×

মুক্তচিন্তা

‘ধর্ষণ’ কি সমাজের গতিমুখের ইশারা দেয়!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২০, ০৬:৩১ পিএম

সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে ধর্ষণবিরোধী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তার চেয়ে অধিক জরুরি ধর্ষণবিরোধী আমাদের সম্মিলিত সক্রিয়তা। আর সমাজে বিদ্যমান পুরুষাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্মিলিতভাবে দাঁড়াতে হবে, যাতে বিদ্যমান লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতার অসম সম্পর্ক ভেঙে সবার সমমর্যাদার এবং সমানাধিকারের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যে সমাজে পুরুষ নারীকে মানুষের মর্যাদা দেয় এবং মানুষ হিসেবে সম্মান করে, সে সমাজে ‘ধর্ষণ’র মতো ক্যানসার দ্রুতগতিতেই বিতাড়িত হতে বাধ্য।

শুরুতেই একটা কৈফিয়ত দিয়ে রাখি যে, ‘ধর্ষণ’ শব্দটার ব্যবহার নিয়ে আমার একটা মোটা দাগের আপত্তি আছে, কেননা এ শব্দের ভেতর দিয়ে মুখ্যত এবং প্রধানত নির্যাতিতাই উপস্থাপিত হয়। কিন্তু যে ধর্ষণ করেছে, ‘ধর্ষণ’ শব্দের মধ্যে সে কেন জানি গৌণ হয়ে হাজির। যে ধর্ষণের মতো একটি জঘন্য কাজ করেছে, সে ‘ধর্ষণ’ শব্দটার মধ্যে কীভাবে যেন কর্তা অনুপস্থিত। প্রকারান্তরে যে এ নির্মমতার শিকার হয়েছেন, যার ওপর অত্যাচার হয়েছে এবং যার ওপর নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন হয়েছে, ‘ধর্ষণ’ শব্দটার মধ্যে তিনিই প্রবলভাবে উপস্থিত থাকেন। ‘ধর্ষণ’ শব্দের মধ্যে ধর্ষক প্যাসিভ কিন্তু ধর্ষিতা এক্টিভ থাকেন, এটা অগ্রহণযোগ্য। তাছাড়া ‘ধর্ষণ’ শব্দটার বারবার উচ্চারণের ভেতর দিয়ে ঘটনা দগদগে ভাবটিকে জিইয়ে রাখার একটা অচেতন মনোযোগ থাকে বলেও আমার মনে হয়। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ‘ধর্ষণ’ শব্দটার একটা বিকল্প শব্দ বা প্রত্যয় ব্যবহার করা জরুরি যেখানে ভিকটিমস মুখ্য না হয়ে, যে ঘটনা ঘটিয়েছে তার উপস্থিতি এবং তার ন্যক্কারজনক ভ‚মিকা প্রতিবিম্বিত হবে। কিন্তু আমি সাধারণ্যে প্রচলিত এবং সহজে বোধগম্য বিধায় নিজের জোর আপত্তি সত্তে¡ও খানিকটা খুঁতখুঁতানি নিয়ে ‘ধর্ষণ’র আলোচনা করতে গিয়ে ‘ধর্ষণ’ শব্দটিই ব্যবহার করছি। শুরুতেই কৈফিয়ত দিয়ে রাখলাম পাঠকের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির বাসনায়।

হঠাৎ করে সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। অন্তত মিডিয়ার ব্যাপক কভারেজ দেখে সহজে অনুমেয় যে, সমাজে হঠাৎ করে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, ধর্ষণ একটি অত্যন্ত বর্বরোচিত কাজ; অত্যন্ত জঘন্য, ঘৃণ্য এবং ন্যক্কারজনক কাজ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজে কি ধর্ষণের ঘটনা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে? নাকি মিডিয়ায় হঠাৎ করে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক কভারেজ পাচ্ছে? নাকি আমরা হুজুগে জাতি বলে, ধর্ষকরা একটা ঘটনা থেকে আরো উৎসাহী হয়ে আরো অধিক ঘটনা ঘটাচ্ছে? তাহলে সমাজের একটা অংশের মানুষ কি হঠাৎ করে বর্বর হয়ে উঠেছে? নাকি সমাজের একটা অংশ সবসময় বর্বর ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে? এসব প্রশ্ন গভীর মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে কিছু ভয়াবহ উত্তরের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে। কেননা যেসব ধর্ষণের ঘটনা সমাজে ঘটছে তার চরিত্র, স্বরূপ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে, সমাজের বিকাশ এবং বিস্তারের ধারাবাহিকতায় আমরা কোথায় আছি, কোন দিকে যাচ্ছি এবং সমাজের গতিমুখের নিশানা কী, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। আর তখনই সমাজের একটা ভয়াবহ চেহারা আমরা দেখতে পাব। কেননা ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে মাদকাসক্ত, লম্পট, বখাটে তরুণ-যুবক থেকে শুরু করে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাত, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-মুরিদ এবং গির্জার পাদ্রি কেউই বাকি নেই। তাহলে এসব কীসের আলামত? তাহলে কী ‘ধর্ষণ’ সমাজের গতিমুখ কোনদিকে যাবে, তার পরোক্ষ ইশারা দিচ্ছে? সকাল যদি দিনের চেহারার ধারণা দেয়, তাহলে দুপুর কি সন্ধ্যার আভাস দেয় না? আকলমানকে লিয়ে যদি ইশারাই কাফি হয়, তাহলে ‘ধর্ষণ’র সর্বগ্রাসী, সর্বশ্রেণি এবং সর্বস্তরগামী চরিত্র কি সমাজের গতিমুখের ইশারা দেয় না?

আমরা কি কখনো গভীর মনোযোগের সঙ্গে একবার ভেবেছি, কেন তিন বছরের মেয়ে ধর্ষিত হয়? পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী কেন ধর্ষিত হয়? মাদ্রার ছাত্র কেন মাদ্রাসার হুজুর দ্বারা ধর্ষিত হয়? কেন চার্চে আটকে রেখে একজন শিশুকে চার্চের ফাদার ধর্ষণ করে? কেন ৭০ বছরের বৃদ্ধা অজু করতে গিয়ে ধর্ষিত হয় (অক্টোবরের ২ তারিখ মুন্সীগঞ্জের এ ঘটনা ঘটেছে)? সারাদেশে ধর্ষণের সাধারণ চরিত্রের বাইরে এসব ঘটনা কি সমাজের বিকাশ ও বিস্তারের অসম এবং অস্বাভাবিক গতিমুখকে নির্দেশ করে না? ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৫ হাজার ৪০০টি। বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রতি লাখে দাঁড়ায় প্রায় ৩.৮০ জন। কিন্তু ১৯৯১ সালে ধর্ষণের হার ছিল ০.৩৯ জন, ২০০১ সালে ছিল ২.৩৭ জন, ২০১১ সালে ছিল ২.৩৮ এবং ২০১৮ সালে ছিল ২.৪৫ জন। যার মানে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে প্রতি লাখে ধর্ষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৩৫ জন। এটা ২০১৯ সালের বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ওয়েবসাইটের তথ্য। কিন্তু সংখ্যার এ পরিবৃদ্ধিকে কেবলই মানুষের যৌনতার বিকৃতির পরিবৃদ্ধি হিসেবে দেখলে চলবে না। দেখতে হবে, ক্ষমতার জায়গা থেকেও অর্থাৎ সমাজে বিদ্যমান নারী ও পুরুষের ক্ষমতার অসম বিন্যাস থেকেও। সমাজে বিদ্যমান পুরুষাধিপত্য এবং নারীর অধস্তনতাকেও এখানে পাশাপাশি রেখে সমাজে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনাকে এবং পরিসংখ্যানকে মূল্যায়ন করতে হবে। এটাকে কেবলই একটি ‘আইনশৃঙ্খলা অবনতি’ ট্রেডমার্ক দিয়ে বিচার করলে সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বিদ্যমান অসম ক্ষমতার সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। আর এ পাশ কাটিয়ে যাওয়া প্রকারান্তরে সমাজে পুরুষাধিপত্যকে প্রশ্রয় জোগায় এবং নারী অধস্তনতাকে স্থায়িত্ব দেয়ায় সহায়তা করে। এখানে নারী-পুরুষের মধ্যকার ক্ষমতার অসম সম্পর্ককে গোড়ার বিষয় হিসেবে দেখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব বা নারীদের নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে নারীর ওপর পুরুষের বিদ্যমান অধিপতিশীল প্রবণতাকে জায়েজ করার শামিল। যৌনতার স্বাধীনতা সর্বজনীন। কিন্তু কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌনতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নারীর ওপর পুরুষের ক্ষমতা এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং প্রমাণের একটি পরোক্ষ বাস্তবতা এখানে উপস্থাপনের একটা চেষ্টা আছে, সেটাকে মেনে নিয়েই ধর্ষণের বিশ্লেষণ এবং বিচার করতে হবে। অন্যথায় ধর্ষণকে কেবলই একটি অপরাধ হিসেবে উপস্থাপনা, তার বিশ্লেষণ এবং বিচারের প্রক্রিয়া ধর্ষণের গোড়ার গলদকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার শামিল। সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের জ্ঞানকে এবং জেন্ডারভিত্তিক ক্ষমতার সম্পর্ক সম্পর্কিত জ্ঞানকাণ্ডকে এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে।

সিলেটের ঘটনার পর আমাদের মৌসুমি সচেতনতার পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে। কিন্তু বেড়াতে গিয়ে স্বামীর সামনে ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা এটাই বাংলাদেশে প্রথম হয়েছে তা নয়। তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করলে বিগত কয়েক দশকে এ রকম অসংখ্য ঘটনার নজির পাওয়া যাবে। দলগত ধর্ষণের ঘটনাও বাংলাদেশে নতুন নয়, কেননা বাংলাদেশের এ রকম ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে। কিছুদিন বিরতি দিয়ে দিয়ে এ রকম একেকটা সেনসেশনার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে! তখন আমাদের নীতি-নৈতিকতার বারুদ হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে! চতুর্দিকে হৈচৈ পড়ে যায়! মিডিয়ায় বিস্তর লেখালেখি চলে! প্রাইভেট টেলিভিশনগুলোয় রাত-বিরাতের টকশো চলে! বিবৃতিজীবীরা বিবৃতি দেয়ার মওকা পায়! অধিকারকর্মীরা মানববন্ধন করে! আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কোর্ট-কাচারি কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ করে! তারপর একদিন সবকিছু মৌসুমি হাওয়ার মতো হারিয়ে যায়। আর আমরা শিক্ষিত-শহুরে-নাগরিক-মধ্যবিত্তরা নিত্যদিনের জীবনযুদ্ধে শামিল হই। বৈধ-অবৈধ উপায়ে নিজের শ্রেণি চরিত্র টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে লিপ্ত হই। উপরতলায় জায়গা নেয়ার অবিরাম চেষ্টায় নিরন্তর কসরত করি। আবার নিম্নবিত্তে পতিত হওয়ার শঙ্কায় শ্রেণিচ্যুত হওয়ার আতঙ্ক নিয়ে দিনাতিপাত করি। নিজের শ্রেণি চরিত্র ধরে রাখতে এবং শ্রেণি স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে সকাল-বিকাল আপস করি। ফলে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনার জন্য জাগ্রত হওয়া আমাদের মৌসুমি উত্তেজনা ক্রমে প্রশমিত হয়। আর সবকিছুর জন্য সরকারকে গালি দিয়ে, নিজের বিকার ‘সরকারের ওপর’ চালান নিয়ে নির্বিকারভাবে নিজের চরকায় তেল দিতে শুরু করি। ফলে সমাজে ধর্ষণের ঘটনা কমে না। বরঞ্চ প্রথমে গুণিতক এবং পরে জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। ধর্ষণের চরিত্র পাল্টায়। সুতরাং আমাদের মৌসুমি উত্তেজনা এবং তৎপরবর্তী সম্মিলিত নিষ্ক্রিয়তাও ধর্ষণের ঘটনার ক্রমবর্ধমানতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। কেননা কোনো পর্যায়ে, কোনো লেভেলে ধর্ষণবিরোধী শক্ত, মজবুত ও টেকসই কোনো সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠতে আমরা দেখিনি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে ধর্ষণবিরোধী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তার চেয়ে অধিক জরুরি ধর্ষণবিরোধী আমাদের সম্মিলিত সক্রিয়তা। আর সমাজে বিদ্যমান পুরুষাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্মিলিতভাবে দাঁড়াতে হবে, যাতে বিদ্যমান লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতার অসম সম্পর্ক ভেঙে সবার সমমর্যাদার এবং সমানাধিকারের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যে সমাজে পুরুষ নারীকে মানুষের মর্যাদা দেয় এবং মানুষ হিসেবে সম্মান করে, সে সমাজে ‘ধর্ষণ’র মতো ক্যানসার দ্রুতগতিতেই বিতাড়িত হতে বাধ্য।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App