×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

কর অব্যাহতি চাই আইটি খাতে

Icon

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কর অব্যাহতি চাই আইটি খাতে

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নানামুখী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের টেক্সটাইল, গার্মেন্টসসহ কয়েকটি খাতকে সুসংহত ও গতিশীল করার উদ্যোগ নেন। এসব খাতের উন্নয়নে তিনি দীর্ঘমেয়াদি একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ এসব খাত থেকে অর্জিত হচ্ছে।  স্বাধীনতা যুদ্ধ-পরবর্তী খুব অল্প সময়ের মধ্যে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মূল কারণ ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা এবং খাতসংশ্লিষ্ট উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে নানামুখী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একটি দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দেশের মর্যাদা বহির্বিশ্বে আরেক দফায় এগিয়ে নিয়েছেন। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সাল নাগাদ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের রূপকল্প ঘোষণা করেছিলেন। এখন তার পরবর্তী দূরদর্শী পরিকল্পনায় রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এই স্মার্ট বাংলাদেশের ৪টি মূল ভিত্তি হলো স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সবচেয়ে মজবুত সহযোগী হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি খাত। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত প্রচেষ্টায় তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখন এ দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রণী ভূমিকা ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় ২০১১ সাল থেকে ২৭টি ডিজিটাল সেবা খাতে তিনি কর অব্যাহতি দিয়ে আসছেন। এর ফলে এ খাতটি ব্যাপক সমৃদ্ধ হয়েছে। আগামী দিনে এই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রণী ভূমিকার মাধ্যমে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।  ২০১১ সাল থেকে ২৭টি ডিজিটাল সেবা খাতে কর অব্যাহতি শুরু হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হলে ওই বছরেই নতুন করে ৪ বছরের জন্য তা বাড়ানো হয়। ১৩ বছর ধরে চলা এসব ডিজিটাল সেবা খাতে সরকারের কর অব্যাহতির মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের কারণে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ আর বৃদ্ধি করা হবে না। আইএমএফ সামগ্রিকভাবে কর অব্যাহতি বন্ধের বিষয়ে কথা বলেছে। আর তাদের কথা বলে আইটি খাতকে ধূম্রজালের মধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের জানা মতে আইএমএফ আইটি খাতে কর অব্যাহতি বন্ধ করার ব্যাপারে কিছুই বলেনি। আইটি ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে আইএমএফ কিছু বলে থাকলে আমাদের তা দেখানো হোক। তবে আমি নিজেই আইএমএফের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অবকাশের ব্যাপারে তারা পরোক্ষভাবে কোনো মতামত দেয়নি।

গার্টনারের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসা হয় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এ খাতের বৈশ্বিক অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশেও দ্রুত গতিতে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসার প্রসার ঘটছে। এখন এই গতি থামিয়ে দিলে আমরা আন্তর্জাতিক দৌড়ে পিছিয়ে যাব। তখন অন্যান্য দেশ আমাদের সম্ভাবনাময় খাতগুলো নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে। বিশ্বে সফটওয়্যার খাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেটার সঙ্গে বাংলাদেশের গতির সমন্বয় থাকলে দেশ কতদূর এগিয়ে যাবে তা একটি পরিসংখ্যান দিয়ে আপনার সবিনয় অবগতির জন্য ব্যাখ্যা করছি।

২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মার্কেটে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সফটওয়্যারের ব্যবসা ছিল ৭১.৪১ বিলিয়ন ডলার। কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেটের (সিএজিআর) বিশ্লেষণ অনুযায়ী চলতি বছরেই ইআরপি সফটওয়্যারের আনুমানিক ব্যবসা হবে ৮১.১৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩২ সাল নাগাদ এই ব্যবসা গিয়ে ঠেকবে ২৩৮.৭৯ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মার্কেটে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের ব্যবসা ছিল ১৪.৫৪ বিলিয়ন ডলার। কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেটের (সিএজিআর) বিশ্লেষণ অনুযায়ী চলতি বছরেই কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের আনুমানিক ব্যবসা হবে ১৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩২ সাল নাগাদ এই ব্যবসা গিয়ে ঠেকবে ৬২.৭৫ বিলিয়ন ডলারে। কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেটের (সিএজিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইটি অ্যানাবল সার্ভিসের আনুমানিক ব্যবসা হবে ৪৬১.০৩ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৯ সাল নাগাদ এই ব্যবসা গিয়ে ঠেকবে ৬৩০.৭৬ বিলিয়ন ডলারে। 

বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের সব সফটওয়্যার বিদেশে যাচ্ছে। আমাদের মার্কেটও বড় হচ্ছে। কিন্তু আমাদের গতি থামিয়ে দিলে এ খাতের সম্ভাবনার অপমৃত্যু হবে। কারণ বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত হচ্ছে সোনার ডিম দেয়া হাঁস। কর অব্যাহতি বন্ধ করে দিলে ৪-৫শ কোটি টাকা পাবে সরকার। কিন্তু এর ফলে সোনার ডিম দেয়া হাঁস মারা যাবে। আর সোনার ডিম দেয়া হাঁস মারা গেলে এ দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত মারা যাবে। এ খাতের যোদ্ধারা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনতে পারবে না। বিদেশি সফটওয়্যার রাজত্ব করলে রিজার্ভ থেকে টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে কিনতে হবে।

এ দেশের বহু মেধাবী তরুণ দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাবে। আমাদের দেশ মেধাশূন্য হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির সৈনিক বিদেশে চলে গেলে আমরা কিন্তু পিছিয়ে যাব। তাই হাঁস না মেরে আরো হাঁস কীভাবে আনা যায় সেটা আমাদের দেখা দরকার।  এখন যেমন গার্মেন্টসশিল্প দাঁড়িয়ে গেছে। তবে তাদের কর্মীদের বেতন তেমন উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি না হলেও আইটি খাতের বেতন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হয়ে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি দিলে এ খাতে প্রায় ২০-২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। তাদের মাসে গড় বেতন ৫০ হাজার টাকা হলে (২০ লাখ ধরলেও) ১,২০,০০০ হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর বেতন হবে। সে বেতনের ২৫ শতাংশ ট্যাক্স ৩০,০০০ হাজার কোটি টাকা এনবিআরের তহবিলে জমা হলে এ দেশের অর্থনীতির অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা কি অনুমেয় নয়? 

তাই এ খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০৪১ সাল পর্যন্ত নিতে হবে। সোনার ডিম কিন্তু একটা একটা করেই হয়। কর অব্যাহতি দিলে তথ্যপ্রযুক্তি খাত এ দেশের জন্য হবে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। এ খাত এখন রাজস্ব না দিলেও কর্মসংস্থান দেবে, ডলার দেবে, আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেবে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অসংখ্য পণ্য রপ্তানি হয়। তবে সবচেয়ে মুনাফা অর্জন করে সফটওয়্যার খাত। একটা শার্ট একবার বানালে বারবার বিক্রি করা যায় না; কিন্তু সফটওয়্যার একবার একটা বানালে বারবার বিক্রি করা যায়। নিজ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছে বলেই যুক্তরাষ্ট্রে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়েছে অ্যাপল। বাংলাদেশেও টেক কোম্পানিকে আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত কর অবকাশের সুযোগ দিলে এ দেশে ফরেন রিজার্ভ রাখার জায়গা থাকবে না।

সদ্য আইটি কোম্পানিগুলো হাঁটিহাঁটি পা পা করে দাঁড়ানো শুরু করেছে। আর একটু ভালোমতো দাঁড়ালে বাংলাদেশকে রিটার্ন দেয়া শুরু করবে। এমন সময়ে কর অবকাশ না দিলে এ খাত আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। আমার সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা সিস্টেমস তৈরি করেছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বহুল সমাদৃত কোর ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার ‘ফ্লোরা ব্যাংক’। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেঙ্গল ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, দ্য ট্রাস্ট ব্যাংক, সীমন্ত ব্যাংক, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ মোট ৮টি ব্যাংকের ২ হাজার ২৫৫টি শাখায় এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে।

অনেকেই মনে করেন, আমার সফটওয়্যার বিদেশ থেকে নিয়ে আসা। আসলে এটা মেইড ইন বাংলাদেশ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান টেমেনোস বিশ্বের ১৪৫টি দেশের ব্যাংকিং সফটওয়্যার সেবা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যাংকিং সফটওয়্যার কোম্পানি থেকে সেবা নিয়ে আসছে। তবে বিশ্বের ১ নম্বর সিবিএস (কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার) প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রেখেছে এ দেশের অনেক ব্যাংক। ফলে বিদেশে মোটা অঙ্কের পেমেন্ট দিতে হচ্ছে না।  বিশ্ববাজারে আমার প্রতিষ্ঠানের মতো আরো অনেক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানই এভাবে সেবা দিচ্ছে। বিদেশে সফটওয়্যার বিক্রি করে দেশে টাকা নিয়ে আসছে।

আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাত যেভাবেই কাজ করি না কেন, দেশের রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছি। দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এমন প্রায় আড়াই হাজার ব্যবসায়ীকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। যারা কর অব্যাহতির সুযোগ পেয়ে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আগামী দিনেও তথ্যপ্রযুক্তি খাত আরেকটি গার্মেন্টস শিল্পের বিকল্প হিসেবে গড়ে তুলতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আইটি খাতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি চাই। মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেড, সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)।

টাইমলাইন: বেসিস নির্বাচন ২০২৪-২৬

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App