×

মুক্তচিন্তা

শেয়ার বাজারের রিপোর্ট বিভ্রান্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২০, ০৮:৪১ পিএম

শেয়ার বাজারের রিপোর্ট বিভ্রান্তি

প্রতীকী ছবি

গত সপ্তাহে (১৮-২৪ অক্টোবর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার লেনদেন সম্পর্কে কোনো কোনো পত্রিকায় এই মর্মে রিপোর্ট দিয়েছে যে আলোচিত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন যা মোটেই ঠিক নয়। আলোচ্য সপ্তাহে ডিএইর মূলধন সপ্তাহের শুরুতে যা ছিল, শেষের দিনে তা থেকে মোট ১৯৭৬ কোটি টাকা কমেছে। বাজার মূলধন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে এরকম শিরোনাম দেয়ার কথা নয়। এ নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। মনে করি একটি কোম্পানির ১ লাখ শেয়ার তালিকাভুক্ত করা আছে। বাজার মূলধন কি? একটি নির্দিষ্ট দিনে বাজার মূলধন অনুযায়ী সেই কোম্পানির সমুদয় শেয়ারের মূল্য হলো সেই কোম্পানির বাজার মূলধন। শেয়ারের দাম ওঠানামা করার সঙ্গে বাজার মূলধনও বাড়বে কমবে। আমরা যে ১ লাখ শেয়ারের কথা বললাম, মনে করি প্রতিটি শেয়ারের বাজার মূল্য ২০০ টাকা। তাহলে ওই কোম্পানির বাজার মূলধন ২ কোটি টাকা। স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির ১০০ শেয়ার ১৫০ টাকায় বিক্রি হলো। ফলে কোম্পানিটির বাজার মূলধন হলো দেড় কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা কমেছে। অথচ শেয়ার লেনদেন হয়েছে মাত্র ১০০টি। বাজার মূলধনের অন্তর্নিহিত মূল্য (INTRINSIC VALUE) নেই। শেয়ার বাজারের সূচক তৈরিতে এর ভ‚মিকা রয়েছে। শেয়ারের দর ওঠানামা গতি প্রকৃতি অনুধাবন করতে এই সূচকের যথাযথ গুরুত্ব রয়েছে। সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এসব কিছুতে সূচকের গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতে এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে, যে পরিমাণ বাজার মূলধন কমেছে, ঠিক সেই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে হারিয়েছে। এই যে শিরোনাম দেয়া হয়েছে যে আলোচ্য সপ্তাহে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ২ হাজার কোটি খুইয়েছেন, এটি কিন্তু আতঙ্কজনক সংবাদ। ডিএসসিতে এমন বোধহয় গড়ে দৈনিক ১ হাজার কোটি টাকার নিচে লেনদেন হয়, সেখানে প্রতিদিন ৪০০ কোটি টাকা লোকসান হওয়াটা উদ্বেগজনক বৈকি। তথ্যানুযায়ী এমন বিও একাউন্টসের সংখ্যা মাত্র ২৩-২৫ লাখ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার শতকরা দুজনও নয়। গত দুইটা বিপর্যয়ের ফলে বহু সাধারণ বিনিয়োগকারী মুখ ফিরিয়ে এনেছে শেয়ার বাজার থেকে। বাজার যে বিনিয়োগকারী নেই, তা তো নয় অর্থাৎ বিভাগ থেকে ক’দিন আগে জানানো হয়েছে যে সঞ্চয় বিভাগে বিনিয়োগকারীর ভিড় বাড়ছে। ইতোমধ্যে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছেছে। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে আবহমান কাল থেকে শেয়ার মার্কেট স্পর্শকাতর। যে কোনো গুজব, যে কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা, যে কোনো রাষ্ট্রীয় অঘটন শেয়ার বাজারে বিপর্যয়ে নিয়ে আসে। এখানে ভারতের ২০০৪ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করতে চাই, সেবার ভারতের বামপন্থিরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বোধ নির্বাচনে জয়লাভ করল। যেহেতু কমিউনিস্টরা রয়েছে, অতএব পুঁজিবাদ থাকবে না, এরকম অলীক কল্পনায় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বোম্বে শেয়ার বাজারে এমন বিপর্যয় নামল যে মার্কেট বন্ধ হয়ে গেল। অথচ আজকাল পরিকল্পিত নীতিতে সরকারের অর্থনীতি পরিচালিত হয়। তাছাড়া বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তনেও সময়ের ব্যাপার। এছাড়া কমিউনিস্টরা একাই সেই সংসদে ছিল না। শেয়ার বাজার এসব কিছুই বিবেচনায় আনল না। উন্মাদের মতো কাজ করে বসল। আগেই উল্লেখ করেছি যে আমাদের শেয়ার বাজার ছোট। তাছাড়া নানা ঘটনায় বিশেষ করে বিচারহীনতার অভ্যাসে বেশ কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজার বিমুখ হয়েছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ফলে শেয়ার বাজারের পদক্ষেপ এখন বেশ ইতিবাচক, যদি শেয়ার বাজার ডিমিউচুয়ালাইজড না হতো, তাহলে এতদিনে আরেকটি বিপর্যয় হতো। যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬ এবং ২০০৯-১০ সালে। সেজন্য বলছি যে চমক দেয়ার জন্য এমন কোনো শিরোনামে সংবাদ শিরোনাম হওয়া উচিত নয় যাতে শেয়ার বাজারের বিরুদ্ধে আতঙ্ক ছড়ানোর সুযোগ পাওয়া যায়। এক সময়ে বিও একাউন্টের সংখ্যা সম্ভত ৩৪-৩৫ লাখ হয়েছিল। শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব হবে এই সংখ্যা বাড়ানো। এদের সংখ্যা যত বাড়বে আইপিওর সংখ্যা বাড়ানো তত সহজ হবে। এখানে আর একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। পুঁজিবাজারের বড় ভ‚মিকা ছিল বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা। শিল্প এবং বিভিন্ন অবকাঠামোর এই পুঁজি সরবরাহ করা হতো। ফলে ব্যাংক ঋণ নেয়া হয় শুধু চলতি মূলধনের জন্য। কেননা স্থায়ী পুঁজি তো বিনিয়োগকারীরা সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে অর্থের এক ভয়াবহ যন্ত্র বেরিয়েছে। পূর্বে অর্থ বিনিয়োগ মানে কোনো পণ্য উৎপাদন বা সেবা প্রদানের জন্য। পুঁজির বিনিয়োগ মানে সম্পদ বৃদ্ধি সেটা ব্যবহারের জন্য হোক বা সেবার জন্য। এমন মানসিকতা হয়েছে যে অর্থ থেকে অর্থ শোষণ করা। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়। Financialisation আমরা লক্ষ করেছি যে যতবার শেয়ার বাজার খুব ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, ততবার একদল জ্ঞানী ব্যক্তি চিৎকার করেছেন যে অধিক পরিমাণ টাকা সরবরাহ করা হোক। ব্যাংক তাদের ভাণ্ডার উজাড় করে দিক শেয়ার কেনার জন্য। শেয়ারের মূল্যের সীমারেখা হবে আকাশ। অথচ বক্তব্য এরকম হওয়া উচিত যে অধিক পরিমাণে। শেয়ার বাজারে আনা উচিত এবং আইপিওর সংখ্যা যেন বা১ড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বিনিয়োগকারীদের অর্থ যেন সম্পদ বৃদ্ধিতে ব্যয় হয়। জনগণের অর্থ রাষ্ট্রের সম্পদ বৃদ্ধির প্রবাহে সম্পৃক্ত হয়। প্রতিযোগিতা দিয়ে অস্বাভাবিক মূল্যে কি লাভ হবে একজন বিনিয়োগকারীর। বোধহয় দুই যুগ হয়ে গেল কয়েকটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে অথচ আজ পর্যন্ত একটি শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়নি। এ যেন Hamlet without the prince of Denmark. তাছাড়া রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আরো কিছু শেয়ার রয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বহুবার কথা দিয়েছিলেন যে, শেয়ার জনগণের মাঝে আইপিওর মাধ্যমে ছাড়া হবে। বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তবে মুহিতের বড় অবদান স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন কর্মকর্তারা নবোদ্যমে কাজ শুরু করেছেন বলে তারা দাবি করছেন। আমরা আশা করব যে পুঁজিবাজার অধিক সক্রিয় হবে এবং পুঁজিবাজার শক্তিশালী হবে বিনিয়োগকারীদের অর্থে, ব্যাংকের ঋণে নয়। সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App