×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

তাজউদ্দীন আহমদ : স্বর্ণহৃদয় মানব

Icon

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তাজউদ্দীন আহমদ : স্বর্ণহৃদয় মানব
জীবিত বিশিষ্ট আমলাদের মধ্যে সর্বাধিক বয়োজ্যেষ্ঠ নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ মতিউল ইসলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব। জন্ম ১৯৩০ সালে। ১৯৪৬-এ কলকাতা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন। তিনি চেয়েছিলেন ডেন্টিস্ট হতে; কিন্তু তার সরকারি চাকুরে বাবার চাওয়া ভিন্ন- তাকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে হবে। ভর্তি হলেন কমার্স কলেজে; কিন্তু ১৯৪৭-এর ভারত ভাগ কলেজটাকেও ভাগ করল, একাংশ এসে সৃষ্টি হলো চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে পড়াশোনা ও আর্টিকেলশিপ শুরু করলেন। বড় ভাই নুরুল ইসলাম ১৯৫০ সালে সিএসপি হলেন (পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর); মতিউল ইসলামও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসলেন এবং ১৯৫২ সালে সিএসপি উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু করলেন। ইংরেজিতে লিখিত তার স্মৃতিকথা ‘রিকালেকশনস অব অ্যা সিভিল সার্ভেন্ট টার্নড ব্যাংকার’-এর একটি অধ্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রয়েছেন প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তার রচনা থেকেই অনুসৃত ‘তাজউদ্দীন আহমদ : স্বর্ণহৃদয় মানব’। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ শপথ নেয়া বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিপরিষদে তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, আর ১২ জানুয়ারি সকালে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সমন পেলাম। যখন দেখা করলাম তিনি তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন, আমাকে অর্থসচিব নিয়োগ করা হচ্ছে। তার আগে তাজউদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ আমার হয়নি, অন্যত্র তার সঙ্গে কোথাও আমার দেখাও হয়নি। কাজেই এটা স্পষ্ট আমার নিয়োগ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনার সুযোগ প্রধানমন্ত্রীর হয়নি। সিভিল সার্ভিসের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে সচিব যদি তার মন্ত্রীর সহযোগিতা এবং সক্রিয় সমর্থন না পান এবং মন্ত্রীর আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে না পারেন তা হলে তার পক্ষে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। সেই সময়ের জন্য এ কথা আরো বেশি প্রযোজ্য- যখন স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং ফলস্বরূপ পাকিস্তানের খণ্ডীকরণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত সম্পূর্ণ হযবরল অবস্থায় ছিল। এখন সময়ের দাবি হচ্ছে কার্যকরি এবং দ্রুত অনুমোদিত নীতিমালা এবং বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সচল করে তুলতে দৈনন্দিন ভিত্তিতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। সরকারের কোষাগার শূন্য, বৈদেশিক মুদ্রার সংরক্ষিত তহবিল শূন্য (বোম্বেতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের নামে জমাকৃত ভারত সরকার প্রদত্ত ৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল বাদে), ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সব রপ্তানির আয় পাকিস্তান সরকার আগেই নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। কালবিলম্ব না করে অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি শুরু করতে হবে যাতে দ্রব্যের মারাত্মক সংকট প্রকাশিত না হয়ে পড়ে এবং শিল্পকারখানা বন্ধ না হয়ে যায়। বাজেটের কোনো সুফল গ্রহণ ছাড়াই সরকার চালানোর খরচ জোগাতে হবে; নতুন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়েছে, বৈদেশিক দূতাবাস খোলা হয়েছে, ১ জুলাই ১৯৭২ থেকে আর্থিক বছরের জন্য বাজেট তৈরির প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে; এছাড়াও আরো অনেক সমস্যা দিগন্ত ছেয়ে ফেলেছে। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে মন্ত্রীদের কাছে আমার পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করা এবং তারপর চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করা। আমার নতুন দায়িত্ব গ্রহণের আগে ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার হেয়ার রোডের বাসায় গেলাম। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুসংখ্যক দর্শনার্থী অপেক্ষমাণ। সিঁড়ি বেয়ে তিনি নামতেই আমি নিজের পরিচয় দিলাম এবং ব্যাখ্যা করলাম, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়ে তার নির্দেশনা ও পরামর্শ নেয়ার জন্য এসেছি। আমরা যখন কথা বলতে শুরু করি ঠিক তখনই কাঁদতে কাঁদতে ও বিলাপ করতে করতে একজন নারী অর্থমন্ত্রীর কাছে এলেন এবং তার স্বামীকে বাঁচাতে ও উদ্ধার করতে বললেন; ভুলবশত দালাল সন্দেহে মুক্তিবাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল বিষয়টি তাজউদ্দীনকে নাড়া দিয়েছে, তিনি পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে ফোন করে হতভাগ্য ভিকটিমকে উদ্ধার করতে বললেন। যখন বুঝতে পারলাম গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বিষয়ে আলাপ করার সময় এটা নয়, আমি দ্রুত বেরিয়ে গেলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম তিনি যখন যথাযথভাবে তার অফিসে স্থিতিশীল হবেন, তখনই এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। এভাবেই একজন মানুষের সঙ্গে আমার দু’বছরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা যিনি বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন; বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রদ্রোহ এবং প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে লায়লপুর সেন্ট্রাল জেলে বিচারের যাতনা ভোগ করেছেন। তাজউদ্দীন একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ, কিন্তু যখনই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয় আসত তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিতেন। তিনি তার অফিসারদের বিশেষ করে আমাকে কাজ করার জন্য বড় ধরনের স্বাধীনতা দিয়েছেন; কিন্তু কোনো আদেশ অসুবিধের সৃষ্টি করলে কিংবা যথার্থ মনে না হলে তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে এবং আদেশ বাতিল করতে এতটুকু বিলম্ব করতেন না। কখনো কখনো হঠাৎ করে মেজাজ চড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার ঘটত এবং মুখের ওপর অফিসারদের গাল দিতেন; কিন্তু যদি তার মনে হতো যে অফিসারটির ক্ষতি হতে পারে, তিনি অবিলম্বে নিজেকে সামলে নিতেন। যে দু’বছর আমি তার সঙ্গে ছিলাম, আমাদের সম্পর্কের উত্থান পতন হয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি যখন মন্ত্রণালয় ছেড়ে বিশ্বব্যাংকে যোগ দিতে যাই সত্যিকারের এই স্বর্ণহৃদয় মানুষটির জন্য আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান অনুভব করি। আমার কাজের ধরনটা ছিল এমন যে, জরুরি ফাইল ও কেইস নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রীর কাছে যেতাম, তার কাছে ব্যাখ্যা করতাম এবং তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতাম। আমি তার সিদ্ধান্ত ও বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড করে রাখতাম। এমনই একটি বিষয় ছিল বিএসবি পুনর্গঠিত হওয়ার আগে যখন এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ছিল তখন তার প্রশাসক নিয়োগ। অর্থমন্ত্রী নথি পড়লেন, আমার সুপারিশ দেখলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, আমি অফিসারের পরিচিতি ভালো করে পরীক্ষা করেছি কিনা, তিনি কোলাবরেটর ছিলেন কিনা? আমার তাৎক্ষণিক জবাব ছিল- আমার সুপারিশের ভিত্তি তার যোগ্যতা এবং উন্নয়ন ব্যাংকার হিসেবে তার অভিজ্ঞতা; দালাল ছিলেন কিনা তা বের করা আমার অধিক্ষেত্রের বাইরে। অর্থমন্ত্রী প্রার্থীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তার নিজস্ব গোয়েন্দা সূত্রে পরীক্ষা করে নিতে পারেন। অর্থমন্ত্রী আর সামান্য দ্বিধান্বিত না হয়ে নিয়োগ অনুমোদন করলেন। তাজউদ্দীন সাহেব চমৎকার বাংলা লিখতেন, হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত জানালেন যে সচিবালয়ের সব নথি বাংলায় লিখিত হবে, আর এই সিদ্ধান্ত বাংলায় তার যে পাণ্ডিত্য তা প্রকাশ ও প্রদর্শনের সুযোগ এনে দিল। আমার বেলায় ঘটল ঠিক উল্টোটা; প্রথমত আমার বাংলা হাতের লেখা খুব বাজে এবং পাঠযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত আমার চিন্তা স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করার জন্য সঠিক এবং উপযুক্ত বাংলা শব্দ নির্ধারণ করতে আমার অনেকটা সময় লেগে যায়। সুতরাং আমি নথিতে কেইসগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার স্বার্থে অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ইংরেজিতে লেখার অনুমতি চাইলাম। দ্রুতই আমাকে অনুমতি দেয়া হলো, অর্থ মন্ত্রণালয়ে দু’বছর আমি নোট ইংরেজিতেই লিখেছি, অর্থমন্ত্রী লিখেছেন বাংলায়। একসময় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এখন সময় হয়েছে। অন্যান্য দেশে সফরের সময় পি ফরম পূরণ করা যেমন অত্যাবশ্যকীয়, ভারতের ক্ষেত্রেও ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য তা করতে হবে। প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করার নির্দেশ আমি বাংলাদেশ ব্যাংককে দিলাম, দ্রুত তা কার্যকর হলো। কিন্তু এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে এবং ভারতেও কি হবে আমি অনুমান করতে পারিনি। দ্রুত বিষয়টি অর্থমন্ত্রীর নজরে গেল এবং তিনি তার প্রতিক্রিয়া এভাবে আমাকে জানালেন; ইসলাম সাহেব এই আদেশ যে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে একটা গিঁটঠু লাগিয়ে দেবে। এটা বেশি আগে ভাগে করা হয়ে গেছে, প্রত্যাহার করা দরকার। দ্রুত আদেশটি প্রত্যাহার করে নেয়া হলো, কিন্তু ক’মাস পর আবার যখন তা বহাল করা হলো সীমান্তের দুই পাড়ে কোথাও কোনো উত্তেজনার সৃষ্টি হলো না এবং অর্থমন্ত্রীও বাধা দিলেন না। তাজউদ্দীন আহমদের একটি শিল্পীমন ছিল। বাংলাদেশের নোট ডিজাইন নিয়ে তিনি যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছেন, সে সময় ছাপা সব নোটের ডিজাইন উন্নত করতে তিনি যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছেন। যেহেতু অর্থমন্ত্রী একই সঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতেন, দুই ভূমিকার দুটি মন্ত্রণালয় তার কাজ আরো কঠিন করে তোলে। শিল্প খাতে বেসরকারি মালিকানা, সরকারি সংস্থার পুনর্গঠন, পরিকল্পনা কমিশনের জনবল নির্ধারণ ইত্যাদি পারস্পরিক বিরোধিতার বিষয়। অর্থমন্ত্রীকে তার দুই ভূমিকার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হতো, প্রায়ই দুটি ভিন্ন মতের সমন্বয় তাকে করতে হতো। অর্থ সচিবের মতামত নাকচ করে দেয়া অর্থমন্ত্রীর জন্য একটি সহজ ব্যাপার ছিল; কিন্তু তিনি খুব সতর্কভাবে এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতেন। তিনি এটা মেনে নিয়েছিলেন যে, এমনকি পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে তার মতামতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় স্বাধীন ও উন্মুক্তভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সভার একটি বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদিত ইপিআইডিসি (স্বাধীনতা আগেকার পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা) ভেঙে দশটি করপোরেট বডি তৈরি করার প্রস্তাব আমি প্রায় আটকে দিতে পেরেছিলাম। পাশ্চাত্য থেকে উন্নয়ন সহযোগিতা নেয়ার প্রশ্নে কেউ কেউ তাজউদ্দীন আহমদকে হার্ডলাইনার হিসেবে যে বর্ণনা দিয়েছে তা মোটেও যথার্থ নয় বরং উল্টোটাই সত্য। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারা বাংলাদেশে অর্ধদিবসের ঝটিকা সফরের সময় অর্থমন্ত্রী আমাকে নির্দেশ দিলেন যেন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভের জন্য আমাদের আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করি। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভের আবেদনের আগে আমাদের আইএমএফের সদস্য হতে হবে। তিনি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এবং আমাদের কাজের অগ্রগতি জানতে চেয়েছেন। ১৯৭২-এর জুন বা জুলাইয়ে যখন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের সদস্যপ্রার্থিতা গৃহীত হলো, প্রধানমন্ত্রী তাকে বাংলাদেশের পক্ষে আইএমএফের গভর্নর মনোনয়ন দিলেন। ফলে সঠিক সময়ে ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরে তিনি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় অংশ নিলেন। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভার আগে লন্ডনের মার্লবরো হাউসে কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছেন। ভারতীয় হাইকমিশনার ও ইকোনমিক কাউন্সিলর অর্জুন সেনগুপ্ত আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং জানালেন যেহেতু বর্তমান শেয়ারহোল্ডিংয়ের শক্তিতে ভারত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফে একজন নির্বাহী পরিচালক ও একজন বিকল্প পরিচালক মনোনয়ন দিতে পারছে না, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ভারতের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ করতে চান, তাতে ভারত উভয় প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পরিচালক মনোনয়ন দিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাব বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ব্যাংক ও আইএমএফে যথাক্রমে বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের পদ পাবে। আমাদের সিদ্ধান্ত জানাতে আমি তাদের কাছ থেকে সময় নিলাম, সৌভাগ্যবশত কিছু সময়ের জন্য ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে ছুটে গেল। এক সপ্তাহ পর দুজনই ফিরে এলেন এবং জানালেন তাদের প্রস্তাবটিকে আরো আকর্ষণীয় করতে এই প্যাকেজে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককেও যোগ করতে চান। তাতে বাংলাদেশ নির্বাহী পরিচালকের পদ লাভ করবে আর ভারত হবে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক। কিন্তু যেহেতু ভারত এর মধ্যেই নির্বাহী পরিচালক মনোনয়ন দিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশের জন্য তা দু’বছর পর থেকে কার্যকর হবে। এই সম্মতি ও ব্যবস্থাপনাতেই এ এম এ মুহিত ১৯৭৪ সালে ২ বছরের জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক নিযুক্ত হলেন। পরবর্তী সময় ভারত সরকার তার অবস্থান থেকে জানাল এই ব্যবস্থাপনা কেবল এক টার্মের জন্য। এরপর থেকে বাংলাদেশ এডিবিতে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মনোনয়ন দেবে। অর্থমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফরের বড় বিষয় ছিল বিশ্বব্যাংক প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে সাক্ষাৎ। বিশ্বব্যাংক সহায়তার প্রতি তাজউদ্দীনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু ভুল মন্তব্য প্রচলিত ছিল। তাজউদ্দীনের উদার ও প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি যে ম্যাকনামারাকে বিস্মিত করেছে তা তার অভিব্যক্তির আনন্দময় প্রকাশেই বোঝা গেছে। তার সঙ্গে তাজউদ্দীনের প্রথম মোলাকাত বেশ ভালোই কেটেছে। ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরে আমরা যখন ওয়াশিংটন যাই সে বছর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জানুয়ারির শূন্য থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ডলার যেখানে বিশ্ববাজারে আধিপত্য করছে সেখানে এই অঙ্কটি অবশ্যই একটি ‘প্রিন্সলি সাম’ এবং স্বস্তিকারক রিজার্ভ। এক্সপোর্ট শর্টফল অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট কিংবা ভিন্ন কোনো নামের হতে পারে, যে ঋণ তখন আইএমএফ নব অভ্যুদয়প্রাপ্ত দেশকে নিয়মিত প্রদানের যে প্রস্তাব দেয়, আমরা তার ভালোমন্দ নিয়ে যখন বিতর্ক করছিলাম তাজউদ্দীন দ্রুত সেই বিতর্কের যবনিকা টেনে আইএফএম ঋণ গ্রহণের সম্মতি জানিয়ে দিলেন। কারণ এটা কোনো ধরনের শর্তপ্রযুক্ত ঋণ নয়। ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App