×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

চুক্তি-সমঝোতার ফের বিএনপি-দিল্লি বিদ্বেষের জের

Icon

মোস্তফা কামাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চুক্তি-সমঝোতার ফের বিএনপি-দিল্লি বিদ্বেষের জের

কোনটা চুক্তি, আর কোনটা সমঝোতা; তা না বোঝার লোকের সংখ্যা দেশে নেহায়েত কম মনে করার কারণ নেই। বিএনপিতে তো মোটেই না। বলা হয়ে থাকে, দলটিতে শিক্ষিত ব্যক্তি সংখ্যায় অনেক। তার ওপর ঝানু, পেশাদার কূটনীতিক ও নামকরা শিক্ষক শ্রেণির অনেকে আছেন। স্ব স্ব মহিমায় বেশ মহিমান্বিত তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর ও দেশটির সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতাগুলো নিয়ে একটি মিথস্ক্রিয়া চলছে। বলা হচ্ছে, দেশবিরোধী বা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া চুক্তি করে আসা হয়েছে। এর মাঝে বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু বাতাস স্পষ্ট। তা একদম না বুঝে করা হচ্ছে, তেমনটি মনে করা যায় না।

চুক্তি ও সমঝোতা শব্দ দুইটির অর্থ ভিন্ন। ইংরেজি শব্দ ভাণ্ডার অনুযায়ী চুক্তি মানে এগ্রিমেন্ট, কন্ট্রাক্ট। আর সমঝোতা মানে বোঝাপড়া। ইংরেজিতে আন্ডারস্ট্যান্ডিং। সমঝোতা স্মারকের তরজমা দাঁড়ায় মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং। সংক্ষেপে এমওইউ। চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, চুক্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ প্রতিকার চেয়ে আদালতে যেতে পারেন। সমঝোতার সেই সুযোগ নেই। এককথায় যার আইনগত ভিত্তি আছে সেটা চুক্তি। সমঝোতায় আইনগত বিষয় থাকে না। সমঝোতা স্মারক আইনগতভাবে বাধ্যমূলক না হলেও তা আন্তরিকতার মাত্রা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের স্মারক। তবে সমঝোতা স্মারক আইনসঙ্গত চুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৫ এবং ১৪৫ক নম্বর অনুচ্ছেদে চুক্তি সম্পর্কে বলা আছে। অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪৫ মূলত অভ্যন্তরীণ চুক্তিবিষয়ক এবং অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪৫(ক) আন্তর্জাতিক চুক্তিবিষয়ক। চুক্তি-সমঝোতা শব্দ দুইটির মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বলা হয় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক একটি অপরটির পরিপূরক।

বিএনপি নেতৃত্বের একজনও চুক্তি ও সমঝোতার এ ফের বোঝেন না, তা মোটেই নয়। তারা অবশ্যই জানেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কিছু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, কিছু নবায়ন করা হয়েছে, কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। আর সব সমঝোতা স্মারক দেশের স্বার্থেই করা হয়েছে। তা হলে বিএনপি থেকে কেন জোর গলায় বলা হচ্ছে, চুক্তি হয়েছে? অবশ্যই তারা তা জেনে-বুঝেই করছেন। বাংলা ‘চুক্তি’ শব্দটির ইংরেজি ঈড়হঃৎধপঃ, আবার ঈড়হঃৎধপঃ-এর সমার্থক ইংরেজি শব্দ কাছাকাছি। পরিভাষাগতভাবে এর বাংলা অর্থ চুক্তি, মত, মিল, সম্মতি, সমঝোতা, ঐকমত্য, বোঝাপড়া ইত্যাদি। আইনের ভাষায়- সব ধরনের সমঝোতাই চুক্তি, যদি তা চুক্তি সম্পাদনের জন্য যোগ্য পক্ষের স্বাধীন সম্মতিতে আইনসঙ্গত মূল্য এবং বিষয়ে হয়, যা ব্যক্তভাবে বাতিল ঘোষিত নয়। ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ হলে হয় তো চুক্তি-সমঝোতা তফাৎ নিয়ে এত কথা হতো না। মূলত ভারত প্রশ্নে দলটির নীতি নির্দিষ্ট করতে না পারায় এ জটিলতার সৃষ্টি।

দলের নীতিনির্ধারণী মহলের একাংশ চায় ভারতীয় কর্তৃত্ব ও আগ্রাসনবিরোধী কঠোর অবস্থান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে একটি পোক্ত আসন গড়তে এবং ভারতবিরোধিতাকে দলের মূল আইডেন্টিটি করতে। আরেক অংশ চায় ভারতের সঙ্গে খায়খাতির তৈরি করে অবস্থান গড়তে। ভারত প্রশ্নে এমন দোদেলবান্দা ভূমিকার নেতারা কর্মীদেরও সংক্রামিত করে করে তুলেছেন। গেল নির্বাচনের আগে এর একটি বেপরোয়া চর্চা চলেছে। এতে ফল ভালো আসেনি। ইদানীং দলের হাইকমান্ড আবারো রাজপথের আন্দোলন গরম করতে চায়। তাদের অনুসরণ করছে সমমনা দলগুলোও। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টির পেছনে তাদেরও অবদান ছিল। সেই চেষ্টায় বিবৃতি, আলোচনা, ভিসানীতি ও শ্রমনীতি ঘোষণার মতো পদক্ষেপ চলে। তাদের এমন তৎপরতা বিএনপিকে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করে দেয়। কিন্তু নির্বাচনের পর তাদের দিক থেকেও আর সেই চাপ নেই; বরং যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের কথা বলছে।

বিএনপি এতে হাল ছাড়ছে না। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন আরো জোরদারের লক্ষ্যে কয়েকটি শরিক দলের সঙ্গে মেলবৈঠক করছে। যুগপৎ আন্দোলনে এবার জামায়াতে ইসলামীকে সম্পৃক্ত করতে বিএনপির অধিকাংশ মিত্র দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা জোর পরামর্শ দিয়েছেন। ডান-বাম ও অন্যান্য ইসলামী দল এবং জোটকেও আন্দোলনে যুক্ত করার মতও আছে কারো কারো। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে হঠাৎ ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন দলের শীর্ষ নেতৃত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা। নির্বাচনের পর ভারত বিরোধিতার তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেন তারা। ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে কিছুদিন ধরে চলা প্রচারণায়ও জড়িয়ে যান। এর সঙ্গে মালদ্বীপের ‘ইন্ডিয়া আউট’ (ভারত খেদাও) কর্মসূচির মিল দেখেছে ভারত। মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার এবং জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাবকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলের সাফল্য অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে। তবে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

এর বিপরীতে ভারতের মনোভাব এখন আরো স্পষ্ট। ভারত স্পষ্ট বলছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা দরকার। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। দেশটির এমন মনমর্জিতে কিছুদিন ধরে বিএনপিতে আবার ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির তদ্বির। কিন্তু বাদ সাধছে ভারতবিরোধী উগ্র মৌলবাদী কয়েকটি দল। বিএনপি আবার তাদেরও হাতছাড়া করতে চায় না। বিএনপির একটি গ্রুপ তাদের সঙ্গী করে ব্যাপক উদ্যমে ভারতবিরোধী হতে চায়। গত ১৬-১৭ বছর টানা এই কসরতই করেছে বিএনপি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সব চেষ্টাই করেছে বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার ভারতের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেছেন। যা বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে ভারতকে আরো সন্দিহান করছে। এসব নিয়ে দলের ভেতরে চলছে নানা আলোচনা। নেতাদের মধ্যে বিভ্রান্তিও প্রকট। ফলে ভারতের বিষয়ে এক সুরে বক্তব্য আসছে না। এক গ্রুপ সীমান্ত হত্যা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্যিক বৈষম্য, রাজনীতিতে হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতবিরোধী অবস্থানের পক্ষে। তারা মনে করেন, কিছুদিন আগেও ভারতের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো তাদের জন্য ততটা সহজ ছিল না।

নির্বাচনের আগে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অংশের ভারতবিরোধী বক্তব্যের পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আরেক পক্ষ মনে করে, ভৌগোলিক কারণে ভারতকে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। দেশটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কৌশলগত প্রতিক্রিয়া বা সমালোচনা করে যেতে পারে। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে নয়। বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই পরোক্ষ সমালোচনার মাধ্যমে ভারত বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল। সে অবস্থান থেকে সরে যাওয়া যেমন ভুল ছিল, তেমনি ভারত বিরোধিতা করতে গিয়ে উন্মাদনা তৈরি করাও ঠিক হয়নি। ১৯৯১ বা ২০০১ সালের জোট সরকারের সময় ভারত বিরোধিতায় ভারসাম্য ছিল। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হয়নি। ইস্যুভিত্তিক সমালোচনায় ভারতকে চাপে রাখা হতো, আবার কূটনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায় সুসম্পর্ক অটুট থাকত। এখন বিএনপি যে মনোভাব নিয়ে এগোচ্ছে, তাতে সেই কৌশল নেই। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত সরকারের সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। গত প্রায় দেড় দশক ধরে ভারত সরকার নানা ইস্যুতে শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে আসা তখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ বাতিলকে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির জন্য দায়ী করা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক বাতিল হওয়ার ঘটনায় দুপক্ষের মধ্যে চরম অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর ২০১৪ সালের বিরোধী দলহীন নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারতের তৎপরতা ছিল দৃশ্যমান। তখনকার ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব নিজেই ঢাকায় এসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এরপরও বিএনপি বিভিন্ন সময় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছে। বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, বিএনপি ভারতবিরোধী নয়।

ভারত সরকার এবং এমনকি দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির লক্ষ্যে বিএনপির কয়েকজন নেতাকে দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। তারা কয়েকবার ভারত সফরেও গেছেন। কিন্তু কামিয়াবি হননি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ আট বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গেও ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের যোগাযোগ আছে। ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম একটি পরাশক্তি। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যারা ভারতকে সমীহ করে চলে না বা সমীহ করে কথা বলেন না। এ রকম একটি বাস্তবতায় বিএনপির ভারতবিরোধিতা কতটুকু সফল হবে, সেটি যেমন একটি প্রশ্ন, তেমনই বিএনপির মধ্যেও বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন, যারা ভারতের সহানুভূতিশীল এবং ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী। এদের বিএনপিতে ভারতপ্রেমিক নামে চিহ্নিত করা হয়। এমন এক দ্বৈরথের মাঝে বিএনপি ভারতবিরোধী নয় বলে সম্প্রতি আবার জানান দিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল। বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনবিরোধী। তার এ বক্তব্যটি নিতান্তই ভারতকে একটি বার্তা দেয়া। এর ফলোআপ এখনো অস্পষ্ট।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

৯ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

৯ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

সীমান্ত হত্যা ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক জোরদারে বড় বাধা: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সীমান্ত হত্যা ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক জোরদারে বড় বাধা: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

শাহরিয়ার আলম ও দিলীপ আগরওয়ালার ব্যাংক হিসাব তলব

শাহরিয়ার আলম ও দিলীপ আগরওয়ালার ব্যাংক হিসাব তলব

র‌্যাবের গাড়ি থেকে আ’লীগ নেতাকে ‘ছিনিয়ে নিলো’ বিএনপি নেতারা

র‌্যাবের গাড়ি থেকে আ’লীগ নেতাকে ‘ছিনিয়ে নিলো’ বিএনপি নেতারা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App