×

হাইকমান্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা!

Icon

মুহাম্মদ রুহুল আমিন

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাইকমান্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা!

ছবি: সংগৃহীত

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী ও এমপির স্বজনদের প্রার্থী হতে মানা করেছে আওয়ামী লীগ। মূলত তৃণমূলে দলের বিভেদ এড়াতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় এমপি যারা রয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা।

কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এ নির্দেশনায় সাড়া দিচ্ছেন না প্রার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে স্বজনরা এমপির নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যাচ্ছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের প্রচার-প্রচারণা। কেউ কেউ বলছেন জনগণের চাপে প্রার্থী হওয়ার কথা। কেউবা বলছেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য বিকৃত করে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থাপন করছেন। তাছাড়া দলীয় প্রতীক এই নির্বাচনে নেই, সুতরাং প্রার্থী হতে তারা কোনো বাধা দেখছেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলছে, প্রথম দফার নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগেই কোনো মন্তব্য নয়। পরবর্তী তিন ধাপে দলীয় নির্দেশনা মানাতে আরো কঠোর হবে হাইকমান্ড।

গত বৃহস্পতিবার আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও এমপির আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ওই দিন দুপুরে ধানমন্ডি কার্যালয়ে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করে দলের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। ওই দিন থেকেই সংগঠনিক সম্পাদকরা স্ব স্ব দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় এমপি-মন্ত্রীদের দলের এ কঠোর মনোভাবের কথা জানিয়ে তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। হাইকমান্ডের নির্দেশনা না মানলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও সতর্ক করেন তারা।

এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ভোটের মাঠে পুরোদমে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিরাও চাইছেন না তাদের নিজের প্রার্থীরা সরে দাঁড়াক। কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নিজের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা নির্বাচিত হলে এলাকায় কাজ করতে সহজ হয়। এতে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে দ্ব›দ্ব সৃষ্টির আশঙ্কাও থাকবে না। এলাকার উন্নয়ন কাজও সহজ হবে। কিন্তু দলের অন্য নেতাকর্মীরা বিষয়টি মানতে নারাজ।

তাদের মতে, এমপির পরিবারের সদস্যরা উপজেলা পরিষদের শীর্ষ পদে থাকলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা দলে মূল্যায়ন পাবে না। অন্যদের রাজনীতি করার সুযোগ কমে আসবে। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ভোরের কাগজকে জানান, আমাদের দলের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই তৃণমূলে পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু এমপিদের কেউ কেউ নানা টালবাহানা করছেন। তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যাইতে চাইছেন। কেউ কেউ বলছেন, আত্মীয়তা থাকলেও তাদের কথা শুনতে চাইছেন না সংশ্লিষ্ট প্রার্থী। নির্বাচন থেকে সরেও যেতে চাইছেন না তারা। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগেই একটা সমাধানে পৌঁছাতে। আশা করি, আমরা দলীয় নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারব। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন- এমন অনড় মনোভাব ভোরের কাগজের কাছে ব্যক্ত করেছেন কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থী, যাদের পরিবারে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আছেন।

এসব প্রার্থীর বেশির ভাগই বলেন, জনগণের চাপেই প্রার্থী হয়েছি। দল এবার প্রতীক দেয়নি। তাই নির্বাচন করতে কোনো বাধা দেখছি না। তাছাড়া নিজ যোগ্যতায় নির্বাচন করব, এখানে এমপির কোনো ভূমিকা থাকবে না। আমরা চাই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। তাদের দলীয় নির্দেশনার কথা জানানো হলে, প্রার্থীদের কেউ কেউ বলেন, আমরা নির্বাচন করব। বিজয়ী হব। দল নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে আমাদের মূল্যায়ন করবে।

কারণ হিসেবে জানা গেছে, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নৌকার বিরুদ্ধে যারা প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুসারে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে সবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে দলে ফেরত নেয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতেও সেভাইবেই তারা দলে ফিরবেন- এমন আশা করছেন তারা। তাই তারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। তবে কিছু এলাকায় এমপি-মন্ত্রীদের চাপে তাদের স্বজনরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্রের শেষ দিন আজ সোমবার তারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে পারেন।

এদিকে গত শনিবার ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কাছে জানতে চাওয়া হয় মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন না, সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান কী? জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, মনোনয়ন প্রত্যাহারের তারিখ শেষ হোক, তার আগে এ বিষয়ে কীভাবে বলা যাবে? মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা আগামীতে প্রার্থী হবেন, তাদেরও নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। যারা আছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত তাদের অবশ্যই মানতে হবে। নইলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অমান্য করে এখনো যারা মাঠে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য শাহাদারা মান্নানের ভাই ও ছেলে। সারিয়াকান্দি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন এমপির ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল। অপরদিকে সোনাতলা উপজেলার চেয়ারম্যান পদে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন এমপির ভাই মিনহাদুজ্জামান লিটন। লিটন বর্তমানেও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই দুই প্রার্থীর ভাষ্য, দলের নির্দেশনা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ এমপি তাদের আত্মীয় হলেও নির্বাচনে তিনি কোনো কাজ কারো পক্ষে করছেন না। তারা এও বলছেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করছেন। কাজেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তারা কোনো সমস্যা দেখছেন না বলেও জানান।

সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মিনহাদুজ্জামান লিটন অভিযোগ করেন, নাটোরের সিংড়া উপজেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যেসব মন্ত্রী-এমপি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছেন তাদের জন্য এই নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে। আমাদের জন্য নয়।

তার বক্তব্য, আমি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে থাকাকালে আমার বোন এমপি হয়েছে। বোন এমপি হওয়ার পর আমি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। এই নির্বাচনে এমপি আমাকে ও তার ছেলেকে কোনো সাপোর্ট দিচ্ছেন না। আমি বা আমার বোনের ছেলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকছে। যা নির্বাচন কমিশনের পছন্দ নয়। নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া দলের নেতাকর্মী ও আপামর জনগণ আমাদের চাইছেন। তাদের অনুরোধেই প্রার্থী হয়েছি। ইনশাল্লাহ বিজয়ী হতে পারব। দলকে বিজয় উপহার দেব।

নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরী। বর্তমানে এই উপজেলায় তিনবারের চেয়ারম্যান হলেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী। এবার তার বিরুদ্ধে ছেলেকে প্রার্থী করেছেন একরাম চৌধুরী। চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এরই মধ্যে একরাম চৌধুরীকে ফোন করে দলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। তিনি তার ছেলেকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু গতকালও শাবাব চৌধুরী ও তার লোকজন পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাহার করবেন কী না তা গতকাল রাত পর্যন্ত জানা যায়নি।

জেলার হাতিয়া উপজেলায় এবার চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী। তাকেও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা জানানো হয়েছে। কিন্তু গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশিক আলী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না। তিনি নির্বাচন করবেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ভোরের কাগজকে বলেন, তৃণমূলে কোন্দল এড়াতেই মন্ত্রী ও এমপির স্বজনদের এবার উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে মানা করা হয়েছে। আমরা সাড়া পাচ্ছি। প্রথম ধাপে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে তা স্পষ্ট হবে। পরবর্তী ধাপে যে সব নির্বাচন হবে সেখানে যাতে কেন্দ্রের নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মানা হয় সে বিষয়ে আমাদের নজরদারি থাকবে। যারা দলের নির্দেশনা মানবেন না, তাদের জন্য সাংগঠনিক ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত; চার ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৮ই মে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আজ মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। আগামীকাল প্রতীক বরাদ্দ হবে। এরপরই আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণায় নামবেন প্রার্থীরা। দ্বিতীয় ধাপে ১৬১ উপজেলায় নির্বাচন হবে ২১ মে। এরপর আরো দুই ধাপে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App