×

মুক্তচিন্তা

মীমাংসা না হলে মুক্তি নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:১১ পিএম

বই লেখার ব্যাপারে হেফাজতওয়ালাদের সন্তুষ্ট রাখবার আশঙ্কার বিষয়টা উল্লেখযোগ্য। স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে তাদের হস্তক্ষেপটা কিন্তু মোটেই আবছা নেই, বেশ স্পষ্টভাবেই নিজেকে জাহির করে ফেলেছে। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনার যে দাবিগুলো মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল তাদের সবই মেনে নেয়া হয়েছে। হেফাজত বিবৃতি দিয়ে এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং হেফাজতিকরণের বিরুদ্ধবাদীদের সতর্ক করে দিতে ছাড়েনি। আইয়ুব-মোনায়েমের অন্ধকার শাসনামলে এ ধরনের পরিবর্তন আনার কোশেস করা হয়েছিল, প্রতিবাদের মুখে কর্তাদের সে অভিপ্রায় ভেস্তে গেছে। সে কালে অত্যন্ত পরিচিত একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তির- ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’- পাকিস্তানি সংস্করণ তৈরি করা হয়েছিল এভাবে- ‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি/ তামাম রোজ আমি যেন নেক হয়ে চলি’। কাজটা করেছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। টেকেনি। গোলাম মোস্তফা নজরুল কাব্যের ‘অপ্রয়োজনীয়’ অংশ বাদ দেয়ার আঞ্জামও করেছিলেন। লোকে হাস্য-পরিহাস করেছে। রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীতের নির্বাসন ঘটানোর সরকারি উদ্যোগও পাল্টা প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করেছে, রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটি গানই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। মোনেম খাঁ জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার নাম বদলে নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘দাওয়াত’। ডিমকে ‘আন্ডা’ বলার দরুন উৎফুল্ল হয়ে একজন অধ্যাপককে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালকের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলেন, এমন জনশ্রæতি আছে। পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি নামে ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা-সংবলিত একটি বইপাঠ্য করা হয়েছিল ক্লাস নাইনে; ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে সেটিকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

এখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের শাসনামলে ওইসব ভ‚তপ্রেত আবার ফেরত এসেছে। অবিশ্বাস্য সব ঘটনা অবিশ্বাস্য প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল একটি ঘটনার কথা জানাচ্ছেন। ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এক লিখিত প্রস্তাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে মোট ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলেছিল। এর মধ্যে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২টি পাঠ্যবই ছাপা হওয়ার পর নজরে এলো হেফাজতের নির্দেশনা বা দাবি অনুযায়ী দুটি লেখা বাদ পড়েনি। [...] দুই শ্রেণিতে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার বই ছাপা হয়ে গেছে। এগুলো গুদামে রেখে ও লেখা দুটি বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপা হলো।’ (সাপ্তাহিক একতা, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭) গুদামে রাখা বইগুলো নাকি রাতের আঁধারে ঢাকার অদূরে নিয়ে বিশাল গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। (এ এন রাশেদা, বাংলাদেশের শিক্ষাধারার বিপজ্জনক গতিপ্রকৃতি, নতুন দিগন্ত, এপ্রিল-জুন ২০১৭) একাত্তরের গণকবরগুলোর কথা মনে পড়ে কি?

এই যে ভূতপ্রেতগুলো ফিরে ফিরে আসে, উত্ত্যক্ত করে, এরা কারা? কী এদের পরিচয়? বলা যাবে এরা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। সেটা বলা হচ্ছেও। বলাটা সহজও বটে। কিন্তু পাকিস্তান নিজেই তো এখন বিলুপ্তির পথে। তার প্রেতাত্মা কি এতই শক্তিশালী যে দুষ্কর্ম করতে আমাদের দেশ পর্যন্ত চলে আসবে? আসল ব্যাপার অন্য। সেটি হচ্ছে পুঁজিবাদের হচ্ছে দৌরাত্ম্য। রামপ্রসাদী গান আছে না, যেমনি নাচাও তেমনি নাচি; তোমার কাজ তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি? ব্যাপারটা অবিকল সেই রকমের। তবে পুঁজিবাদ মাতা নয়, পুঁজিবাদ হচ্ছে পিতা। কিন্তু মূল ঘটনা হচ্ছে এই যে বিশ্ব এখন পুঁজিবাদের হাতে পুতুল; মহা ক্ষমতাধররাও তার হাতে-ধরা ও হাত-ধরা পুতুলই। তারা অবশ্য জানে না যে তারা ক্রীড়নকই, ভাবে তারা স্বাধীন, মনে করে তারাই কর্তা।

বাংলাদেশ আমরা দাবি করে থাকি যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের নবযাত্রার সূত্রপাত। দাবিটা সত্য এবং ওই যাত্রাটা ছিল পুঁজিবাদবিরোধী। পুঁজিবাদী ইংরেজ শাসকরা আমাদের ঘাড়ে তাদের ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল; আমরা নতুন রাষ্ট্রভাষা চেয়েছিলাম। পুঁজিবাদী পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরা চেয়েছিল উর্দু চাপাবে, আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। উর্দু চাপানোর চেষ্টার পেছনে যুক্তিটা ছিল সামন্তবাদী; বলা হচ্ছিল বাংলার তুলনায় উর্দু বেশি পরিমাণে ইসলামসম্মত। কিন্তু ভাষা চাপানোর পেছনকার ইচ্ছাটা ছিল পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব কায়েম রাখবার। পাকিস্তান রাষ্ট্রের চৌহদ্দি ভেঙে আমরা সবেগে বেরিয়ে এসেছি; কিন্তু পুঁজিবাদ আমাদের ছাড়েনি। সে আরো শক্তিশালী হয়ে দৌরাত্ম্য করছে, আমাদের ইচ্ছামতো নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। পুঁজিবাদী শাসন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তিন ধারায় বিভক্ত করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার কাছে আনবার কথা মুখে বলছে, কিন্তু হেফাজতিদের চাপের মুখে মূল ধারাকেই বরঞ্চ মাদ্রাসার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নির্দয়ভাবে। এতে শাসক শ্রেণির কোনো ক্ষতি নেই, কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা এখন আর মূলধারাতে নেই, তারা ইংরেজি ধারাতে চলে গেছে, কিংবা যাওয়ার চেষ্টায় আছে। বঞ্চিত মানুষরাই মাদ্রাসায় পড়ে; তাদের তুলনায় কম বঞ্চিতরা রয়েছে মূল ধারাতে।

মূলধারা এবং মাদ্রাসা কাছাকাছি চলে এলে বঞ্চিতের সংখ্যা বাড়বে; সুবিধাভোগীদের তাতে অসুবিধা নেই, সুবিধাই আছে, তারা ফুলতে ও ফাঁপতে থাকবে, এখন যেমনটা ফুলছে ও ফাঁপছে। এরই মধ্যে আবার আওয়াজ উঠেছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবেনা। এরআগে হাইকোর্ট এলাকা থেকে একটি স্থাপত্য সরিয়ে ফেলতে হবে। দাবিটা তুলেছে হেফাজতে ইসলাম এবং আওয়ামী ওলামা লীগ, এক সঙ্গে। এই সংযোগটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয়। আওয়ামী লীগ বলেনি যে ওলামা লীগ তাদের অঙ্গ সংগঠন নয়। সংবিধানের মূলনীতিতে এখন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ পর্যন্ত চলে এসেছে এবং ওই বোঝা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করবার কোনো ইচ্ছা আওয়ামী লীগ সরকারের নেই। আশঙ্কা করবার কারণ আছে যে, হেফাজত ও আওয়ামী ওলামা লীগ মিলেমিশে তাদের কণ্ঠকে আরো বুলন্দ করবে এবং পাঠ্যপুস্তকগুলো আরো বেশি সাম্প্রদায়িক হবে, ভাস্কর্য অপসারণ আন্দোলনেরও বিস্তার ঘটতে থাকবে।

দুই. তাহলে উপায় কী? এই দুঃসহ ব্যবস্থা ও অবস্থা কি চলতেই থাকবে? আমরা কী এই ব্যবস্থাটাকে মেনে নেব, কেবল ক্ষোভ-বিক্ষোভ কটুকাটব্যই করতে থাকব? অথবা নিউইয়র্ক প্রবাসী মেহনতি বাঙালিটির মতো আমরা কি পা ধরে ক্ষমা চাইবÑ কর্তাদের কাছে? নাকি চরম হতাশায় একা একা প্রতিবাদ করব এবং শেষ করে দেব নিজেকে ও আপনজনদের, বস্তিবাসী ওই বধূটি যেমন করেছে। এ দুটির কোনোটিই যে পথ নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পথটা হলো ঐক্যবদ্ধ, ধারাবাহিক ও ক্রমবর্ধমান আন্দোলন। তার আগে অবশ্য মূল শত্রুটিকে চিহ্নিত করা দরকার হবে। পুঁজিবাদই যে মূল শত্রু তাকে চিনে নেয়ার সময় করপোরেট পুঁজিবাদ, ক্রনি পুঁজিবাদ, বিকৃত পুঁজিবাদ, পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদ এসব অস্পষ্টতা রেখে লাভ নেই। পুঁজিবাদ পুঁজিবাদই এবং সে এখন তার শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, রূপ নিয়েছে ফ্যাসিবাদের। বিশ্বব্যাপী তার দৌরাত্ম্য হাঁসফাঁস করছে। পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা দরকার হবে সমাজতান্ত্রিক সামাজিক মালিকানার।

সভ্যতা আজ অপেক্ষা করছে একটি নতুন মোড় নেয়ার। সে পৌঁছাতে চায় এমন একটি ব্যবস্থায় যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা শোষণমূলক হবে না, হবে মৈত্রীর। যেখানে কাজের কোনো অভাব থাকবে না, জীবিকার জন্য কাজের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে জীবনের জন্য কাজ, জীবন সমৃদ্ধ হবে সৌন্দর্যে ও আনন্দে। ভোগে নয়, আনন্দে। তার জন্য যারা লড়বেন তাদের অবশ্যই নিজ নিজ শ্রেণি স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। দরকার হবে প্রভ‚ত পরিমাণে ও অবিরাম ধারায় জ্ঞানের চর্চা করার। ওই জ্ঞান যেমন হবে তাত্তি¡ক তেমনি হবে বাস্তবিক; বাস্তবিক অবস্থার পর্যালোচনার জন্য চাহিদা থাকবে তত্তে¡র এবং তাত্তি¡ক জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে বাস্তবিক অভিজ্ঞতায়। তত্ত¡হীন অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োগবিহীন তত্তে¡র প্রথমটি যেমন অন্ধ দ্বিতীয়টি তেমনি বন্ধ্যা।

জ্ঞানের অনুশীলন কিন্তু বাংলাদেশে ভালো মতো হচ্ছে না। এর চর্চায় বুর্জোয়ারা উৎসাহ পায় না। ওদিকে গোটা ব্যবস্থাটাই নিরুৎসাহিত করছে জ্ঞানানুশীলনকে। সেজন্য দেখা যায় আওয়াজ যত পাওয়া যায় সারবস্তু তত পাওয়া যায় না এবং সারবস্তুর অপর্যাপ্ততার কারণেই আওয়াজটা বুলন্দ হয়ে ওঠে। কিন্তু বামপন্থিদের তো জ্ঞান ছাড়া চলবে না। বামপন্থিদের মধ্যে জ্ঞানচর্চার অনুৎসাহটা হৃদয়বিদারক। সমাজ বিপ্লবের জন্য শিক্ষিত হৃদয় এবং শিক্ষিত মস্তিষ্ক দুটিই অত্যাবশ্যক। পৃথিবীতে যত সমাজবিপ্লব হয়েছে প্রত্যেকটির পেছনেই জ্ঞান ও বিবেকের চর্চা ছিল একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। বাংলাদেশের বুর্জোয়ারা যা করবার করুক, বামপন্থিরা যে বই লেখেন না, প্রবন্ধ ছাপান না, তাদের যে দৈনিক পত্রিকা দূরের কথা একটা সাপ্তাহিক পত্রিকাও নেই তাতে পুঁজিবাদের খুবই সুবিধা হচ্ছে। আর পুঁজিবাদের সুবিধাই তো সমাজবিপ্লবের জন্য অসুবিধা।

ভালো কথা, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ছাত্রসংসদ নেই তার দ্বারা কি এটা প্রমাণিত হয় না যে আমাদের শাসক শ্রেণি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না, ভাবে কেবল নিজেদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে? কিন্তু যারা বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক তাদের তো ভাবতে হবে, ভাবতে হবে যে অপরিহার্য পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনটিকে ব্যাপ্ত করতে হবে সর্বত্র এবং সর্বপ্রকারে। নতুন একটি সভ্যতার জন্ম পৃথিবীব্যাপী ঘটবে, ঘটতে হবে বাংলাদেশেও। সেটা আপনা থেকে ঘটবে না, ঘটাবে মানুষই; হাত মিলিয়ে। এবং অবশ্যই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। পুঁজিবাদের ভেতরকার দ্বন্দ্বটা এখন চরম আকার ধারণ করেছে, তাকে ধাক্কা দেয়া চাই ভেতর থেকেই। সারা বিশ্বেই এখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। যুদ্ধটা তাই আন্তর্জাতিকও। এর মীমাংসা না হলে মুক্তি নেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App