×

মুক্তচিন্তা

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্বনির্ভর হতে প্রয়োজন সমবায় ব্যাংক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৬ পিএম

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্বনির্ভর হতে প্রয়োজন সমবায় ব্যাংক
প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ঋণের আওতায় আসতে পারেন না এমন বেকার, দরিদ্র উদ্যোক্তা এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে সহজ-শর্তে বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে সমবায় ব্যাংক। আমাদের সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে সমবায়কে স্থান দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু কৃষি সমবায়, মৎস্য সমবায়, তাঁতি সমবায়, শিল্প সমবায়, দুগ্ধ সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে। আর এই অর্থনৈতিক মুক্তির সোপান হলো সমবায় ব্যবস্থা। সমবায় ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রো ক্রেডিট-এর মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এই সমবায় ব্যাংকগুলোর প্রতি সরকারের যথেষ্ট সুনজর লক্ষ করা যায় না। বরং বর্তমানে প্রতি পদে পদে দরিদ্র নির্মূলের হাতিয়ার এই সমবায় ব্যাংক বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। পেছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা চলছে। আমার মনে হয় জনবান্ধব আইনি সংস্কারের মাধ্যমে সমবায় ব্যাংকগুলোর আরো প্রসারের ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। তাহলেই দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হবে। দেশ দারিদ্রমুক্ত হবে। পুরো বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণকে বিশ্বের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার মনে করছে, কিন্তু আমরা কেন যেন পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছি না। এদেশে যারা আর্থিক বৈষম্যে বিশ্বাসী তাদেরকে যেন এই সত্য মানানোই যাচ্ছে না। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সুদীর্ঘ সময় ধরে প্রান্তিক মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করে চলছে। প্রান্তিক মানুষের বিশ্বাস, সততা আর আন্তরিক পরিশ্রমের ফলে সমবায় ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অর্থনৈতিক পরাধীনতার কাছে নিজেদের মুক্তির আনন্দ বিসর্জন না দিতে চাওয়া এই মানুষগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঘোরে দেশের অর্থনীতির চাকা, আশা জাগে সমৃদ্ধ নতুন দিনের। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় ব্যাংক থেকে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে তার প্রয়োজনীয় ঋণ পাওয়ার পর কী হয়? উদাহরণ হিসেবে-কেউ যদি এক লক্ষ টাকা ঋণ নেয়-তবে এই ঋণ পরিশোধের জন্য উক্ত সমবায় ব্যাংক থেকে তার কাছে বিভিন্ন ধরনের কিস্তি-সুবিধার প্রস্তাব থাকে। কিস্তিটি তার ব্যবসার লভ্যাশং থেকে শোধ করতে পারবে এরকম একটি অ্যামাউন্ট বেছে নেওয়ার সুযোগ ওই ব্যবসায়ীর থাকে। আমার জানা মতে, ব্যবসায়ী প্রায় ৩৮ মাসের মতো সময় নিতে পারে; এবং প্রতিটি কিস্তি সর্বনিম্ন ২০০ টাকাও হতে পারে। এখন একজন ব্যবসায়ী যদি এক লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে সর্বনিম্ন ২০০ টাকা কিস্তি পরিশোধ শুরু করে সেটা তার ব্যবসায় খুব বেশী সমস্যা করবে না। অথচ মেয়াদ শেষে সেই নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীর মূলধন এক লক্ষ টাকা দাঁড়িয়ে যাবে। এভাবে প্রতিবার মেয়াদ শেষে তার মূলধনের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। যা একসময় তাকে স্বনির্ভর করে তুলবে। গত চার দশক ধরে দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যকর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে সরকার এবং দাতাগোষ্ঠী উভয়ই তাদের উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে ক্ষুদ্রঋণকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে। বস্তুত এ ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের কাছে আর্থিক সুবিধাগুলো খুব সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়। আর এই সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে সমর্থ হয়েছে এমন উপকারভোগীর সংখ্যা অনেক। ‘পূর্বা’ নামের আর্থসামাজিক ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া কাওলা বাজারের সফল উদ্যোক্তা নার্গিস আক্তারের এক সাক্ষাৎকারে তার স্বনির্ভর হওয়ার গল্পে তিনি বলেন, ‘আজকে আমার যা-ই আছে না কেন, ব্যবসার শুরুতে আমি তো ছিলাম ‘জিরো’। তফসিলি ব্যাংক কোন ‘জিরো’র ওপরে বিনিয়োগ করতে রাজি হয়নি। অনেক ব্যাংকে গেছি তারা জামানত ছাড়া লোন দেয় না। আমার তো কিছুই ছিল না। কী জামানত রাখব?’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সমবায় ব্যাংক। দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক আমাকে বিনা জামানতে ঋণ দিয়েছে। আমি কীভাবে ঋণ শোধ করব তাও নির্ধারণের সুযোগ আমাকে দিয়েছে। আমি আমার ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে ঋণ শোধ করেছি। আর এভাবে প্রতিনিয়ত আমার মূলধন বেড়েছে।’ তার ব্যবসায়িক অগ্রগতির কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকে আমার নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানে ১২ থেকে ১৪ জন লোক চাকরি করে তাদের সংসার চালাচ্ছে।’ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ২ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে বলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) তাদের বার্ষিক পরিসংখ্যান কর্মশালায় জানিয়েছে। যা আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ২৬.৪১% বেশি। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তথ্য বলছে, এই প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক উত্থানকে উৎসাহিত করতে প্রান্তিক নাগরিকদের প্রচেষ্টাকে তুলে ধরেছে। ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় সঞ্চয়েরও প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। গ্রাহকরা এ অর্থবছরে ৬২,০৫৫ কোটি টাকা জমা করেছে, যা আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ২৫.১৬% বেশি। কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্ষুদ্রঋণ খাতে জনগণের ক্রমবর্ধমান আস্থার জন্য সঞ্চয়ের এই বৃদ্ধি হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো গত অর্থবছরে তাদের গ্রাহকদের বিতরণ করা ঋণের ৯৮% পুনরুদ্ধারের হারও অর্জন করেছে (তথ্যসূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২০ নভেম্বর)। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যম প্রতিদিন শ্রম বাজারে নতুন নতুন উদ্যোক্তা যোগ হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রান্তিক মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে; যা দেশ ও জনগণের উন্নয়নের নিয়ামক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নও করছে। দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সমবায় ও সমবায়ের ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প নেই। যদি আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। লেখক: মেজবাহ উদ্দিন, অনুবাদক, সাংবাদিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App