×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

অর্থবছরের নতুন বাজেট : সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

Icon

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থবছরের নতুন বাজেট : সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ
আগামী অর্থবছরের বাজেট আসছে। এখন চলছে বাজেট প্রণয়নের চূড়ান্ত কাজ। আগামী বাজেট নিয়ে এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নানা গুঞ্জন। সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেট নিয়ে আলোচনা, আগ্রহ, কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক। নানা অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে গত কয়েকটি বছর পার করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার মুখ থুবড়ে পড়েনি। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন অনেকেই। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, চরম বিপর্যয় নেমে আসবে, অভাব-দুর্ভিক্ষ-মন্দা গ্রাস করবে বাংলাদেশকে। এমন অনেক আশঙ্কার পর শেষ পর্যন্ত তেমন ভয়ংকর কিছু ঘটেনি। এটাই আমাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে। এজন্য পরপর একটানা চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকারের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে। এখনো আমাদের অর্থনীতি দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। নানা ধরনের আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা রয়েছে। তারপরও আমরা আশাবাদী। আগামী দিনগুলোতে আমাদের অর্থনীতি কোনদিকে এগোবে, তেমন কিছু চিন্তা ভাবনার আলোকে আলোচনা করতে গেলে বলা যায়, অর্থনীতির অস্থিরতা দৃশ্যত কিছুটা কমলেও শঙ্কা কাটেনি। ডলারে দামের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা আপাতত ঠেকানো গেছে। রিজার্ভের পতন কিছুটা সামাল দেয়া গেছে। আলোচিত ব্যাংক খাতের সমস্যাকে স্বীকার করে দেরিতে হলেও সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে ভালো ব্যাংককে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে খেলাপি ঋণ, স্বজনপ্রীতি, ব্যাংক মালিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ- ব্যাংকের এ ধরনের চিরায়ত সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি এখনো সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে আছে; যা সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে। শিগগিরই কমবে, সেই আশাও কম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। ডলার আসার অন্যতম প্রধান দুটি উৎস নিয়ে স্বস্তি আসেনি। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত নয়; তবে সংকট থেকে উত্তরণ অর্থনীতিতে সংকট কেটে গেছে, তা বলা ভুল হবে। সংকট কাটার নির্ভরযোগ্য প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মাস আগেও নীতিনির্ধারকরা সংকটকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে যেন এক ধরনের তুষ্টি ফিরে এসেছে। সংকট থাকা অবস্থায় যদি তারা বলেন, সংকট নেই- এটাই তো বড় সংকট। রপ্তানি আয় ছাড়া অন্য কোনো সূচকে সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রবাসী আয় বাড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তাই আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ার মতো অবস্থাও নেই। ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কমছে না। ব্যাংক খাতের সমস্যার কথা স্বীকার করে গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক পথনকশা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে চুক্তি করেছে। এছাড়া কৃষিব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল এই চারটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংক এই ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটি বলছে, ব্যাংক একীভূত করায় সতর্ক থাকতে হবে। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, ভালো ব্যাংক কখনো বাড়তি দায় নেয় না। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের অন্য সমস্যা, যেমন স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম, ব্যাংক পর্ষদে পরিবারের আধিপত্য, খেলাপি ঋণ- এসব কমানোর দৃশ্যমান বড় কোনো উদ্যোগ নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ধরে রাখাসহ নানা কারণে রিজার্ভের বড় পতন আপাতত ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৪০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ নিয়ে। এই হিসাব অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গতানুগতিক হিসাব পদ্ধতি। তখন রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি ছিল না। পরের এক বছরে রিজার্ভ শুধু কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছিল ডিসেম্বর মাসে। আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাব পদ্ধতি অনুসারে ৭ ডিসেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১৩ কোটি ডলার। পরে তিন মাস রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলারের আশপাশেই ছিল। সর্বশেষ ২৮ মার্চ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলার। মূলত ডলার-সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি- এসব কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। কিন্তু আমদানি খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের জোগান বাড়েনি। ফলে ক্ষয় হতে থাকে রিজার্ভের মজুত। তবে তিন মাস ধরে রিজার্ভের বড় ধরনের পতন হয়নি। রিজার্ভও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না এনবিআর। বড় ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে এনবিআর। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শুল্ক ও করসহ সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ২২২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুসারে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশে সমপরিমাণ রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। এনবিআরকে এ বছরের লক্ষ্য দেওয়া হয় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আগামী বাজেটে আইএমএফের শর্তে কর ছাড় কমাতে হবে। এজন্য অনেক খাতের কর মওকুফ ও রেয়াতি কর হার তুলে দিতে হবে। সার্বিক রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি এমন যে এখন উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ধার করে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে খরচের জোগান দিতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ৩১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আগামী বাজেটে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার তদারকি বাড়াতে হবে। আবার খেলাপি ঋণ কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে ফেলে। সার্বিকভাবে মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতা আনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের তুলনায় অর্থমন্ত্রীর কাজ আরো ব্যাপক। হংকংভিত্তিক ফাইন্যান্স এশিয়া নামের একটি ম্যাগাজিন ভালো ও খারাপ অর্থমন্ত্রীদের তালিকা নিয়ে কাজ করত। তারা অর্থমন্ত্রীর কার্যক্রম বিচার করে কয়েকটি বিষয় ধরে। যেমন একজন অর্থমন্ত্রীর কাজ হচ্ছে বাজেট ও রাজস্বনীতি ঠিকমতো তৈরি করা, পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করা, অর্থনীতির সংস্কার বাস্তবায়ন, আর বিশেষ করে কঠিন সময়ে বিনিয়োগকারীর আস্থা ধরে রাখা, যাতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি ভালো থাকে। তবে অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে স্বাধীনভাবে কাজ করা। নিজের কাজ ঠিকঠাক করতে প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক দক্ষতা, নীতির ওপর কর্তৃত্ব, আমলাতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারা এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় লড়াই করে যাওয়া। অথচ বেশির ভাগ অর্থমন্ত্রীর কাজই হচ্ছে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী অথবা সামরিক শাসককে তুষ্ট করা। বিপত্তি এখানেই। আর অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর যদি দুজনেই নিকৃষ্ট হন, তাহলে কী হয়? তাহলে একটা দেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হয়। সবার আগে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীদের একটা সাফল্যের কথা বলতেই হয়। বাজেট ঘাটতি প্রায় সব সময়েই সীমার মধ্যেই ছিল। এ নিয়ে খুব বেশি উচ্চাভিলাষী কেউই হননি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও বজায় রাখা গেছে। ঋণ পরিশোধে কখনো সমস্যায় পড়েনি বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। এদিকে আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। চাপ কিছু কমলেও অর্থনীতি উত্তরণের পর্যায়ে যায়নি। জুনে যেমন নতুন বাজেট দেবেন নতুন অর্থমন্ত্রী, তেমনি নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণা দিতে হবে গভর্নরকেও। দুই নীতির সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ সাধারণ মানুষ বাজারে স্বস্তি চায়। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত- সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার। সব মিলিয়ে দেশের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের জন্য সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপরেই নির্ভর করছে ইতিহাসে কার স্থান কোথায় হবে। কে ভালো কে খারাপ, তারও ফয়সালা হবে। অন্তত বিশ্বের অন্যান্য দেশেই অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরকে এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়। আমরাও এভাবে মূল্যায়ন করতে চাই। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত- সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App