×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

বাইডেনের আস্ফালন এবং যুদ্ধ প্রকল্প

Icon

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাইডেনের আস্ফালন এবং যুদ্ধ প্রকল্প
গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে চলছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীরা সেখানকার গণহত্যা বন্ধের দাবি করছে। অন্যদিকে ইসরায়েলি ছাত্ররা, তাদের সঙ্গে মার্কিন শিক্ষার্থীরাও আছে, তারা হামাসবিরোধী এবং তাদের উৎখাত করতে দাবি জানাচ্ছে। এর মধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়ার ইউসিএল ক্যাম্পাসে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ কল করলেও তারা সময় নিয়ে আসে। ফলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। অন্য এক ক্যাম্পাসের ইতিহাসের এক অধ্যাপককে পুলিশ এমনভাবে আটক করে, দেখে মনে হয় তারা একজন সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে আটক করছে। ওই অধ্যাপকের পাঁজরের হাড় ও হাত ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। ঘটনাপ্রবাহ ফিলিস্তিনের গাজাসহ গোটা অঞ্চলে এরই মধ্যে ইসরায়েল হত্যা করেছে ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশু-নারী-পুরুষ, যাদের অধিকাংশই সাধারণ বেসামরিক মানুষ। ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনি সরকারের নয়, যুদ্ধটা হচ্ছে সেখানকার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গ্রুপ হামাসের সঙ্গে। হামাসের পেছনে আছে ইরান আর ইসরায়েলের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানই মদদদাতা। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, তরুণ সমাজ ও ইরানের তরুণ সমাজ যুদ্ধ চায় না। অসম সামরিক শক্তির দুটি দেশ সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকেই কেবল হেলা করছে না, শান্তিবাদী পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছে নিরাপত্তাহীনতা। যুদ্ধের কারণে হোক রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, হোক হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ, তার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। দুটি দেশ অসম শক্তির হলেও ইরানের পেছনে অপ্রকাশ্যে আছে রাশিয়া ও চীন, সেটা আমরা টের পাই। আর মধ্যপ্রাচের দেশগুলো কোন পক্ষে যে আছে তা বোঝার উপায় নেই। মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির কোনো সাড়া-শব্দ নেই। ফিলিস্তিনে গণহত্যা চললেও তাদের যেন কোনো ক্ষতি হয়নি, এমনই রাজনৈতিক ভঙ্গি তাদের মধ্যে। বোঝা যায় রাজতন্ত্র আর সালতানাতের আসরে মানবতার ওপর নৃশংসতায় তাদের মনে কোনো রকম বেদনা জাগে না। কেবল তুর্কিয়ে বা তুরস্কের নেতা এরদোয়ানের মধ্যে একটি আহাজারি শুনেছি আমরা। বাংলাদেশ মুসলিম দেশ হলেও কেবল বিবৃতিতে আটকে আছে তার কণ্ঠস্বর। কারণ আমাদের পাশের দেশ ভারত ইসরায়েলের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে সমর্থন জানিয়েছে। ভারতের সমর্থন ইসরায়েলের পক্ষে প্রকাশ্যেই। ফলে বাংলাদেশ বা সরকারপ্রধান ইসরায়েলের সমালোচনা করলেও অন্য কোনো উদ্বেগের প্রকাশ ঘটায়নি। আর মুসলমান জনগণ ঘরের ভেতরে ইসরায়েলবিরোধী সভা-সমাবেশ ইত্যাদি করে প্রমাণ করেছে, তারা এর চেয়ে বেশি কিছু করতে রাজি নয় ফিলিস্তিনের জন্য। শিখণ্ডী দখলদার ইসরায়েল তো ফিলিস্তিনি ভূমিতে পরজীবী হিসেবে রোপিত হয়েছে। দেশটি মূলত পশ্চিমা তথা মার্কিনিদের মধ্যপ্রাচ্যের দারোয়ান। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য জায়গা দখল করে সশস্ত্র দারোয়ানকে বসিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে ভীতির ভেতর শাসনে রাখা। সেই সঙ্গে তাদের মিনারেল সম্পদ উত্তোলন ও শোষণ করা। এই হলো গাজা ও ফিলিস্তিনি সংকট নিয়ে বিশ্বরাজনীতির নৃশংসতার বহিরঙ্গ। অন্তরঙ্গে কী আছে, তা জানেন ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসি, খামেনি আর জো বাইডেন। দুই. পুঁজির শাসকরা নৃশংসতার চেয়েও অধিক নির্মম। মার্কিন ইহুদিবাদী পুঁজি ও ইহুদিদের রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন, মিডিয়াগুলোর উপরিকাঠামোর সত্য কাহিনি তুলে ধরলেও অন্তরঙ্গে তারা তেলবাজি ও স্বার্থ উদ্ধারের তেলেসমাতি কারবার, সামরিক প্রকল্পের প্রণোদনায় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের নীরব সমর্থন বাইডেনের বক্তব্য হয়ে বেরোয়। ফিলিস্তিনের গাজায় শিশু ও নারী হত্যায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনি টুঁ শব্দ করেননি। কারণ কী? এ বছরের নির্বাচনে ইহুদি লবিস্টদের মনোযোগ অটুট রাখা? নাকি তাদের ফান্ডিং গ্রুপের ওপর তার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা? বুঝতে হবে। ইসরায়েলের ইহুদি লবিস্টদের নিয়ে বাইডেন খুবই উদ্বিগ্ন, কেননা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান ট্রাম্পকেও তো ইহুদি লবিস্ট গ্রুপই বিনিয়োগের চ্যানেল খুলে দিয়ে থাকে। বিষয়টি এতদিন তিনি চেপে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা যে উত্তাল প্রতিবাদী বিক্ষোভ করছে, সেøাগান দিচ্ছে, ক্যাম্পাসের প্রক্টরিয়াল আইন ভেঙে মিছিল-মিটিং করছে, তাতে তিনি চুপ থাকতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রেসিডেন্টও তেমন কোনো অ্যাকশনে যাননি। তবে তাদের ইশারাই তো যথেষ্ট, ছাত্রছাত্রীকে বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ। তাদের কারো কারো পিঠে চেপে বসে যেভাবে আটক করেছে, তা কেবল সন্ত্রাসীদের ব্যাপারেই করে থাকে। মনে পড়ল মিনেসোটার কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ লয়েডের অপরাধের বিপরীতে যেভাবে তার কণ্ঠনালির ওপর চেপে বসেছিল দোষী পুলিশ, তাকে হত্যার শামিল বিবেচনা করা হয়। সীমান্তগুলোতে চোরাই প্রবেশকারীদের ধরার পর যে রকম অমানবিক, অনৈতিক ও অবৈধ আচরণ করা হয়, তাকে এক কথায় পুলিশি বর্বরতা বলে চিত্রিত করা উচিত। পথে-ঘাটে যেসব পুলিশের নম্র ও ভদ্র আচরণ দেখে বিদেশিরা চমৎকৃত হন, তাদের সঙ্গে সীমান্তের বা অন্য পুলিশের আচরণকে মেলানো যাবে না। তারা একটু স্পেশাল। যদি ইমিগ্রেশন পুলিশের সন্দেহের পাত্র হন কেউ, তখন তার রূপ পাল্টে যায়। তো, মার্কিন প্রশাসনের নগ্নতা পরিমিতিবোধ এসবই উপরিকাঠামোর। ভেতরে তারা নৃশংস। অবশেষে বাইডেন যে বিবৃতি দিয়েছেন গাজার ব্যাপার নিয়ে ক্যাম্পাসগুলের দিকে আঙুল তুলে, সেটাই প্রমাণ করে তিনি কতটা ক্ষেপেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা একটি কর্তৃত্ববাদী জাতি নই, যেখানে জনগণকে চুপ করিয়ে দিই বা ভিন্নমত দমন করি। তবে আমরা আইনহীন দেশও নই।’ বাইডেন বলেন, ‘আমরা চাই একটি সুশীল সমাজ এবং শৃঙ্খলা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে।’ তিনি ও তার সরকারকে এবং জাতিকে কর্তৃত্ববাদী জাতি নই বলেছেন। কিন্তু গোটা পৃথিবী জানে, যুক্তরাষ্ট্র কেমনতরো চরিত্রের দেশ। বাইডেনের কথাগুলো যে কতটা মিথ্যা, বানোয়াট, কতটা কর্তৃত্ববাদী, তা উপলব্ধি করা যায় ওই দেশে গিয়ে যারা কাজ করে খান এবং নন-ইমিগ্রান্টদের দুর্দশা দেখলেই বোঝা যায়। ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ ওয়ার্ক পারমিট পায়নি আজো, গ্রিন কার্ড তো সুদূরপরাহত তাদের কাছে। তারা অবৈধ অভিবাসী। ওই অবৈধ অভিবাসীদের সবাই অবৈধভাবে কাজ করছে, তারা আমেরিকান সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তিতে অবদান রাখছে, ট্যাক্স দেয়ার পরও তাদের ইমিগ্রেশন কেসগুলো ১০, ১৫ ও ২০ বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে ইমিগ্রেশন। কর্তৃত্ব জাহিরই কেবল করছে না সরকার, এফবিআই গোপনে অনেক অবৈধকে ধরে সীমান্তের বাইরে বা তার দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অথচ দেশটি ঘোষণা দিয়েছিল তারা আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় ও তাদের হিউম্যান রাইটস বহন করবে। আর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্য হতে বাধা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবারই। এবারো একমাত্র মার্কিনি ভেটোর কারণে ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়নি। অথচ জাতিসংঘের সদস্য হলে দেশটিকে বাঁচানো যাবে- এটা যুক্তরাষ্ট্র জানে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি কাজই মানবতাবিরোধী। বিশেষ করে ফিলিস্তিন প্রশ্নে সে ইসরায়েলের পক্ষে প্রকাশ্যে অনৈতিক উদ্যোগ নেয়। বিশ্ব মোড়ল হিসেবে তার দায়িত্ব যুদ্ধ পরিস্থিতি বা রক্তাক্ত যুদ্ধ, হানাহানি বন্ধ করা। এই ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অসভ্য ও দখলদার ইসরায়েলের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। মার্কিনি অস্ত্র না পেলে হয়তো ইসরায়েলি নেতা নেতানিয়াহু সিসফায়ারে যেতে বাধ্য হতো, আত্মসমর্পণ না করলেও যুদ্ধ বিরতি মানতে উৎসাহী হতো। এমনকি ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষকে হত্যার পরও ইসরায়েলি নেতানিয়াহু ও বাইডেনের মনে বিন্দু পরিমাণ মানবিকতার লক্ষণ দেখা যায়নি। উল্টো আস্ফালন করে চলেছে। এই লক্ষণ কেবল টাইরান্ট চরিত্রের পক্ষেই সম্ভব। আর যদি মার্কিন প্রশাসন ও বাইডেনের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিকতার প্রতি মিনিমাম শ্রদ্ধা ও ভোটার জনগণের প্রতি ভালোবাসা থাকত, তাহলে বাইডেন এই যুদ্ধের দায় নিজের কাঁধে নিতেন না। আমার ধারণা, তিনি এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমেরিকান ভোটারদের মনে এটাই স্থাপন করতে চাইছেন, আমেরিকা তার শক্তিমত্তার চরিত্রেই আছে। এই যুদ্ধে তো মূলত উভয়পক্ষ প্রক্সি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের। ইরানকে সাইজে না আনতে পেরে ইরান সমর্থিত হামাস ও হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের মিসমার করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতেও তো হাজার হাজার ভোটার আছে, যারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে ভোটারদের ওপর। তাই বিক্ষোভরত ছাত্র-শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার জন্য পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন বাইডেন। এটা যে হিতে বিপরীত হবে এবং হচ্ছে তার জন্য নতুন করে বলার কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের এই অভ্যন্তরীণ কর্তৃত্ববাদিতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমাজ বা দেশের সঙ্গে সে যে অনৈতিক ও অবৈধ কর্তৃত্ববাদী আচরণ করে চলেছে, তার মিল ও মহব্বত আছে। সেই সঙ্গে তারা যে বর্ণবাদী, সেটা আজ অনেকটাই প্রকাশ্য। তারা যে অন্য জাতিসত্তা থেকে আসা মানুষদের ঘৃণা করে, এটা পরিষ্কার। নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে শোষণ করে তাদেরই চাকরিদাতারা, যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। মার্কিন ইহুদিদের দোকানে কেউ যদি কাজ পান, সে বৈধ কি অবৈধ তার বিবেচনা তাদের থাকে না। তাদের প্রধান বিবেচনা থাকে ওই লোকটা তার কাজে কতটা দক্ষ। মিথ্যা আস্ফালন দেখিয়ে বাইডেন যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা ধরেই আমরা পৌঁছাতে পারি, তার সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ও আদর্শের বিষয়ে। সামরিক অস্ত্র বাণিজ্যই যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে মার্কিনিদের নীতি-আদর্শের ঘোষণাগুলোর পরিবর্তন জরুরি। মানুষ হত্যার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মারণাস্ত্র সরবরাহ কোনো মানবিক মানুষের পক্ষে করাটাই চরমতম মানবাধিকার হরণ। ইসরায়েল আর ইউক্রেনকে অস্ত্র, গোলাবারুদ আর যুদ্ধ প্রলম্বিত করে যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষত সৃষ্টি করেছেন বাইডেন, পুতিন, জেলেনস্কি, হামাস ও ইরান; তাকে কোনো যুক্তিতেই সমর্থন জানানো যায় না। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদেরও এই নৃশংস প্রকল্প পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে, না হলে একদিন দেশগুলো মারাত্মক সংকটে পড়বে। তরুণ আমেরিকানদের ভেতর এই যুদ্ধের নির্মমতার বীজ উপ্ত হয়েছে, যা একদিন অঙ্কুরিত হবে এবং তারাই বাইডেন-ট্রাম্প চেতনাকে প্রশান্ত মহাসাগরে নিক্ষেপ করতে কসুর করবে না। ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App