যানজনে জলেও জ্বলে
মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জনজটের মাঝে যানের জট। তার ওপর জলের জট। ৬ ঘণ্টা সময়ে ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি মানে প্রায় সোয়া ৫ ইঞ্চি। ঢাকা কেন, বিশ্বের যে কোনো শহরের জন্য এত অল্প সময়ের এই বৃষ্টির পানি সামলানো কঠিন। বিশ্বের নামকরা অত্যাধুনিক দুবাই শহরে কিছুদিন আগে প্রায় এমনই হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। এরপরও মাঝেমধ্যে জলাবদ্ধতার পর ‘ঢাকায় আর জলাবদ্ধতা হবে না’- এমন ওয়াদা কেন দেন জনপ্রতিনিধিরা? দেখান স্বপ্ন? জলজট-যানজটের ওপর জনজটের মতো দুঃসহ ভোগান্তির মাঝে এ ধরনের প্রতিশ্রæতি কি জরুরি? নাকি বেহুদা স্মার্টনেস দেখান? এর মধ্য দিয়ে কি নিজেরাই নিজেদের ফেলনা করছেন না? হচ্ছেন না ট্রল আইটেম।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজধানীতে এবারের মতো এত বেশি জলাবদ্ধতা আর দেখা যায়নি। শুক্রবারের মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহর তলিয়ে জলাবদ্ধতার জন্য একদিন পর শনিবার দুঃখ প্রকাশ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কেনই বা খামাখা বাহাদুরি, আবার দুঃখ প্রকাশ? সেই সঙ্গে সংস্থাটি গত ৪ বছরে ৩৬০ কোটি টাকা জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় করলেও এখন সমন্বয়হীনতার দিকে আঙুল তুলেছে। আর দায়ী করেছে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পলিথিনকে। মাত্র দুমাস আগে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, তার এলাকায় জলাবদ্ধতা হবে না। এই সক্ষমতার বাহাদুরির মাঝেই ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি ও বর্ণনাতীত জলাবদ্ধতার নজির।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাস্তা মেরামত কাজে বরাদ্দকৃত অর্থের ৩০ শতাংশ ব্যয় হয় ড্রেনেজের কাজে। সেই সঙ্গে আলাদাভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রতি বছর কম হলেও প্রায় ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। জলাবদ্ধতা দেখা দেয়ায় এখন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জলাবদ্ধতা আর দেখতে হবে না- এমন বাগাড়ম্বর প্রতি বছর দেখানোর মানে কি? সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, অন্যদের কারণে সৃষ্ট সমস্যা করপোরেশনের কাঁধে তুলে দেয়া উচিত নয়। তাহলে কার কাছে সমস্যার সমাধান চাইবে নগরবাসী? সেই ‘অন্যরাই’ বা কে? কী পরিমাণ বৃষ্টি মোকাবিলার সক্ষমতা ঢাকা দক্ষিণ সিটির রয়েছে, তাও জানানো হচ্ছে না।
এমনিতেই তাপদাহের তীব্রতা, শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন, শিক্ষকদের পেনশনের আন্দোলন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার তোড়, নদী ভাঙন, নিত্যপণ্যের দহন। তার ওপর জনজট, যানজটের রাজধানীতে জলজটের জ¦ালা। সময়টাও ঘটনাময়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মাঝে উল্টো রথযাত্রা, তাজিয়া মিছিলসহ বেশকিছু কর্মসূচিতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ঘাম ছুটছে ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির। এমন একটা সময়ে নাহালত সবারই। কী দুর্গতিটাই না গেছে শুক্রবার দিনটিতে!
ভারি বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রাজধানীর কোনো এলাকাই এবার রক্ষা পায়নি। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরসমান। অনেক এলাকায় বিকল হয়ে পড়ে যানবাহন। এসবের যাবতীয় কারণ বিদ্যমান। বৃষ্টি প্রাকৃতিক। বৃষ্টির পানি আটকে জলজটের আজাব মোটেই প্রাকৃতিক নয়। অনেকটাই মনুষ্যসৃষ্ট। বাতকেবাত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের পরিমিতিবোধহীন বৃষ্টিকে দোষ দিয়ে সাময়িকভাবে আমরা স্বস্তি বোধ করি।
বৃষ্টিকে কান ধরে পরিমিতিবোধে আনা যায় না। দিনের বা সপ্তাহের কোন দিন কতটুকু ঝরবে, সেই রুটিন মানতে বাধ্য করার সাধ্য কারো নেই। বৃষ্টির আবার বেচারা দশা। হলেও দোষ, না হলেও দোষ। বৃষ্টির পানিকে আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। সেই কর্তৃপক্ষও আছে। তারা পুকুর কাটা, জলাশয় সাফ করা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতিসহ নানা কিছু শিখতে বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয়ে কত দেশ সফরে যান। দেশে ফিরে কী করেন? সেই অভিজ্ঞতা কোথায় ফলান? তারা কোথাও কি দেখেছেন- নগরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যকর না করা, রাস্তা মেরামত না করা, যানজট ও যেখানে সেখানে বাস দাঁড়িয়ে রাখার স্বাধীনতা, পার্কিং ছাড়া ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া, ব্যক্তিমালিকানায় গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি হতে দেয়া, যখন-তখন একজন-দুজন ভিআইপি যাবেন বলে দীর্ঘ সময় হাজার হাজার ভিআইপির চলাচলের পথ বন্ধ রাখা? এগুলো একটা শহরকে ‘শহর’ হিসেবে বাসযোগ্য করার ন্যূনতম পূর্বশর্ত। এসব শর্ত ঠিক আছে রাজধানী ঢাকায়?
চার বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত চার বছরে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে খরচ করেছে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা। আর উত্তর সিটি প্রায় ৩৭০ কোটি টাকা। দুই সিটির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আগের চেয়ে ঢাকার জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। সেই উন্নতির নমুনা তো আনুষ্ঠানিক দেখেছে মানুষ। জলাবদ্ধতা হলে দুই সিটি যা করে তা একেবারেই সাময়িক ব্যবস্থা। এটি সমাধান নয়। দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ ছাড়া ঢাকার জলাবদ্ধতার ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে করা মহাপরিকল্পনাকে গুরুত্ব না দিয়ে আচ্ছা মতো টাকা খরচ করছে তারা। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ওয়াদা তারা ঠিক মতোই দেন। বরাদ্দও পান বিশাল বিশাল অঙ্কের।
২০২১ সালের আগে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ অন্যান্য সংস্থার হাতে। তখনো মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাস্তাগুলো হয়ে যেত নদীপথের মতো। তখন কথা উঠত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে না থাকায় জবাবদিহিতা নেই জলাবদ্ধতা নিয়ে। তাই সরকার ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওয়াসার অধীনে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর দুই সিটি করপোরেশন সময়ে সময়ে খাল উদ্ধারে তৎপর হয়। এ খাতে বিগত অর্থবছরগুলোতে পৃথক বরাদ্দও রাখা হয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত ৪ বছরে ব্যয় করেছে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই সিটি করপোরেশন প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে। ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়ার পর খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কারের কাজ করছে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ। ফলাফল? পরিস্থিতি বুঝতে মস্ত নগরবিদ হওয়া লাগে না। শুধু কিছু খাল-ড্রেন পরিষ্কার রাখলেই জলাবদ্ধতার সমাধান হবে না। বৃষ্টির পানি নর্দমা হয়ে খালের মাধ্যমে নদীতে যাওয়া পর্যন্ত কয়েকটি ধাপ আছে। বৃষ্টির পানি নালার ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনার মাধ্যমে সড়কের নিচে পানিনিষ্কাশনের নালায় যায়। বহু ক্যাচপিট এবং নালার মুখ বন্ধ অনেক দিন থেকে। সেগুলোর অবস্থা করুণ। খালের তলায় মাটি জমে গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। তা নিরসনে খরচ কম হয়নি। জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল ও নালা পরিষ্কারের মতো কিছু নিয়মিত, প্রাথমিক ও ছোট কাজ আছে। বড় বড় অঙ্কে এ ছোট কাজগুলো সিটি করপোরেশন নিয়মিতই করে। যেমন শান্তিনগর ও এর আশপাশের এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি। শুক্রবারের বৃষ্টিতে রাজারবাগ, মালিবাগ, শান্তিনগর এলাকার দশা ওইপথের পথিক বা যাতায়াতকারীরা দেখেছেন। আর এসব এলাকায় বসবাসকারীরা ভুগেছেন নারকীয় আজাব। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই বছর আগে প্রায় ২১ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। শুক্রবারের বৃষ্টিতে প্রায় ৮ ঘণ্টা ডুবে ছিল এই এলাকাসহ আশপাশ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চারটি খালের সৌন্দর্যবর্ধনে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন পায়। ৮৯৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুনে। ঠিকমতো কাজ শুরু হওয়ার আগেই ২১ মাস পেরিয়ে গেছে।
এত এত বরাদ্দ ও উন্নয়নযজ্ঞের পরও ঢাকায় কেন এমন জলাবদ্ধতা? কেনইবা রাস্তার পানি সরতে এত দীর্ঘ সময় লাগছে? যথাযথ জায়গা থেকে যথাযথ জবাব নেই। জবাব এক সিটির দুই করপোরেশন কর্তৃপক্ষের অবশ্যই জানা। কোন কোন পয়েন্টে জলাবদ্ধতা বেশি হচ্ছে তাও জানা। কীভাবে এর সমাধান করতে হবে সেটিও চিহ্নিত করা হয়েছে। সেইদৃষ্টে বরাদ্দ ঠিক থাকলেও কাজ কই? শুক্রবার বৃষ্টি শুরু হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে জানানও হয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রকৌশল বিভাগের ১০০ টিম মাঠে কাজ করছে। দ্রুত পানি অপসারণে তারা রাস্তায় থাকা ম্যানহোলের ঢাকনা ও ড্রেনের মুখ পরিষ্কার কাজ করে তারা। উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছে তাদের ৫ হাজারের অধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করছে। এছাড়া ১০টি অঞ্চলে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে। এতা কাজ করে থাকলে কেন এ দশা? গত ৪ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭৩০ কোটি টাকা খরচে কী বরকত মিলল একটু পরিষ্কার করে জানাতেও মানা?
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।