×

মুক্তচিন্তা

ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২০, ০৬:৫৩ পিএম

ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষ

কামাল লোহানী

তিনি সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অনিয়ম ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সব সময় সরব ছিলেন, উচ্চকণ্ঠী ছিলেন। আপস করেননি। শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে মত ভিন্নতায় বিভিন্ন সময় কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন। নিজের অবস্থান বদলাননি। ১৯৭৫ সালে সরকার ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব বন্ধ ঘোষণা করলে তিনি তা মেনে নিতে পারেননি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জোগান পর্যায়ে কামাল লোহানীর জন্ম। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন। প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টি ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণ। রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একদিকে ইউরোপের বিশাল এক অংশজুড়ে শ্রমজীবী মানুষ সমতার স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে অন্যদিকে এর বাইরের সমগ্র ইউরোপবাসী শুনতে পাচ্ছে ভাঙনের ঘণ্টাধ্বনি। দেশে দেশে, সমাজে সমাজে দ্ব›দ্ব-বিভাজন, সমাজ ভেঙে পড়ছে, পরিবার ভেঙে পড়ছে, মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে ফারাক, বৈষম্য। ইউরোপজুড়ে তৈরি হলো মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতাবোধ। যার দার্শনিক নাম ‘এলিয়েনেশন’। ইউরোপের সে সংকটময় বিপর্যস্ত সমাজের মানুষগুলো সম্পর্কে আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে তার ছোটগল্প ‘দ্য ওল্ড ম্যান অন্ড দ্য সি’-এ বলছেন, মানুষগুলোর মেরুদণ্ড থেকে শিশ্ন পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে। সমাজে মানুষগুলোর প্রতিবাদের ক্ষমতা, দাঁড়াবার শক্তিটুকু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যে সংকট গোটা ইউরোপে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলল। ইউরোপের এ বিপর্যয়ের কালে আমাদের ভারতবর্ষে চলছে শেকল ভাঙার কোরাস। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতায় পশ্চিমের বিপর্যয়ে ভারতবর্ষও কঠোরভাবে আক্রান্ত হলো। সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল ভারতবর্ষ। একদিকে মানুষের ধর্মীয় উন্মাদনা অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী কৌশল- ১৫ লাখ মানুষকে খাদ্য সংকটে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল। সমাজের এমনি অগ্নিগর্ভ সময়ই কামাল লোহানীর শৈশব ও কৈশোরকাল। ৭ বছরের মাতৃহারা শিশু সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে চলে গেলেন কলকাতা। কানে তুলো গুঁজে যুদ্ধের ধ্বংস ধ্বনি থেকে রক্ষা পেতে চাইতেন। সাইরেনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ বিমানের গোলা ও শব্দ। বাড়ি ও স্কুলে সর্বত্র যুদ্ধের শব্দ। কিন্তু তুলো গুঁজেই কি যুদ্ধ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? শিশু কামাল লোহানীর সামনে তখন পথে-হাটে-মাঠে সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা হাজার হাজার লাশ। ধর্মের নামে হিংস্র পশুর মতো মানুষকে হত্যা করছে মানুষ। সভ্যতা, মানবতার এক নির্মম নগ্ন চিত্র সর্বত্র। যে ছবি কামাল লোহানীকে কঠিন-কঠোরের দিকে নিয়ে যায়। তিনি বুঝতে থাকেন সভ্যতার নামে এখানে চলছে নিরন্ন মানুষদের নিয়ে নির্মম পাশাখেলা। এ থেকে মুক্তি পেতে হবে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনা চলে এলেন। পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হলেন। থাকেন চাচার কাছে। ব্রিটিশরা দেশভাগ করে চলে গেলেও দেশটা স্বাধীন হলো না। এ সত্যটি বুঝতে অবশ্য কিছুদিন সময় লেগেছিল। ভাষা নিয়ে এখানে পশ্চিমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। কামাল লোহানী বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়ালেন। ঢাকা রক্তাক্ত হলো। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে। তিনি তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। স্কুল ছেড়ে ভর্তি হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। ভাষা-সংগ্রামে অংশ নেয়া ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘পাইওনিয়ার ফ্রন্ট’। এরা যোগ দিলেন ভাষা-সংগ্রাম থেকে গড়ে ওঠা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে। ১৯৫৩ সালে পাবনায় মুসলিম লীগের এক কাউন্সিল অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় লীগ নেতার আগমনকে কেন্দ্র করে জেলার ছাত্র-শিক্ষকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কারণ কিছুদিন আগেই এই নূরুল আমিনের নির্দেশে ঢাকায় ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে লীগ সরকার কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানীসহ অনেকে। মুক্তি পান কিছুদিন পর। এরই মধ্যে পূর্ববাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ১৯৫৪-এর মার্চে নির্বাচন। হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে মুসলিম লীগ ছাড়া পূর্ববঙ্গের সবাই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে অবস্থান নেন। গণজোয়ারে লীগ সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ১৯৫৪-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনায় টাউন হলে শহীদ দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে লীগ সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের পর সরকার রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের এই বিজয় পশ্চিমারা মেনে নিতে পারে না। তিন মাসের মাথায় ১৯৫৪ সালের ২৯ মে নতুন আইন করে ‘গভর্নর পদ্ধতি’ প্রবর্তন করে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। মেজর ইস্কান্দার মির্জা পূর্ববাংলার গভর্নর হন। শুরু হয় ভিন্ন মতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার। ১ জুন আবার গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। এক বছর পরে ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে কামাল লোহানী আত্মগোপনে যান। এ সময় তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন। বুলবুল একাডেমির মাধ্যমে নৃত্য ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে নৃত্য গুরুজি এ মান্নানের প্রযোজনায় ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ নৃত্যনাট্য তৈরি করে দেশে ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রদেশে মঞ্চস্থ করেন। এরই মধ্যে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীকে। যোগ দেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। ১৯৬১ সালে সাংস্কৃতিক দল নিয়ে ইরান ও ইরাক সফর করেন। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে। আবার শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। কামাল লোহানীর নামে হুলিয়া জারি হয়। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন তিনি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকের সঙ্গে ২৬নং সেলে রাখা হয় তাকে। কারাগার থেকে তিন মাস পর মুক্তি পান। যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। পরে পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট ও দৈনিক পূর্বদেশে যুক্ত হন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে নতুনতর সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠলে তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক থাকার পর মার্কসবাদী আদর্শে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’। ১৯৬৭ সালে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হয়। সেখানে মঞ্চস্থ হয় গণসংগীতের অনুষ্ঠান ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’, নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’, নৃত্যনাট্য ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক স্বরাজ পত্রিকায় পাকসেনাদের দুঃশাসনের চিত্র নিয়ে দুঃসাহসিক প্রতিবেদন রচনা করেন। সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠী’। এপ্রিল মাসে সহকর্মীদের নিয়ে তিনি ভারতের কলকাতা পৌঁছান। সেখানে প্রথমে জয়বাংলা পত্রিকা ও পরে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যুক্ত হন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে থাকলেও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, স্লোগানসহ সবকিছু করেছেন। দেশ স্বাধীন হলে ফিরে এসে ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা বেতারের দায়িত্ব নেন। কিন্তু স্বাধীন দেশেও প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন না দেখে বেতার ত্যাগ করেন। ফিরে যান সংবাদপত্রে। সাংবাদিকতায় স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের সংগঠনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন দেশে গেছেন। ১৯৮৩ সালে আবার গড়ে তোলেন ‘গণশিল্পী সংস্থা’। পরে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হন। বিভিন্ন সময় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অনিয়ম ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সব সময় সরব ছিলেন, উচ্চকণ্ঠী ছিলেন। আপস করেননি। শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে মত ভিন্নতায় বিভিন্ন সময় কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন। নিজের অবস্থান বদলাননি। ১৯৭৫ সালে সরকার ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব বন্ধ ঘোষণা করলে তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি বাকশালে যোগ দেননি। যোগদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ’৭১-এ মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থেকেছেন। সাগর-রুনি, ত্বকী, তনুসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সামনে থেকেছেন। আপনার সকল কাজ আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।

রফিউর রাব্বি : সাংস্কৃতিক কর্মী ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App