×

মুক্তচিন্তা

মার্কিনি বর্ণবাদ সহসা মুছে যাবার নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২০, ১২:৫৪ পিএম

এক নৈরাজ্যিক পরিবেশে চলছে ট্রাম্প আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অদ্ভুত বলতে হয়, মার্কিন জনগণের পক্ষ থেকে এসব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সামান্যই। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে আটলান্টিকের ওপারেও, ওটা অবশ্য প্রতীকী। কিন্তু আমেরিকান ব্যবস্থা যে গণতন্ত্র থেকে অনেক দূরে, প্রশাসন থেকে বিচারালয়, আবারো তা প্রমাণ হলো এ ঘটনায়। তবে এর একটি ইতিবাচক দিক হলো সমাজের বৃহৎ অংশ এবার আলোড়িত, এটাই প্রাপ্তি।

উত্তর আমেরিকা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি প্রাথমিক পর্যায়ে বর্বর, অমানবিক ও জঘন্য দাসপ্রথার সুবিধাভোগী হিসেবে এবং সেটা যেমন ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক তেমনি জাতীয় পর্যায়ে। এর সঙ্গে জড়িত বর্ণবাদী পাপ। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকার নর-নারী শ্রমের ফসল আত্মসাৎ করে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ নাগরিক ও তাদের পরিবারের রমরমা অবস্থা এবং কৃষ্ণাঙ্গ দাসদাসীদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা। আমেরিকার এই যুগ যুগ লালিত পাপ স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক মহৎপ্রাণ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের চেষ্টায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে দূর করা হলেও শ্বেতাঙ্গ মার্কিনি সমাজ এ পাপাচার থেকে সহজে মুক্ত হতে চায়নি। রবীন্দ্রনাথের লেখায়ও ‘নিগ্রো লিঞ্চিং’ (নিগ্রোদের পুড়িয়ে মারার) বীভৎস দৃশ্যের উল্লেখ রয়েছে। সেই দৃশ্য দেখে শ্বেতাঙ্গ নর-নারীর উল্লাসের কথাও ক্ষুব্ধ চিত্তে প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আধুনিক কালের নিরপেক্ষ সমাজ চেতনার মার্কিনি ইতিহাস লেখকদের রচনায় মার্কিনি উত্থানের পাশাপাশি এর কৃষ্ণকায় দিকটিরও উল্লেখ রয়েছে। এ পাপাচার সম্পর্কে উপন্যাস লিখেছেন দুয়েকজন মার্কিনি কথাসাহিত্যিক। শোনা যায়, আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের পরও নাকি খ্যাতমান নেতা ও প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন জেফারসনেরও অনেক কৃষ্ণাঙ্গ দাসদাসী ছিল। আবারো বলতে হয়, ব্যতিক্রম আব্রাহাম লিংকন। কালের ধারায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান (যাদের নাম ছিল নিগ্রো) নর-নারীর সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও আমেরিকার শে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মন থেকে (সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে) বর্ণবাদী অমানবিকতা দূর হয়নি। বিশেষ করে কৃষিসমৃদ্ধ দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোর নাগরিকদের ক্ষেত্রে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমার এখনো মনে আছে আলাবামা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর জর্জ ওয়ালেস কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের পক্ষে নমনীয় কী একটা ফেডারেল আইন তার রাজ্যে চালু করতে দেয়নি। সেখানে তখন শিক্ষায়তনে শে^তাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ একসঙ্গে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ পুরোপুরি বর্ণবাদী ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত ছিল। উত্তর ও দক্ষিণে এদিক থেকে গুরুতর বৈষম্য ও প্রভেদ বিরাজ করেছে। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো নমনীয় চরিত্রের প্রেসিডেন্টের শাসন ব্যবস্থার কল্যাণে এবং কৃষ্ণাঙ্গদের দুই ধারার সামাজিক আন্দোলন অবস্থার ক্রমশ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি থেকে বিল ক্লিনটনের ধারায় বিস্ময়কর ঘটনা কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামার দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া। কিন্তু মার্কিনি সমাজ এখনো এমন মানসিকতায় বাঁধা যে শে^তাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠের মন থেকে বর্ণবাদী বৈষম্য চেতনা এখনো দূর হয়নি। তারা ইতিহাসের সত্যকে স্মরণে আনে না যে একদা কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রমে ও আত্মদানে বিশাল ভূখণ্ড আমেরিকার অর্থনৈতিক-সামাজিক শ্রীবৃদ্ধি। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের কল্যাণে- সেখানে নানামাত্রিক মেধার প্রকাশও রয়েছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের সাধারণ মেধাবীদের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে অর্থাৎ সাদা, কালো, বাদামি ও মিশ্র বর্ণের নাগরিকদের নিয়ে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মিশ্র জাতি পরিচয়। এখানে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও বৈষম্যের অবসানে সংঘটিত হয়েছে উগ্র কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলন, তেমনি উদারচেতা কৃষ্ণাঙ্গদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে মানবতাবাদী আন্দোলন। এ দুইয়ের বিরুদ্ধেই উগ্র শে^তাঙ্গ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন কে কে কে তাদের কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। সেই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কিন্তু মৃত্যু হয়নি, কিছুটা পিছুটানে ছিল, এই যা। তবে অনুক‚ল পরিবেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষভাবে ট্রাম্পের পৃষ্ঠপোষকতায়।

দুই. এই হলো বিচিত্রবর্ণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক চিত্র-চরিত্রপট। তাই বিচিত্র আচরণ এই পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশটির। প্রেসিডেন্ট আসে, প্রেসিডেন্ট যায়; সে অনুযায়ী শাসনদণ্ডের কাঁটা কিছুটা এদিক-ওদিক দোলে, কিন্তু কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে না। ঘটাতে পারেননি কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। নেপথ্যে ইসরায়েল-প্রধান লবি এতটা শক্ত। এত বৈষম্য, এত যুক্তিহীন আগ্রাসী রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, সুপ্ত ও প্রকাশ্য শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ অনুকূল হাওয়ায় পতাকা ওড়ায়। আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) ইতিহাস অধ্যয়নে আমাদের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের এবং পাঠকদের এই অপ্রিয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে নগ্ন সত্যগুলো জেনে রাখা দরকার। বর্ণবাদী পাপ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি, তার প্রমাণ বিগত নির্বাচনে বহু সমালোচিত বৃহৎ ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের হারতে-হারতেও বিজয়। এবং তা মূলত উগ্র শে^তাঙ্গবাদকে উসকে দেয়ার কারণে।নির্বাচনপ্রার্থী পদে প্রতিযোগিতার সময় তার নিজ দল রিপাবলিকান নেতাদের মধ্যেই তাকে নিয়ে ছিল ভিন্নমত। দুর্বোধ্য কারণে সেসব কেটে যায়। এমনকি ইমপিচমেন্টের অবমাননাকর পরিস্থিতি থেকে তাকে মুক্ত করে আনে রিপাবলিকান নেতৃত্ব (সম্ভবত যোগ্য প্রার্থীর অভাবে)।প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ডের হিসাব নিতে গেলে অবাক হতে হয়। ঘরে তার বর্ণবাদী নীতি, বাইরে যথারীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় আগ্রাসী নীতি। সে ক্ষেত্রে নির্মমতাও কম নয়। প্রমাণ বহু ঘটনার মধ্যে অকারণে ইরানি সামরিক গোয়েন্দা নেতা সোলাইমানি হত্যা, যা হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়ার দাবি রাখে। আধিপত্যবাদী ইসরায়েলের জেরুজালেম কব্জা করায় ট্রাম্পের উল্লসিত সমর্থন বহু সমালোচিত। দুর্ভাগ্য আরবদের। রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা বহু বিভাজিত। সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রীতিক দুর্ঘটনা করোনা ভাইরাস আক্রমণে ট্রাম্পের ভ‚মিকাও বিতর্কিত। মানুষ মরুক, কিন্তু তার অর্থনীতি চাঙ্গা থাকা চাই। এমন এক নৈরাজ্যিক পরিবেশে চলছে ট্রাম্প আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অদ্ভুত বলতে হয়, মার্কিন জনগণের পক্ষ থেকে এসব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সামান্যই। ইতোপূর্বে একবার অবশ্য মার্কিনি তরুণদের বড় একটি অংশ প্রতিবাদে জেগে উঠেছিল ধনবাদী এই রাষ্ট্রের ধনকেন্দ্র দখলের স্লোগানে ‘অকুপাইওয়াল স্ট্রিট’ মুখে নিয়ে মিছিলের পর মিছিল সংঘটনে। আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল একাধিক অঙ্গরাজ্যে। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্ব এবং তেমনি আদর্শিক সংগঠনের অভাবে সম্ভাবনাময় এই আন্দোলন, বলতে হয় রাজপথে মারা গেছে।

তিন. এবার মূল প্রসঙ্গ। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি আধুনিকতার মধ্যেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শে^তাঙ্গ বর্ণবাদ এখনো বিদ্যমান- তবে প্রধানত সুপ্ত, প্রয়োজনে প্রকাশ্যে উদ্ধত তার ফণা। যেমন ট্রাম্পের বিগত নির্বাচনী বিজয়ে। এর সামাজিক চরিত্রটি এমনই যে এই অন্যায্য ঐতিহ্য থেকে পবিত্র বিচার বিভাগও মুক্ত নয়। বছর কয় আগের কথা। একটি খেলনা পিস্তল হাতে থাকার কারণে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে হত্যা করে। বিচারে পুলিশ প্রবরের বেকসুর খালাসের রায় পত্রিকায় পড়ে অবাক হইনি। এ ধরনের ঘটনা এখনো মাঝেমধ্যে ঘটে থাকে। যদিও ইতোমধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের অংশবিশেষ শিক্ষায়, মননে, সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে ২৫ মে মিনোসোটা অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তম শহর মিনিপোলিসে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সন্দেহবশত বীভৎসভাবে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করার প্রতিবাদে এবার ভিন্নমাত্রায় প্রতিক্রিয়া। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ১২টি অঙ্গরাজ্যের ২৫টিরও বেশি শহরে। দৈনিক শিরোনাম : ‘কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ, সংঘাত’। একটি তাৎপর্যপূর্ণ শিরোনাম : ‘বর্ণবাদী হত্যা যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ফিরিয়ে আনছে’। যেমন দেশব্যাপী করোনা আক্রমণে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে সমালোচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যাকফুটে, তেমনি কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার চার দাবি না মেনে বরং ঘটনাকে বাড়তে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবস্থাদৃষ্টে বাংকারে আত্মগোপন অবস্থায়। তাই আজকের (২ জুন, ২০২০) একটি দৈনিকে সংবাদ শিরোনাম : ‘উসকে দিয়ে বাংকারে ঢুকলেন ট্রাম্প, জ¦লছে যুক্তরাষ্ট্র’। প্রেসিডেন্ট সুলভ কর্মই বটে। কী চান ট্রাম্প? ঘোলা পানিতে মাছ ধরা, আগামী নভেম্বরে? বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে আটলান্টিকের ওপারেও, ওটা অবশ্য প্রতীকী। কিন্তু আমেরিকান ব্যবস্থা যে গণতন্ত্র থেকে অনেক দূরে, প্রশাসন থেকে বিচারালয়, আবারো তা প্রমাণ হলো এ ঘটনায়। তবে এর একটি ইতিবাচক দিক হলো সমাজের বৃহৎ অংশ এবার আলোড়িত, এটাই প্রাপ্তি। কারণ জানি এ আন্দোলনও অপ্রাপ্তিতে শেষ হবে, তবে সামাজিক পরিবর্তনের সূচনাটি গুরুত্বহীন নয়। এটাই বড় কথা।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App