রাশিয়া-বাংলাদেশ বাণিজ্য কূটনীতি ও সম্পর্কোন্নয়ন
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসীন হয়ে প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্প্রতি সাক্ষাৎ করেন। সেখানে রাশিয়া থেকে জ¦ালানি তেল আমদানির বিষয়ে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্ব›দ্বকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে যে মেরুকরণ চলছে, ভারত সেখানে যুক্ত হতে চায় না বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। বিশ্বের মোট আবাসযোগ্য জমির আট ভাগের এক ভাগ অংশজুড়ে রাশিয়া। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে ১১৮ গুণ বড় এই দেশটি। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ার দূরত্ব প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটার। রাশিয়া বিশ্বের সর্বোচ্চ তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ এবং পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্যতম। নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াতে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবসান হয় এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ লাভ করে। সত্তরের দশকের শুরুতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ও যুদ্ধের পর দেশ পুনর্গঠনে সাহায্যের হাত সম্প্রসারণ করেছিল। বাংলাদেশকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া প্রথম দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া ছিল অন্যতম। ১৯৯১ সালে রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ।
স্বাধীনতাযুদ্ধের পর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে যেসব মাইন ও ডুবে যাওয়া জাহাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে গিয়েছিল, সেগুলো বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে অপসারণ করে সোভিয়েত নৌবাহিনী। এরই ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারের পুরো সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে। সোভিয়েত বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে নির্মিত হয় আমাদের দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার প্রতিষ্ঠিত পথে দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মৌলিক নীতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে দুই দেশ পারস্পরিকভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটম। রোসাটমের অংশগ্রহণেই পাবনা জেলায় নির্মিত দেশের বৃহত্তম যৌথ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এখানে দুটি ইউনিটে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই প্লান্টের প্রায় ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির জন্য রাশিয়া ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় ওয়ারশ চুক্তি ভেঙে গেলে পশ্চিমারা প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল ন্যাটোর সম্প্রসারণ বিষয়ে তারা সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর দিকে অগ্রসর হবে না। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়াতে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি উত্থাপিত হয়। ইউক্রেনের অধিকসংখ্যক মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলে। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব ও রুশভাষীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলোনেস্কি এই চুক্তি অমান্য করেন। রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনের এই দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং সেখানে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে আগ্রাসন শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানসহ আরো কয়েকটি দেশ ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার ওপর রেকর্ডসংখ্যক পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ার প্রথম সারির কয়েকটি ব্যাংকের ওপর সুইফট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয়। সুইফটের পর ভিসা ও মাস্টারকার্ড লেনদেন বন্ধ করে এবং পৃথিবীর অন্যতম বড় শিপিং কোম্পানি মার্ক রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে তেল কিনবে না বলে ঘোষণা দেয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আকাশপথ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। রাশিয়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ ৩২ দেশকে আকাশপথ ব্যবহারে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। এতসব বড় ধরনের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২০২৩ সালে রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বেকারত্বের হার ছিল ৩ শতাংশ, প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বিশ্বজুড়ে যেসব ভোজ্যতেল ব্যবহার হয় তার মধ্যে সানফ্লাওয়ার তেল প্রায় ১৩ শতাংশ। এর প্রায় ৭৫ শতাংশই আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বিশ্ববাজারে সিংহভাগ সার রপ্তানির ক্ষেত্রে অগ্রগামী দেশ হচ্ছে রাশিয়া ও বেলারুশ। রাশিয়ায় বর্তমানে ৭০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। অন্যদিকে আমদানি করে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের পণ্য। দেশের সামগ্রিক আমদানি-রপ্তানির বিচারে এই পরিমাণটি অনেকটা অপ্রতুল। চীন বা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বছরে যে পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি করে তার দশ ভাগের এক ভাগ করে রাশিয়ার সঙ্গে। জিডিপির আকার অনুযায়ী রাশিয়া বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম দেশ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম ও তুলা সরবরাহ করে রাশিয়া। সারা দুনিয়ায় ব্যবহৃত প্রতি দশ ব্যারেল তেলের এক ব্যারেল উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। বাংলাদেশে বছরে ২০ লাখ টনের মতো ভোজ্যতেল লাগে। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদন হয় তিন লাখ টনের মতো। চাহিদার বাকি নব্বই শতাংশ পূরণ হয় আমদানি থেকে।
বাংলাদেশের রেডিমেড গার্মেন্টস পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে রাশিয়াতে। অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ব্যবসার নতুন উৎস খুঁজে বেড়াচ্ছে দেশটি। তবে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক নানাবিধ জটিলতার মাধ্যমে রাশিয়ার বাজারে পাঠাতে হচ্ছে। বর্তমানে রাশিয়ার বাজারে সরাসরি বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির সুযোগ নেয়। ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করতে না পারা এবং আরো কিছু শুল্ক জটিলতার কারণে অন্য দেশের মাধ্যমে রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে। এতে রাশিয়ার বাজারে বাণিজ্য আশা অনুযায়ী বাড়ছে না। বাংলাদেশ রাশিয়াসহ ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন ও সিআইএসভুক্ত অন্যান্য দেশে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে আগ্রহী।
রাশিয়া-বাংলাদেশ দুই দেশের আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য প্রয়োজন। বর্তমানে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের সঙ্গে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা সরাসরি বিনিময় করা যায় না। এক্ষেত্রে ইউরো বা ডলারের মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করতে হয়। এতে একদিকে খরচ যেমন বেশি হচ্ছে, তেমনি সময়ও লাগছে বেশি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিনিময় হার চালু করতে চায় বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা নেই, প্রতিদ্ব›িদ্বতাও নেই। বরং সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এগোতে চায় বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে অতি পুরনো পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমানে রাশিয়াসহ কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটসের (সিআইএস) রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ দেশকে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে পারে।
রাজীব পারভেজ : কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।