দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড আসলে কি সফল হবে?
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারি কর্মীদের দুর্নীতি ধরতে দুদক সেজেছে রণ সাজে। দুর্নীতিরোধকল্পে দুদক মহামারি আকারে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মীদের ওপর। এই কর্মকাণ্ড দেখে ময়মনসিংহের একটি আঞ্চলিক প্রবাদ মনে পড়ল, এটাকে ঠিক প্রবাদও বলা যায় না, তবে উপমাতুল্য গল্পীয় উদাহরণ। এক গ্রামে ব্যাপক কলেরা দেখা দিল। কলেরায় বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। এভাবে কিছুদিন চলার পর হঠাৎ করে কলেরা আগ্রাসন থেমে গেল। তবে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বহু লোকের প্রাণহানি হয়। এক সময় এসে আর কোনো মানুষ কলেরায় মারা যাচ্ছে না। ঠিক এ সময় একজন নারী ঘরের দাওয়ায় বসে তার সন্তানদের বলল, ‘শোন আমার ঘরে মরছে পুতের বউ (পুত্রবধূ), বাইরে মরছে জামাই (মেয়ের জামাই), যাক এবারের ফিলালটা (ফিলাল মানে মহামারি) পরে গেল। বর্তমানে দুদকের অভিযানটা এই নারীর ব্যক্ত করা ফিলালের মতো ঘটনা নয়তো। দুদকের জালে ধরা পড়লেন পুলিশের আইজি, রাজস্ব বোর্ডের সদস্য ছাগলকাণ্ডের নায়ক মতিউর রহমান, আরেক কর্মী রাজস্ব বোর্ডের সচিব পদমর্যাদার, তিনি হলেন কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। তাকে ফয়সাল মিঞা বলে আরেকটি লেখায় সম্বোধন করেছিলাম। তিনি রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস অ্যান্ড লিগ্যাল এনফোর্সমেন্ট)। ঢাকা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) কমান্ড্যাট শহীদ উল্লাহর বিরুদ্ধে তো কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। শহীদ উল্লাহর বিরুদ্ধে আরএনবি বাহিনীর কর্মী নিয়োগ ছাড়াও ঢাকায় পাঁচটি ফ্ল্যাট, কুমিল্লায় ৩০ বিঘা জমি, শাশুড়ির নামে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটও কিনেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। আপন বাবার নামে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ তৈরি করেন শেখ রফিকুল ইসলাম। ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২০তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে চাকরি পান তিনি। এসপি থেকে কয়েক ধাপে প্রমোশন পেয়ে এখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অতিরিক্ত ডিআইজি হয়েছেন। চাকরি জীবনের শুরু থেকে এরই মধ্যে নিজের স্ত্রী, ভাই বোন ও শালিকাসহ পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তির নামে অঢেল সম্পত্তি গড়েছেন, যা দুদকের নজরে এসেছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কামরুল হাসানের নামে ৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ও তার স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৬২ লাখ টাকার অবৈধভাবে অর্জন করা সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কামরুল হাসানের অবৈধভাবে অর্জন করা সম্পদের বাস্তবে মূল্যমান প্রায় ২০০ কোটি টাকা। পুলিশের এই কর্মীর বিরুদ্ধে চাকরিরত অবস্থায় চাঁদাবাজি, ঘুষ গ্রহণ, জমি দখলের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুদক। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ও সিএমপিতে কর্মরত ২৬ পুলিশ কর্মীর নামে রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। দুদক অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। গণমাধ্যম সূত্র থেকে জানা যায়, দুদকের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১-এর নজরে ১৫ জন ও জেলা কার্যালয়-২-এর নজরে রয়েছেন ১১ পুলিশ কর্মী ও তাদের স্ত্রীরা। এই পুলিশ কর্মীরা বিপুল সম্পদের অধিকারী। এই পুলিশ কর্মীদের মধ্যে কারো কারো জাহাজ, মার্কেট মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে। অবৈধ আয়ে ঢাকায় ফ্ল্যাট, প্লট, একাধিক বাণিজ্যিক স্পেসসহ অঢেল সম্পদ রয়েছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাটের এক কমিশনারের। তার নাম হলো এনামুল হক। তিনি সিলেটে কর্মরত আছেন। তিনিও মতিউরের পথ ধরে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এনামুল হকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ বছরের ২২ এপ্রিল দুদক সচিব জানান যে, পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন স্তরের প্রায় অর্ধশতাধিক কর্মীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। এদের মধ্যে কনস্টেবল পদমর্যাদার কর্মীও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এদের বিরুদ্ধে হচ্ছে মামলা।
সার্বিকভাবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এখানে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মী (সহকারী কমিশনার থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত) দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হননি। তাছাড়াও দেশের রাজনীতিবিদরাও দুদকের চলতি অভিযানেও নজরে পড়েননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন দেশের পুলিশ বিভাগ। এই মন্ত্রণালয়ের প্রধান হলো রাজনীতিবিদ ও নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন সিনিয়র বা সচিব পদমর্যাদার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মী। তাহলে কি বলতে হবে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন বিভাগের কর্মীরা অনেষ্ট। না ওই মহিলার গল্পের মতো, ফিলালটা এবারের পরে যাচ্ছে। কারণ দেশের শাসনযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মীরা ও রাজনীতিবিদরা। এই অভিযানে দেখা যায় যে, তারা কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত নন। দুদকের নজরদারিতে তারা পড়ছেন না। তাদের সম্পর্কে গণমাধ্যমে কোনো অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগও উঠছে না। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসে, প্রশাসন বিভাগ কী মনিটরিং করলেন দেশের অন্য কর্মীদের, তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তাদের অধীন কর্মীরা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন। দেশের নির্বাহী বিভাগ দেশের শাসনযন্ত্র পরিচালনার অন্যতম চালক। আর নির্বাহী বিভাগের প্রথম নিয়ন্ত্রণ স্তর হলো সচিবালয়। এছাড়াও উপজেলা স্তরের সব সরকারি কর্মীর কার্যক্রম মনিটরিং করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় স্তরে বিভাগীয় কমিশনার। এই তিন মনিটরিং কর্তাই প্রশাসন বিভাগের কর্মী। তাছাড়া জাতীয়ভাবে সব সরকারি কর্মীর মনিটরিং করে সচিবালয়। সচিবালয়ের তদারকির চোখকে ফাঁকি দিয়ে রেল, রাজস্ব, কাস্টম, পুলিশ কী করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়? তাহলে ধরে নিতে হবে দেশের নির্বাহী বিভাগের কর্মীরা অদক্ষ। যদি কেউ তর্ক করে বলেন যে, প্রশাসনের কর্মীরা দক্ষ তাহলে এর জবাব দিতে হবে? এত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে তারা কী করে দক্ষ হয়? যদি তারা দক্ষ হতো তাহলে কোটি টাকা সম্পদ গড়ার আগেই দুর্নীতিবাজদের ধরে ফেলতে পারতেন। আবার নির্বাহী বিভাগের লোকবল যদি দক্ষই হয়ে থাকে তাহলে এখানেও দুর্নীতির বীজ লুকায়িত আছে। যে বীজটির কারসাজিতে অন্যরা দুর্নীতি করতে পারছে। এলআর ফান্ড নামে নাকি একটি ফান্ড জেলা বিভাগ, উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে। এর অর্থের জোগানটা আসে কোথা থেকে? দুদক কি এই ফান্ডের বিষয়টা নজরদারিতে নিয়েছে? এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান কতটা সফল হয় তাও এখন প্রশ্নবোধক। কারণ দুর্নীতিবাজরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের ধরা যাচ্ছে না।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মীরা অবসরপ্রাপ্ত হয়ে অন্য বিভাগের প্রধান হন। দুদক, নির্বাচন কমিশনসহ আরো কিছু বিভাগ রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা এর দায়িত্ব পালন করেন। তাই জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে যে, দুদকের অভিযানে প্রশাসন বিভাগের কর্মীরা ধরা পড়ছে না এসব কারণে। একটি কথা আছে কাকের মাংস কাকে খায় না। তাই অনেকের ভাবনা (হয়তো ভুল হতে পারে) দুদক মানে অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসন ক্যাডারের কার্যালয়। তাই দুদকের অভিযানে প্রশাসনের অবৈধ আয় অনুসন্ধানে বাইরে থাকছে।
এটা সত্য যে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায় তবে কাক দিয়ে কাকের মাংস খাওয়ানো যায় না। তাই সরকারের উচিত দুদকটা সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের নিয়ে না বানানো।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক।