×

মুক্তচিন্তা

আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙ্কারে জন্ম নেয়া সেই শিশু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:১৪ পিএম

আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙ্কারে জন্ম নেয়া সেই শিশু
আজকাল মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান জন্ম নেয় সোনার চামচ মুখে নিয়ে। কেউ কেউ ফাইভ স্টার মানের হাসপাতালে আবার কেউ জন্ম নেয় বস্তিতে। তবে যেই ভাবেই হোক এখন কি কেউ ভাবতে পারেন যে কারো জন্ম হতে পারে মাটির বাঙ্কারে? স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রে এরকমটি হবার কোন সুযোগ নেই। তবে আজ থেকে ৫২ বছর পূর্বে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া সেইসব শিশুদের কথা আপনাদের কারো কি মনে আছে? মনে না থাকারই কথা। আজ আপনাদের ছোট্ট পরিসরে হলেও সেই নয় মাসের যুদ্ধের সময় বাঙ্কারে জন্ম নেয়া একটি শিশু যে আজ বা ৫২ পেরিয়ে ৫৩ তে পদার্পণ করেছে তার কথা বলব। হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছেন, সে মানুষটি অর্থাৎ বাঙ্কারে জন্ম নেওয়া সেই শিশুটি আমি। আমার জন্ম বর্তমান শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলাধীন প্রাচীন বিখ্যাত এবং সুপরিচিত ঝগড়াচর বাজারে। এই বাজার এর মধ্য দিয়ে যে সড়কটি জামালপুর জেলা থেকে শুরু করে ১১ নম্বর সেক্টরের সেই কামালপুর বর্ডার যে রাস্তাটি গিয়েছে সেই রাস্তা বরাবর বাজারের মধ্যখানে আমাদের বাড়ি। এই বাজার অর্থাৎ আমাদের বাড়ির সন্নিকটে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা রফিকুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আমার ডাক্তার শামসুল হক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি মাতৃগর্ভে। ছয় ভাই এবং দুই বোনের পরে আমার জন্ম। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার নানা সেই সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। স্কুল যেহেতু সামনে ঘটে সেই সুবাদে পাকহানাদার আমাদের স্কুলের ক্যাম্প গড়ে তোলে। নানা চেয়ারম্যান থাকার কারণে পাক বাহিনীর প্রতিনিয়ত আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করত। পাকবাহিনী আমাদের কাউকে সন্দেহ করত না। আর এই সুযোগে আমার মা মরহুমা রাজিয়া ইসলাম বাড়ির পাটাতনের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দান করেন। দিনের বেলায় মুক্তিযোদ্ধারা পাটাতনের উপর ঘুমিয়ে থাকতো আর রাতের বেলায় তাদের মিশন পরিচালনা করত। আমার মা জীবিত থাকার সময় একদিন আমার জন্মের সময় তার যে কষ্ট হয়েছিল সে কথা আমাকে বলছিলেন। সেখান থেকে কিছু কথা আপনাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যা আমার মনের কষ্টগুলো আপনাদের কাছে তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস। দেশ বিজয় লাভের দুদিন আগে আমার জন্ম হয় বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটা বাঙ্কারে। ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার বীর প্রতীক কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে যখন স্বাধীন হয় তারা ঠিক পূর্বে হানাদার বাহিনী বকশীগঞ্জ, কামালপুর ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, হত্যা করে অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙালিকে। হানাদার বাহিনীর ওই হত্যাকাণ্ডের চি‎হ্ন হিসেবে অনেক গণকবর ছড়িয়ে রয়েছে কামালপুরসহ বকশীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকাজুড়ে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিপরীতে জেলার পাহাড়ঘেরা বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুরে হানাদার বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল যে কোন মূল্যে এই ঘাঁটি দখলের। লক্ষ্য অনুযায়ী সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের (বীর উত্তম) পরিকল্পনা অনুসরণ করে ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটি অবরোধ করে। ওই সময় পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক খানের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনী ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ অন্যদিকে হানাদারদের ঘাঁটি রক্ষায় মরণপণ লড়াই- এমন পরিস্থিতিতেই দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। অবরোধের প্রথম দিনই সম্মুখ যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের একটি পা হারান। ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান বীর প্রতীক। সে সময় ৩১ বালুচ এর কমান্ডার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ জামালপুরের বারুয়ামারী ও শেরপুরের নকসী এলাকা থেকে আরো সৈন্য পাঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ২৯ নভেম্বর ৩১ বালুচ এর কমান্ডার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের নির্দেশে মেজর আইয়ুব কামালপুরের গ্যারিসন কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক খানের দুর্গে সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্য সরবরাহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তবে তখন শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ। ১০ দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭ টায় দুর্গে অবরুদ্ধ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক খানসহ ১৬২ জন হানাদার সদস্য মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। মুক্ত হয় কামালপুর। আর কামালপুর মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই সূচিত হয় শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ ঢাকা বিজয়ের পথ।কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন মমতাজ, মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান তসলিমসহ শহীদ হন ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে একজন ক্যাপ্টেনসহ হানাদার বাহিনীর ২২০ জন সৈন্য এই যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদান আমার আপন চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা ধনু মিয়া, বর্তমানে একমাত্র চাচা জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মিয়া। ১০ তারিখে কামালপুর স্বাধীন হওয়ার পর আমার মা বুঝতে পারেন যে হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করতে পারে কারণ তারা বুঝে গেছে যে এই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে রয়েছে। বাড়ির মাঝখানে খোঁড়া হয় একটি বাঙ্কার। সত্যিই তাই ঘটে পাকবাহিনী চলে যাওয়ার সময় বিমান থেকে নিক্ষেপ করে আমাদের বাড়িতে গোলাবর্ষণ। যার প্রমাণ আমি বড় হয়ে যখন আমাদের বাড়ির বড় বড় আম কাঁঠালের কাঠ স মিলে কাটতে যাই সেখানে দেখি সমীরের সেই করাত দিয়ে কাজ হচ্ছে না। গাছের মাঝখানে শুধু গুলি আর গুলি। ১৪ ডিসেম্বর সেই বাঙ্কারের মধ্যেই জন্ম হয় আমার। তখনো দেশ বিজয়ের আরও দুদিন বাকি। নানা এবং আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে মনে করলেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হবে, তাই দ্রুত আমার মা এবং আমাকে নানার পুরানো বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা আমার নাম রাখে বিপ্লব। মা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন সেই সূত্র ধরে তার ছোট সন্তানের নাম ধরে আমার নাম রাখেন রাসেল। পরবর্তীতে স্কুলের ভর্তির সময় আমার মরহুম প্রয়াত দাদা মৌলভী নিজাম উদ্দিন আহমেদ নাম রাখেন গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ। আজ অনেকের কাছেই মহিউদ্দিন আহমেদ নামে পরিচিত আমি। কত কষ্ট এবং যন্ত্রণা নিয়ে আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন সেটি হয়তো আমি বুঝিনি কিন্তু এখন উপলব্ধি করি। এরকম অসংখ্য মা পথে-ঘাটে বাঙ্কারে জঙ্গলে বনে কত না আমার মত সন্তান জন্ম দিয়েছেন। আমরা শুধু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এবং অংশ নিয়ে ব্যক্তিদেরই সম্মান জানাই কিন্তু এ সকল মা যারা এই যুদ্ধের সময় কষ্ট করে সন্তান জন্ম দিয়েছেন তাদের কথা কেউ মনে ও করি না। বিজয়ের মাসে সে সকল মায়েদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। ৭১ প্রজন্মের সন্তানদের প্রতি আমার আহ্বান এবং অনুরোধ এসো আমাদের জন্মদাত্রীদের স্মরণ করি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। লেখক: মহিউদ্দিন আহমেদ, সভাপতি, বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App