×
Icon এইমাত্র
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ কল্যাণের ৬৬৬ কোটি টাকা কর ফাঁকি মামলার শুনানি চলছে

মুক্তচিন্তা

সৈয়দ হকের চার বছর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:০৬ পিএম

সৈয়দ হকের চার বছর

সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক

আজ ২৭ সেপ্টেম্বর কবি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণের চার বছর পূর্তি হচ্ছে। যখন ২০১৬ সালে তিনি জীবনের পূর্ণতায় পৌঁছান অর্থাৎ এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন, তখন আমার মনে হয়েছিল বুঝি আমিও তার সহগামী হই, কারণ সৈয়দ হকহীন পৃথিবী ছিল আমার কাছে মূল্যহীন। কিন্তু তবু আমি বেঁচে আছি, হয়তো এ কারণেই যে, তাকে আমি মানুষের কাছে যতদূর সম্ভব প্রকাশ করে যাই। কারণ তিনি ছিলেন এ পৃথিবীর একজন ভুলবোঝা মানুষ। এবং মানুষরা যাতে তাকে ভুল বোঝে, সে ব্যাপারে তারও যেন চেষ্টার কমতি ছিল না! একবার কলকাতা ভ্রমণকালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, মানুষকে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে হবে, জীবনযুদ্ধে জয়ী না হতে পারলে মানুষ সাধারণ হয়ে যায়। আমার যেন এখন মনে হয় সৈয়দ হক তার জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছিলেন। এবং এই জয় অর্জনের জন্য জীবনে যত প্রকারের আত্মবিসর্জনের প্রয়োজন হয়, তা তিনি করেছিলেন।

তিনি যখন এ পৃথিবীতে নেই, তখন তার লাইব্রেরি ঘরে আমি ধুলো পড়তে দিইনি। এবং আমার বিশ্বাস আমি যখন থাকব না, তখন কেউ না কেউ তার লাইব্রেরি ঘরে ধুলো পড়তে দেবেন না। এই লাইব্রেরি ঘরটি ইউনিক, এখানে বইয়ের থেকে এনসাইক্লোপিডিয়া এবং অভিধান বেশি। এসব বইয়ের প্রতি সৈয়দ হকের এক ধরনের নেশা ছিল, যাকে বলা যেতে পারে মুগ্ধতা। একজন ভাষাবিদের মতো তিনি তার লাইব্রেরি ঘরে ভাষা নিয়ে গভীরভাবে চর্চা করতেন। মনে আছে একবার আমি যখন লন্ডনে, তিনি আমাদের দেশ থেকে পুরো বাংলাপিডিয়ার ভল্যুম পাঠিয়েছিলেন খরচ করে। সেটি আবার দেশে টেনে আনতে আমার কষ্ট হয়েছিল।

তিনি যখন বেঁচে ছিলেন, তিনি তার লাইব্রেরি ঘরে কাউকে পা দিতে দিতেন না। আমরাও তার ইচ্ছাকে সম্মান করে চলতাম। শুধু তিনি যখন বিদেশে যেতেন আমি ঘর খুলে মেঝে পরিষ্কার করে রাখতাম। টেবিলের ধুলো ঝেড়ে রাখতাম। আর যেখানে যে জিনিস, বই বা কবিতা বা চিত্রনাট্য- সবকিছু যেখানে যেভাবে রেখে যেতেন সেইভাবে রেখে দিতাম, যেন তিনি বুঝতে না পারেন যে ঘরে কেউ ঢুকেছিল।

এখনো তার লাইব্রেরি ঘরে একটি বই খোলা পড়ে আছে। মনে হয় এ বিষয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছে ছিল তার। বইটির নাম মীর মোশাররফ হোসেনের ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’। এসব বই তার বহু আগে পড়া। নিশ্চয় কোনো কারণবশত আবারো পড়বার দরকার হয়ে পড়েছিল। ৪২৬ পৃষ্ঠায় এসে তিনি থেমে সেখানে পাতা উল্টে রেখেছেন, মনে হয় পুরোটা পড়ে সেরে উঠতে পারেননি।

এখন আমি যখন তার লাইব্রেরি ঘরে বসে কাজ করি, আমি আমার নিজের লেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন সৈয়দ হককেও আবিষ্কার করে চলি। এই আবিষ্কারেরও যেন সীমা-পরিসীমা নেই! রেডিও নাটক, চিত্রনাট্য, চিরকুটে ছোট ছোট লেখা, ছোট ছোট কবিতা আবিষ্কার করে চলি। কত বই তিনি না লিখে চলে গেছেন, কত নাটক, কবিতা, গল্প অসম্পূর্ণ রেখে চলে গেছেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। সবচেয়ে অবাক হয়েছি যখন পবিত্র কুরআন শরিফের অনুবাদ আমার হাতে পড়ে। এবং আশ্চর্যের কথা, আর সব লেখা অসম্পূর্ণ থাকলেও এই অনুবাদটি তিনি যথার্থই সম্পূর্ণ করে যেতে পেরেছেন।

এখনো তার লাইব্রেরি ঘরে একটি বই খোলা পড়ে আছে। মনে হয় এ বিষয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছে ছিল তার। বইটির নাম মীর মোশাররফ হোসেনের ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’। এসব বই তার বহু আগে পড়া।

অনুবাদটি যখন আমি পুরো পড়ে উঠেছিলাম, আমার মনে একটি দোলা লেগেছিল। পড়তে আমার খুব ভালো লেগেছিল। আর ওই যে তিনি তার আশিতম জন্মবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে জনসমক্ষে বলেছিলেন, তিনি লালনের মতো ১১৬ বছর বাঁচতে চান, তিনি যদি সত্যি সত্যি ১১৬ বছরও বাঁচতেন তাহলেও তার সব লেখা তিনি প্রকাশ করতে পারতেন কিনা আমার সন্দেহ থেকে যায়।

কিন্তু এতে কিছু এসে যায় না, কারণ অসম্পূর্ণ লেখারাও কথা বলে, তাদেরও আছে কিছু বক্তব্য, তারা একেবারে হারিয়ে যায় না। এসব অসম্পূর্ণ লেখা নিয়েও একটি বই করা সম্ভব। আর আছে তার অজস্র ছোট ছোট পকেট ডায়েরি। তার ভেতরে কুটি কুটি করে কবিতা লেখা। এত ছোট ডায়েরিতে আমি নিজে কোনোদিন লিখতে পারিনি, লেখা সম্ভবও নয় আমার পক্ষে কারণ আমার হাতের লেখা ছড়ানো এবং বড় বড়। ওইসব ডায়েরিতে আমি একটা কবিতা লিখলেই পাতা শেষ! কিন্তু না, সৈয়দ হক সেখানে অজস্র কবিতা লিখে রেখে গেছেন। আমার ইচ্ছে করে কোনো প্রকাশক যদি তার নিজের হাতের লেখা এই ডায়েরিগুলো সাহস করে ছাপতে পারতেন! কিন্তু এসব কল্পনা মাত্র। এ ধুলোর ধরায় সেটা সম্ভব নয়!

সেদিন তার লাইব্রেরিতে কাজ করতে গিয়ে কয়েকটি কবিতার চিরকুটের সঙ্গে এই চিরকুটটিও পেলাম, যেটি আমি এই ছোট্ট নিবন্ধটিতে ছাপিয়ে দিতে চাই। এটি শুধু তার চার বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে স্মরণের লিপিকায় লিপিবদ্ধ করে রাখবার প্রয়াস মাত্র হিসাবে দেখা যায়।

‘ভোরে সূর্যের উদয়, সন্ধ্যাকালে সেই সূর্য অস্ত যায়, পরদিন সূর্যের আবার উদয়, সম্পূর্ণ হয় একটি দিন। এইভাবে দিন পরে দিন, সময় এগিয়ে চলে। বয়সের হিসেবে আমার আশি বছর পুরো হয়। আমাদের ওদেশে, কুড়িগ্রামের বুলিতে, আশি নয়, চার কুড়ি বছর আমি পার করে এসেছি। কিন্তু সময়ের এই অতিবাহন বস্তুজগতের তো নয়, এটি আমাদের ধারণা জগতের, কেননা সময় এগিয়ে চলে, না স্থির থাকে, এর নির্ণয় নেই। আমরা সময়ের অতিবাহন যে সূর্য সাপেক্ষে বলে থাকি, সেই সূর্যও তো স্থির, তার অস্ত নেই, উদয় নেই। এ সমস্তই আমাদের অবস্থান থেকে উপলব্ধ বটে। সময়? পেছনের দিকে তাকিয়ে, এখন আমি নিজেকেই দেখি, কোন পৃথিবী কোন সময় আমরা রেখে যাচ্ছি পেছনে?’

আনোয়ারা সৈয়দ হক : কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App