চিম্বুক-থানচি-আলীকদম সড়ক
দুর্গম পাহাড়ে নতুন স্বপ্ন
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শুভরঞ্জন বড়–য়া, আলীকদম (বান্দরবান) থেকে : প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে লালিত এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলা। এই জেলার সৌন্দর্যে দেশি ও বিদেশি পর্যটকরা ব্যাপক আকৃষ্ট। একটা সময় আলীকদম-থানচি ও থানচি-চিম্বুকের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক ছিল। যোগাযোগের অভাবে দীর্ঘদিন দুর্গমে বসবাসকারী জনগণ বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা পূরণসহ আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত ছিল। দুই উপজেলার সামাজিক উন্নয়ন, পর্যটন শিল্প বিকাশ, দুর্গম অঞ্চলের নিরাপত্তাসহ দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় সরকার সেনাবাহিনীকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দায়িত্ব দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও অপহরণ নানা সমস্যা মোকাবিলা করে চিম্বুক-থানচি সড়ক নির্মাণ (রক্ষণাবেক্ষণ) প্রকল্প এবং থানচি আলীকদম সড়ক নির্মাণ (রক্ষণাবেক্ষণ) প্রকল্প দুটি ১৭ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন নির্মাণের সূচনালগ্ন থেকে বর্তমানে সুন্দরভাবে নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। চিম্বুক-থানচি সড়কটি বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চ পর্বতমালার উপর দিয়ে নির্মিত। দুর্গম সড়কটি এমুপাড়া, নীলগিরি, কাপ্রপাড়া, জীবন নগর এবং বলীপাড়াকে চিম্বুক তথা বান্দরবান, আলীকদম ও থানচির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। সড়কটি নির্মাণের পর এর রক্ষণাবেক্ষণ কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বাস্তবায়নের ফলে উল্লেখিত এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশসহ জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
বান্দরবান জেলার দুটি প্রত্যন্ত উপজেলা আলীকদম ও থানচির মধ্যে সহজ ও সরাসরি যোগাযোগ নিশ্চিত করতে পরবর্তীতে থানচি-আলীকদম সড়ক প্রকল্পটি নির্মাণ করা হয় এবং বর্তমানে এই প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ সুচারুভাবে সম্পাদন করা হচ্ছে। ফলে পার্শ্ববর্তী এলাকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও বনজ দ্রব্যের বাজারজাত, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে সহায়তার পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে।
১৭ ইসিবি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চলে অতি বৃষ্টির ফলে দুটি সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে পড়েছে। ফলে পটহোল তৈরি, ড্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে যায়। প্রতিকূল পরিবেশ এবং বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনস্থ ১৭ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন কঠোর পরিশ্রম করে সড়কের মেরামত করছেন। সাধারণ জনগণ ও পর্যটকদের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে বৃষ্টিতেও ১৭ ইসিবি সড়কের কাজ করছেন।
থানচি উপজেলার ১০ মাইল এলাকার জুমচাষি বিকাশ চাকমা, চিংহ্লা মারমা জানান, সড়কটি চালু হওয়ায় জুমে উৎপাদিত ধান, জব, গম, তুলা, তিল, ভুট্টা, চিনা বাদাম, সরিষা, আলু, মসুর ডাল, পাহাড়ি মরিচসহ নানা জাতের কৃষিপণ্য পরিবহনে সুবিধা হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং পরিবর্তন হচ্ছে স্থানীয়দের জীবনমান।
সড়কটি চালু হওয়ায় স্থানীয় শিশু-কিশোরদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি হওয়ায় দারুণ খুশি অভিভাবকরা। ভবিষ্যতে সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলে এলাকার ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখার সুযোগ পাবে। বর্তমানে প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শিশু-কিশোররা স্কুলে যাতায়াত করে, যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এ সড়ক নির্মাণের ফলে এলাকার শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা পাওয়া সহজ হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
কুরুকপাতা ইউপি চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো বলেন, বিভিন্ন পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি এবং অপহরণ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনস্থ ১৭ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের চলমান কাজ বন্ধ করতে পারেনি। দুইটি সড়ক নির্মাণের ফলে দুর্গমের মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। এ সড়কের পাশে ডিমপাহাড়ের অবস্থান। সারাদেশে এ পাহাড়টির সৌন্দর্যের কথা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন সড়ক পথে হাজার হাজার পর্যটক ডিমপাহাড়ের মেঘের সৌন্দর্য দেখতে আসে।
থানচি উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইহ্লা মং মারমা জানান, প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে শুরু করেছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। ক্রমেই উন্নত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাছাড়া এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সহজেই ভ্রমণ করতে পারছেন। এতে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে এবং কর্মসংস্থান হয়েছে বেকার যুবকদের। তিনি আরো বলেন, আলীকদম-থানচিন-চিম্বুক সড়ক নির্মিত হওয়ায় দুই উপজেলার প্রায় ৬০ হাজার পাহাড়ি-বাঙালি মানুষ নতুনভাবে স্বপ্ন দেখছেন। ইসিবি না হলে এই সড়ক কল্পনাও করা যেত না।