে সিদ্ধান্ত হয়। অবশ্য পদ্মা সেতু নিয়ে ৯ জুলাই ২০১২ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায় একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। আমার শিরোনাম ছিল ‘পদ্মা সেতুর ফাঁদে সরকার’। বিশ্লেষণধর্মী এ কলামে লেখা হয়- দুর্নীতির দায়ে পদ্মা সেতুর ঋণের প্রস্তাবনা-চুক্তি বাতিল হলো। বিশ্বব্যাংকের এসব কথা খুবই স্পর্শকাতর ছিল; বিষয়টি সত্য প্রমাণে বিশ্বব্যাংক মরিয়া। তারা সেবা খাত হিসেবে এটি নির্মাণ করতে চেয়েছে- তারা এ বলে জোর দাবি করে আসছে, তাদের সুদের হার সর্বনিম্নে দশমিক পঁচাত্তর শতাংশ। শেষতক সরকার মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতে বাধ্য হয়। কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রস্তাবনা ঋণের সুদের হার তিন শতাংশ, যা বিশ্বব্যাংকের চাইতে অপেক্ষাকৃত বেশি।
পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্পের অর্থায়ন ষাট শতাংশ নয়, শতভাগ নিজস্ব তহবিলে করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়ে ৩২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা দাঁড়ায়। তবে এ নির্মাণযজ্ঞের শেষে এ প্রকল্পের সাশ্রয় হয় ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। মূল সেতুর ব্যয় ১৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এ খাতে সাশ্রয় হয় ৫২৬ কোটি টাকা। নদী শাসনে ১৭১ কোটি ২৭ লাখ ব্যয় হয়। গত ৫ জুলাই প্রকল্পের সর্বশেষ সমাপনী অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ওপর প্রভাবশালী দেশগুলো খবরদারি করার মানসিকতা বদলে দিয়েছে। তিনি বলেন, তাদের সেই মানসিকতা বদলে গেছে, এখন বাংলাদেশ শুনলে সমীহ করে আন্তর্জাতিকভাবে। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, অনেক ঝড়-ঝাপটা পার করে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ জনগণের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
এ বিষয়টি বিলম্বে হলেও বিশ্বব্যাংক অনুধাবন করতে পেরেছে। তারপরও বলতে হয়, সাবধানের মার নেই, এ মারেরও দণ্ড নেই! তবে বিপরীতে দেশের লক্ষ্যমাত্রা ও সক্ষমতাও বেড়েছে! সঙ্গে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সম্প্রসারিত তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, সড়ক ও মেট্রোরেল, ফার্মগেট থেকে উত্তরা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলযোগাযোগ, লালখান বাজার থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করাসহ আরো একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
অবশ্য পদ্মা সেতু নির্মাণ করা চাট্টিখানি কথা নয়, অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে শেষ করা গেছে এ প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পের টোল আদায় থেকে আশারূপ রাজস্ব আয় হয়। পদ্ম সেতু প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত আয় হয় ২ হাজার ৬৩১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে জিডিপির দিকটাও দেখতে হয়। কোনোভাবেই একবার পিচ্ছিল খেলে ঘুরে ওঠা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। যদিওবা বলা হচ্ছে, স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার। এবার দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব আয় হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরভিত্তিক কাস্টমস হাউস থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এ পরিমাণ বিগত অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬১ হাজার ৩৫০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়। দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয়ে আসছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ নয়, এ হার বেড়ে হবে ৪০ শতাংশেরও ওপরে। এ ক্ষেত্রে আরো নজরদারি বাড়াতে হবে। সঙ্গে রাজস্ব আয়ও বাড়বে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। দুর্নীতি সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আয়ের বহির্ভূত সম্পদ অর্জন বাজেয়াপ্ত করতে হবে, দৃষ্টান্তস্বরূপ। তবে বিদেশি কর্মজীবী থেকে যে রেমিট্যান্স পেয়ে আসছে- বিশ্বের নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলো মধ্যে শীর্ষ ১০ রেমিট্যান্স প্রাপ্তি দেশের মধ্যে সপ্তম বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয়।
মোদ্দাকথা, বন্দরকে হাতছাড়া করা যাবে না- দেশের রাজস্ব আয়ের সর্বোচ্চ এবং একমাত্র স্থল হলো চট্টগ্রাম বন্দর। এটি হাতছাড়া হলে দেশের আত্মসামাজিক, রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ডভাবে প্রভাব পড়বে। অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। তবে চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা হোক, জনগণও তা চায়। কিন্তু এভাবে নয়, প্রয়োজনে নিজেদের অর্থায়নে করা হোক। শর্তসাপেক্ষে এবং চড়াসুদে বা বন্ধকী অবস্থানে থেকে বে-টার্মিনাল নির্মাণ করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না- খুব একটা তাড়াহুড়ো না করে, ধীরস্থিরভাবে উন্নয়ন করা শ্রেয় মনে করে জনগণ। অথচ প্রকৌশলগত দিক থেকে অনগ্রসর বা অখ্যাত প্রতিষ্ঠান হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বে-টার্মিনাল নির্মাণে;
কর্তৃপক্ষের বরাতে জানা যায়, প্রস্তাবিত এ বে-টার্মিনাল নির্মাণ হলে ৬০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানিসহ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং নিয়ন্ত্রিত হবে; কার্যত বন্দর পুরোটাই অনিয়ন্ত্রিত-অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এখন সময়ে দাবি, পদ্মা সেতুর মতো চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনালসহ অপর চারটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হোক নিজস্ব অর্থায়নে। প্রয়োজনে ধাপে ধাপে বরাদ্দ বাড়ানো হোক। তবুও জনগণের অর্থে নির্মাণ করা হোক- এতে পদ্মা সেতুর মতো জনগণ একদিন সুফল পাবে। তাতে এটি হবে স্বাধীনতা-উত্তর সর্ববৃহৎ দৃষ্টান্ত।
মিঞা জামশেদ উদ্দীন : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক
(কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।