×

মুক্তচিন্তা

বিপর্যস্ত উপকূলীয় অর্থনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২০, ০৫:৫০ পিএম

সময়ের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি বিচার বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপক‚লরক্ষা বাঁধ তৈরিতে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকায় প্রতি বছরই বাঁধে ফাটল ধরে। জোয়ারের পানির চাপ বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। উপকূলীয় ও হাওর এলাকার বাঁধগুলো সংশ্লিষ্ট জনপদের মানুষের চেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের কল্যাণই বেশি নিশ্চিত করে।

প্রায় মাস তিনেক আগে আম্ফান এবং অতিসম্প্রতি অঘোষিত জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপক‚ল অঞ্চলে যে আঘাত হেনেছে তাতে অনেকেরই অগোচরে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। বিধ্বস্ত হয়েছে হাজার হাজার বাড়িঘর, ভেঙে পড়েছে অনেক গাছপালা। উপকূলের অনেক নিম্নাঞ্চল হয়েছে প্লাবিত। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েক দিন ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গত সপ্তাহে উপকূলীয় জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় স্তম্ভে বলা হয় ‘উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে লোনা পানি ঢুকছে ফসলের ক্ষেতে। জমির ফসল নষ্টই শুধু নয়, দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা হাজার হাজার মানুষকে নিঃস্ব করছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর রিংবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বন্যা আঘাত হেনেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয়। নদ-নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের চাপে একের পর এক বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ এলাকা। হু হু করে লোকালয়ে ঢুকছে পানি। ডুবছে মাছের ঘের, আবাদি জমি ও নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি। প্রবল বর্ষা ও অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে পানি বাড়ছে দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের নদ-নদী, খাল-বিলেও। নদ-নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপে খুলনার পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কপোতাক্ষ নদের জোয়ারের চাপে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভেঙে দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে অসংখ্য চিংড়ি ঘের ও ছোট-বড় পুকুর। বৃহস্পতিবার সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া রিংবাঁধের তিনটি স্থান ভেঙে যায়।’

বাংলাদেশের উপক‚ল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার, এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট-বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্র সৈকত ৩১০ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপক‚লীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপক‚লেই দেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, বিশ্বের সেরা গহীন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের অন্যতম অখণ্ডিত (আনব্রোকেন) সমুদ্র সৈকত বা বেলাভ‚মি কক্সবাজার অবস্থিত। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ জনগণ যেমন এই উপক‚ল অঞ্চলে বসবাস করে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এই অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্তে¡ও এ অঞ্চল, এর অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানান দৈব দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানচিত্র ভারত সাগরের উত্তর-পূর্বভাগে মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড ও মায়ানমারের পশ্চিম উপক‚লে ২০.২৫ ও ২৩.২ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩৫ ও ৯২.২৪ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থানই এমন যে কথায় কথায় তার মেজাজ বিগড়ে যায়, মৌসুমি সঞ্চরণশীল মেঘের অবারিত অভিসার যেমন তাকে নাচায় তেমনি জাতীয় কবি নজরুলের ক্ষুধিত বন্ধু সে তৃষিত জলধি যার চিত্ত শত ক্ষুধার উদ্রেক করে উপকূলবাসীদের জীবন তছনছ করতে তার আনন্দ যেন বেশি। বলা নেই কওয়া নেই প্রায় সে উত্তাল থাকে। তার মন পবনের ঠিকানা বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তর ঠাঁই পায় না। তার এই প্রায়শ পাগলামি সুন্দরবন বরাবরই মাথায় পেতে নিয়ে সাতক্ষীরা খুলনা বাগেরহাট পিরোজপুর বরিশাল বরগুনা পটুয়াখালীকে শেল্টার দিলেও পাথরঘাটা থেকে চট্টগ্রামের ছাগলনাইয়া অবধি অরক্ষিত উপক‚লকে উপদ্রুত রাখা বা করাতেই যেন তার তৃপ্তি। ১৭৯৭ থেকে শুরু করে এই এবারের বুলবুল ও আম্ফান পর্যন্ত সময়ের শুমার পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে মোট ৪৮৭ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুল, নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপক‚লকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পরপর, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত ৪৭ বছরে ১৫৪টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে ঘন ঘন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ সিডর আর আইলার আঘাতে স্বয়ং সুন্দরবনও পর্যুদস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপক‚ল অঞ্চল প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রথম ও প্রত্যক্ষ শিকার সব সময়েই। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উপক‚লীয় অঞ্চলের অর্থনীতির সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এটা প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে জাতীয় অর্থনীতির আন্তঃসলিলা শক্তির উদ্বোধন যার হাতে সেই সবচাইতে বেদনায় বিবর্ণ। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থনীতির অনেক প্রবণতার সূচক সন্ধানে কালাতিপাত করে কিন্তু উপকূলীয় জেলা নিচয়ের আর্থ-সামাজিক চালচিত্রের, খানাপুরী থেকে শুরু করে ভূমি বণ্টন ব্যবস্থা, চাষাবাদের হাল-হকিকত, প্রাণিসম্পদের সালতামামি অনেক কিছুরই বাস্তবতার ব্যাখ্যা তাদের কাছে নেই। উপক‚লীয় অঞ্চল যেন শুধু দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাথাব্যথা সূত্রে সমুপস্থিত শুধু আকালের দিনে নাকালের মোহনায় এবং একমাত্র মিডিয়ায়।

নদীর অববাহিকাই মানবসভ্যতার সূতিকাগার, কৃষিই প্রাচীনতম জীবিকা আর শ্যামল সবুজ প্রান্তরে প্রাণিসম্পদের সমারোহই জীবনায়নের স্পন্দন। বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল যে এসব সত্য ও সম্ভারে সমৃদ্ধ তা তো চর্যাপদের পাতা থেকেও জানা যায়। সমুদ্র, নদীমেঘলা প্রকৃতি আর শ্যামল সবুজ পরিবেশের সংমিশ্রণে উপক‚ল অঞ্চল গোটা দেশের, সমাজের, অর্থনীতির জন্য অনিবার্য অবকাঠামো শুধু নয়, উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টায় সার্বিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যও জরুরি। এটা সুপ্রাচীন কাল থেকে, ইতিহাসের পথ ধরে এ সত্য সতত সব ভূগোলে স্বীকৃত থাকলেও প্রাচীন এই জনপদে তা যেন সব সময় নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হয় যখন পালা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সবাই। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পড়ে, তাপমাত্রার পরিবর্তন প্রসূত তারতম্য সূত্রে সমুদ্রের তলদেশ স্ফিত হয়ে ওঠার ফলে পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে বিশ্বের প্রায় সব সমুদ্র উপকূল বেষ্টনীতে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বাংলাদেশের জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের অশনি সংকেত দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল, বিশেষ করে অদূরবর্তী দ্বীপাঞ্চল সামান্য জলোচ্ছ্বাসের ছুতানাতাতেই তলিয়ে যাচ্ছে, তা উদ্ধারে বশংবদ কোনো কার্যক্রম সফল হচ্ছে না। সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্র্য বিপন্ন হতে চলেছে এর প্রভাবে। বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির জন্য তা দারুণ দুঃসংবাদ বৈকি।

সময়ের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি বিচার বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপক‚লরক্ষা বাঁধ তৈরিতে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকায় প্রতি বছরই বাঁধে ফাটল ধরে। জোয়ারের পানির চাপ বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। উপকূলীয় ও হাওর এলাকার বাঁধগুলো সংশ্লিষ্ট জনপদের মানুষের চেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের কল্যাণই বেশি নিশ্চিত করে। সারাদেশেই এ ধরনের বাঁধ নির্মাণে চলে এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই তত্ত্বের বাস্তবায়ন; যা থেকে ভুক্তভোগীদের রক্ষা ও সরকারি অর্থের অপচয় রোধের প্রকৃষ্টতম পথ হলো বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করা। এটি সম্ভব হলে উপকূল ও হাওর এলাকায় সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ ব্যবহার করে টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হবে। প্রতি বছরের ভোগান্তি থেকেও রক্ষা পাবে এলাকাবাসী।

যথাসময়ে যথাপ্রযত্ন প্রদান করা সম্ভব না হলে, উষ্ণায়নের প্রভাবক ক্ষয়ক্ষতিকে যথা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করা সম্ভব না হলে সমূহ সম্ভাবনাময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অবদান থেকে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতি শুধু বঞ্চিতই হবে না, সময়ের অবসরে জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাবে উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে এটি গোটা দেশ ও অর্থনীতির জন্য দুর্ভাবনা-দুর্গতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের অন্যতম দুটি সমুদ্রবন্দর, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বর্গ সুন্দরবন এবং পর্যটন সম্ভাবনা সমৃদ্ধ কক্সবাজারকে কার্যকর অবস্থায় পাওয়া জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভিযাত্রার জন্য যে কত জরুরি তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিককালে সিডর ও আইলায় সুন্দরবন এবং সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিসম্পদের ওপর যে দুর্বিষহ ও নেতিবাচক প্রভাব প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় তাতে উপক‚লীয় কৃষি অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ দেখা দিয়েছে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App