×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না

Icon

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না

বিশ্বসভ্যতা ও মানবেতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে পবিত্র আশুরা। সৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কারবালা প্রান্তরে ফোরাতের তীরে ৬১ হিজরির ১০ মহররম তারিখে সংঘটিত পৈশাচিক, মর্মন্তুদ ও বিয়োগান্ত ঘটনা পর্যন্ত বিশ্ব-ইতিহাসের নানান বাঁকে সংঘটিত হয়েছে তাৎপর্যমণ্ডিত অজস্র ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায় সমসাময়িক সমাজ-সভ্যতা নতুন নতুন বার্তা পেয়েছে, বুদ্ধিমানরা সেসব ঘটনা থেকে জীবন-ঘনিষ্ঠ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং গোটা বিশ্বলোক কোনো না কোনোভাবে একেক ঘটনা থেকে একেক ধরনের পয়গাম নিয়ে সভ্যতার উৎকর্ষ বিধানে কাজে লাগিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত ওইসব ঘটনার কোনোটি হৃদয়বিদারক, কোনোটি চমকপ্রদ আবার কোনোটি বর্বরতা, অমানবিকতা আর নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন। তবে মানবেতিহাসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অবতারণ হয়েছে তার সব ক্ষেত্রেই জানা-অজানা গভীর তাৎপর্য, অনুপম শিক্ষা আর মহান ঐতিহাসিকতা রয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, আশুরা দিবসে মহান আল্লাহ তাঁর নির্বাচিত দশজন নবী-রাসুলকে বিশেষ অনুগ্রহ ও উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন বিধায় এ দিবসকে ‘আশুরা’ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বলা যায়, পরিকল্পিত বা কাকতালীয় হলেও বিশ্ব-ইতিহাসের ঘটনাসমগ্রের উল্লেখযোগ্য স্মরণীয় ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে পবিত্র আশুরা তথা মহররম মাসের দশম তারিখে। গোটা বিশ্ববাসী বিশেষ করে মুসলিম জগতের কাছে খুবই পবিত্র ও তাৎপর্যময় আশুরার বিধান এবং এ দিবসের শিক্ষা ও ঐতিহাসিকতাই এখানে তুলে ধরা হবে।

আশুরা শব্দটি আরবি আশরুন, আশারা থেকে উদ্গত; যার আভিধানিক অর্থ দশ, দশম বা দশমী। শব্দটি ছিল মূলত ‘আশানুরা’ অর্থাৎ আশুরা দিবসের মর্যাদা রক্ষার বদৌলতে আলোকোজ্জ্বল জীবনের অধিকারী। ‘আশানুরা’ হতে ‘নুন’ বাদ দিয়ে শব্দটিকে ‘আশারা’ বা ‘আশুরা’তে রূপান্তরিত করা হয়। ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল ও ফসলাদির খাজনা বা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সঙ্গে সংযুক্তির কারণে এক দশমাংসকে বুঝাতে ‘উশর’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয় আবার পৃথিবীতে জীবন-যাপন করা অবস্থায়ই পরম স্বর্গের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন অতীব পুণ্যবানকে বুঝাতে ধর্মীয় পরিভাষায় ‘আশারায়ে মুবাশ্বারা’ বলা হয়। তবে পবিত্র আশুরার ক্ষেত্রেই সমগ্র বিশ্বে এই শব্দের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়; কেননা আশুরার ঘটনা যেমন অনেক বেশি, মানবেতিহাসে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্যও তেমনি অপরিসীম। পবিত্র আশুরায় সংঘটিত সব ঘটনার অবতারণা না করে আমরা এখানে ‘আশুরা’ শব্দের প্রতি সুবিচারবশত ইতিহাসের অবিস্মরণীয় দশটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, আল্লাহপাকের বাণী- ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খালিফাহ’ অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব। এই বাণীর আলোকে আশুরা দিবসেই মহান স্রষ্টা তার প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বমানবের আদি পিতা হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করেন। বেহেশতে অবস্থান করতে দেয়া, তওবা কবুল করা এবং ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণসহ আদমের (আ.) জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এই দিবসেই সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, হজরত নুহের (আ.) সময়কালে মহাসত্যে অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রলয়ঙ্করী মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হলে সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা থেকে শুধু স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসী মানুষ নবী নুহের (আ.) নৌকায় আরোহণের বদৌলতে আশুরা দিবসেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহাসিক জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্তিকা স্পর্শ করেন। তৃতীয়ত, মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত পিতা হজরত ইবরাহিমের (আ.) জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই আশুরা দিবসে সংঘটিত হয়। তার ঘটনাবহুল জন্ম, ‘খালিলুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বন্ধু অভিধায় ভূষিত এবং খোদাদ্রোহী নমরুদের প্রজ¦লিত অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি লাভের ঘটনা আশুরা দিবসেই ঘটেছিল। চতুর্থত, মহান আল্লাহর নির্বাচিত পয়গম্বর মুসা কালিমুল্লাহের (আ.) খোদাবিদ্বেষী বাদশাহ ফেরাউনের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে মুক্তি, নীল দরিয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা, ফেরাউন ও তার অনুসারীদের সলিল সমাধি এই আশুরা দিবসেই সম্পন্ন হয়েছিল। পরম প্রভু তার প্রিয় রাসুল মুসার (আ.) সঙ্গে ঐতিহাসিক তুর পর্বতে কথোপকথন করেছিলেন আশুরা দিবসেই। পঞ্চমত, নবী ইদ্রিসকে (আ.) মহান প্রভু পরম মমতায় পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে চতুর্থ আসমানে আশুরা দিবসেই উত্তোলন করে নেন। ষষ্ঠত, সৌন্দর্যের আঁধার নবী ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ ৪০ বছর স্বীয় পিতা নবী ইয়াকুব (আ.) থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর পিতা-পুত্রের মহামিলন ঘটে এই আশুরা দিবসে। সপ্তমত, ১৮ বছর টানা কঠিন কুষ্ঠরোগ ভোগের পর নবী হজরত আইয়ুব (আ.) নিরাময় লাভ করেন আশুরা দিবসে। অষ্টমত, সাময়িকভাবে বাদশাহী হারানো নবী হজরত সোলায়মান (আ.) পুনরায় মহান সত্তার অশেষ কৃপায় রাজত্ব ফিরে পান এই আশুরা দিবসে। নবমত, টানা ৪০ দিন মৎস্যের উদরে অবস্থান করে আশুরা দিবসেই মুক্তি লাভ করেন নবী হজরত ইউনুস (আ.)। দশমত, মহীয়সী মারইয়াম তনয় হজরত ঈসার (আ.) জন্ম এবং তার শত্রæদের হাত থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ তাকে আশুরা দিবসেই দ্বিতীয় আসমানে তুলে নেন। ১০ জন বিখ্যাত পয়গম্বরের জীবনে সংঘটিত এসব ঘটনা ছাড়াও আশুরা দিবসে মানবেতিহাসের আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার অবতারণ হয়েছে। তবে আজকের পৃথিবীতে পবিত্র আশুরার ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও প্রভাবের অন্যতম প্রধান কারণ হলো কারবালার মর্মন্তুত বিয়োগান্ত ঘটনা; যা আহলে বাইত তথা নবী-পরিবারের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকারী এবং মহানবীর (সা.) কলিজার টুকরা দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের শাহাদতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে।

মহররম মাস মুসলিম মিল্লাতের কাছে অতীব পবিত্র ও বরকতময় মাস। কুরআনুল কারিমে যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মহররম তার অন্যতম। এ মাসে কোনো জুলুম বা অন্যায় আচরণ না করতে বিশেষভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ রকম এক সম্মানিত মাসে আশুরার অবস্থান একে নিঃসন্দেহে আরো মহিমান্বিত করেছে। আর সেজন্যই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বমানবতার কাছেই আশুরার বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব রয়েছে। মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) যখন দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরা দিবসের সম্মান করে, এ দিবসে রোজাব্রত পালন করে। তখন তিনি মুসলমানদেরও নির্দেশনা দেন আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করার; এমনকি রাসুল (সা.) আশুরার আগের দিন বা তার পরের দিনও রোজা পালনের আদেশ করেন। এতে করে আশুরা দিবসের ধর্মীয় গুরুত্ব অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর চাইতে মুসলমানদের কাছে অধিক বেড়ে যায়। মুসলিম শরিফের হাদিস মতে, রমজানের রোজার পরেই মর্যাদার দিক থেকে সর্বোত্তম হলো আশুরার রোজা। বুখারি শরিফের বর্ণনা মতে, মহানবীকে (সা.) আশুরা দিবসের রোজা আর রমজানের রোজা পালনের চাইতে অধিক আগ্রহী আর কখনো দেখা যায়নি। সহিহ মুসলিমের অপর হাদিসের ভাষ্যমতে, রাসুলের (সা.) প্রত্যাশা হলো আশুরা দিবসে রোজা পালনের পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের অপরাধ মার্জনা করে দেবেন।

ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে আশুরার পবিত্র দিবস। এমনকি পৃথিবীর মহাপ্রলয়ও ঘটবে এই দিবসেই; যা মহানবীর (সা.) ভবিষ্যদ্বাণীতে বিবৃত রয়েছে। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্ব›েদ্বর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই মহান দিবস। যে কোনো মূল্যে সত্য-ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং সুবিচার তথা আদল-ইনসাফের অনুপম সৌধ নির্মাণের অমোঘ শিক্ষা দেয় এই আশুরা। ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক মূল্যবোধে, সামাজিক রীতিনীতিতে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে তথা সামগ্রিক পরিমণ্ডলে সত্য, ন্যায়-নীতি-নিষ্ঠা আর সুবিচারের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার শিক্ষা পাই আশুরা থেকে। মহাসত্যে বিশ্বাস স্থাপন, সর্বশক্তিমান পরম স্রষ্টার অপার মহিমায় নিজেকে সমর্পণ, তার ক্ষমতার বিশালত্বে আত্মসমর্পণ, নির্ভরশীলতা ও সুদৃঢ় আস্থাজ্ঞাপন, যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন, সর্বোতভাবে খোদাতাআলার ঐশী সাহায্যের মুখাপেক্ষিতা, তার সীমাহীন অনুগ্রহ, রহমত আর বরকতের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা এবং জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে খোদার নির্দেশাবলির সামনে মস্তকাবনত হওয়ার শিক্ষা দেয় আশুরা। আমরা যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আশুরার বিধান ও ঐতিহাসিকতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরম সত্তার যাবতীয় হুকুম-আহকামের ফরমাবরদার হওয়ার যোগ্যতায় উপনীত হতে পারি- সে তাওফিক প্রার্থনা করছি।

বিশ্বসাহিত্যে আশুরা ও ১০ মহররম নিয়ে রয়েছে বিপুল সাহিত্যভাণ্ডার। কবিতা, গদ্য, শোকগাথা, মর্সিয়া ধরনের সাহিত্য রচিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে নানান ভাষায়। বাংলা ভাষায়ও এ বিষয়ে অনেক সাহিত্যকর্ম রয়েছে; তবে এসবের মধ্যে জাতীয় কবি নজরুলের ‘মহররম’ কবিতা সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়, নন্দিত ও প্রসিদ্ধ। নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতার একটি পঙ্ক্তিকেই এ লেখার শিরোনাম হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে; কবিতার পরিশিষ্ট কয়েকটি পঙ্ক্তি দিয়ে আমরা এ আলোচনার ইতি টানব- ‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া, আম্মা! লাল তেরী খুন কিয়া খুনিয়া, কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে? সে কাঁদনে আসু আনে সীমারেরও ছোরাতে। কত মহররম এলো গেল চলে গেল বহুকাল, ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লহুলাল, মুসলিম তোরা আজ জয়নাল আবেদীন, ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা কেঁদে তাই যাবে দিন। ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা, ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন : সাবেক চেয়ারম্যান

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

যে কারণে সবাই ‘দ্য ডেলিভারেন্স’র গ্লেন ক্লোজকে নিয়ে বিরক্ত

যে কারণে সবাই ‘দ্য ডেলিভারেন্স’র গ্লেন ক্লোজকে নিয়ে বিরক্ত

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সক্রিয় ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সক্রিয় ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ

প্রকল্পের সব তথ্য ওপেন থাকবে: প্রধান উপদেষ্টা

প্রকল্পের সব তথ্য ওপেন থাকবে: প্রধান উপদেষ্টা

একনজরে বাংলাদেশ-ভারত সিরিজের পূর্ণাঙ্গ সূচি

একনজরে বাংলাদেশ-ভারত সিরিজের পূর্ণাঙ্গ সূচি

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App