×

মুক্তচিন্তা

রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে না কেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:৩৩ পিএম

রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে না কেন?
ব্রিটিশ শাসনামলের রেল ব্যবস্থাপনা ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একই ছিল। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের সারাদেশে যেভাবে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা করে তুলতে পেরেছে এবং একটি ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে পেরেছে রেলের ক্ষেত্রে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী করছে? ভারত ইন্টারকলিং সিস্টেম তৈরি করতে পেরেছে। অর্থাৎ এই সিস্টেম একটি আধুনিক স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিবান্ধব একটি সিগন্যাল সিস্টেম। আর আমাদের বাংলাদেশে এখনো ১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ আমলের কেরোসিনের সিগন্যাল বাতি ব্যবহার করছে! ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ স্টেশনে এখনো আছে এই সিস্টেম। খোঁজ নিলেই দেখা যাবে এই জেলায় ৪৫ কিলোমিটার রেল সড়কে ৪২টি সিগন্যালের মধ্যে ৩০টি চলে কেরোসিনের বাতির সিগন্যাল দিয়ে। সামান্য বাতাস বা ঝড়-বৃষ্টিতে বন্ধ হয়ে যায় বা নিভে যায় বাতি, ফলে রেল বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বাংলাদেশের রেলের এই সিস্টেম ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ৮০র দশকে সিগন্যাল ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা বা বিদেশিদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। ৮০-র দশকে এই সিস্টেমের আধুনিকায়নের জন্য রেলওয়ে টেলিকমিউনিকেশনের তৎকালীন পরিচালক মোকাররম ইয়াহিয়া (এএমএম ইয়াহিয়া) বাইরের ডোনারদের সাহায্য চান। অনেক কিছুর পর নরওয়ের রাষ্ট্রীয় দাতা সংস্থা NORAD সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন ভেবে দেখা যায় যে আর অল্প কিছু টাকা বেশি ব্যয় করলে ফাইবার বসানো যায়, যেটি হচ্ছে আল্টিমেট টেকনোলজি। ফাইবার বসানো হল। তবে সেটি হল অনেকটি পায়জামার চেয়ে ফিতা বড় অবস্থা। মূল টেলিকমিউনিকেশন অপারেটর তৎকালীন বিটিটিবি চলে কপার ক্যাবলে, আর রেলওয়ের সেকেন্ডারি বা সাপোর্ট অপারেশন হিসেবে ইন্টারনাল টেল। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৯৯২ সালে সেই সময় মোট খরচ হয়েছিল ৩০ মিলিয়ন ডলার। যার পুরোটাই নরওয়ের সাহায্যে। এর ফলে রেলওয়ের একটি নিজস্ব টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো তৈরি করা হয়; যদিও সেই ফাইবার ব্যবহার তখনও খুব একটি হয়নি। আজ পর্যন্তও বড় পরিসরে গড়ে তোলা হয়নি। মাত্র ৩০০ স্টেশনের ৩০০ টেলিফোন ব্যবস্থাপনার জন্য কর্মচারী ছিল সে সময় মাত্র ৫০০ জন। আবার এই সংবাদ দ্রুত চোর এবং দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের মাঝে ছড়িয়ে গেল যে রেললাইনের পাশে যে ফাইবার বসানো আছে তাতে উন্নত কপার রয়েছে যার অনেক দাম, ফলে সেই সময় অনেক ফাইবার চুরি হয়ে গেল। বাংলাদেশ রেলওয়ে যখন এই ফাইবার রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছিল না এই সুযোগটি কাজে লাগায় নরওয়ের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন। ১৯৯১ বা ৯২ সালের দিকে কোন এক পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে ১৮০০ কিলোমিটার ফাইবার বাংলাদেশের মাটির নিচে ডেট মুড হয়ে পড়ে আছে। এই সংবাদ প্রকাশিত হবার পর গ্রামীণফোনের একজন লবিস্ট ইকবাল কাদির সাহেব একটি প্রস্তাব করেন যে এই ফাইবার দিয়ে মোবাইল অপারেশন চালানো সম্ভব। পাওয়ার জেনারেশন হচ্ছে টেলিকমিউনিকেশনের সুইচিং সেন্টার, ডাটা ইত্যাদিকে ওই সময় বলা হত এমএসসি, বিএসসি, ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক হচ্ছে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং জটিল বিষয়। পাওয়ার টেলিকম উভয়টির ক্ষেত্রেই সে হতে পারে ফাইবার দিয়ে বা ট্রান্সমিশনের মূল চাবিকাঠি। এই ইকবাল কাদের এই প্রথম যোগাযোগ করে টিল্ডিংয়ের সাথে যখন বাংলাদেশের গ্রামীণফোনের জন্ম হয়নি তিনি নরওয়েকে বুঝাতে চান যে তোমাদের ৩০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের মাটির নিচে পড়ে আছে সেটিকে কিভাবে তোমাদের টেলিকমের মাধ্যমে সেবা দিতে পারো সেটি ভেবে দেখো। তার আগে জানিয়ে রাখি ইকবাল কাদের ছিলেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একজন কনসালটেন্ট। তিনি জাপানের মারবেনই কর্পোরেশনের সাথে যোগাযোগ করে কনভিন্স করে এমনকি পরবর্তীতে ড. ইউনুসের সাথে দেখা করে গঠন করেন গ্রামীণ টেলিকম, অনলি ফোন এবং নরওয়ের টেলিনর কোম্পানির সাথে যৌথভাবে গঠন করেন গ্রামীণফোন। বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় গ্রামীণফোনের কেবলমাত্র বাংলাদেশ রেলওয়ের এই ডাক ফাইবারের ওপর ভিত্তি করে। গ্রামীনফোনের শুরুটা লক্ষ্য করলে দেখবেন যে তারা প্রথমে তাদের সেবাটা যখন দেয়া শুরু করেন তখন গ্রাহকরা একটি টাওয়ার তৈরি করে বা নিজস্ব বিটিএস স্থাপন করে কেবল নেটওয়ার্ক পেতেন। রেলের সাথে চুক্তি হয় কেবলমাত্র তাদের টেলিকম সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণ ফাইবার রক্ষণাবেক্ষণ এবং এই সেবার সাথে যুক্ত যে সকল কর্মচারী তাদের বেতন ভাতা দেবেন আর কিছুই না। অথচ গ্রামীণফোন ড. মো. ইউনুসের পল্লী ফোন বা গ্রামীণ টেলিকম তখন থেকেই আউটগোয়িং ইনকামিং সব দিক দিয়েই সর্বনিম্ন ১০ টাকা কল রেট হিসাব করে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে যায়। রেলের ফাইবারে বিনিয়োগকৃত অর্থ তারা অল্প সময়েই তুলে নিতে সক্ষম হয়। তাদের এই চুক্তি চলে গত ২০ বছর। বর্তমানে রেলের সাথে গ্রামীণ, রবি এবং বাংলালিংকের কিছু চুক্তি থাকলেও পুরোপুরি ভাবে আইনগত জটিলতার কারণে রেলের ফাইবার পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না অপারেটরগুলো। রেলওয়ে বর্তমানে ডাকপুর দিয়েও কয়েকশো কোটি টাকা বছরে আয় করছে। কিন্তু এই ফাইবার ব্যবহার করার কারণে বাংলাদেশ রেল হতে পারতো বিশ্বের আধুনিকতম একটি নেটওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবস্থাপনা। কিন্তু রেলের এই গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক সম্পর্কে রেলের যেমন উচ্চ ধারণা নেই; তেমনি গঠন করা হয়নি এখন পর্যন্ত কোন আলাদা বিভাগ। টেলিকমিউনিকেশন দিয়ে রেলের যেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব ছিল সেটিও তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ রেল দুর্ঘটনা নিয়মিত লেগেই আছে। আমরা রেলের দুর্ঘটনার কয়েকটি চিত্র যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে ভয়াবহ চিত্র। আমরা মনে করি সড়কপথে বেশি দুর্ঘটনা হয়, আর এ জন্য অনেকেই আমরা নিরাপদ ভ্রমণের জন্য ট্রেন বেছে নেই। গত সোমবার বিকেলে (২৩ অক্টোবর) ভৈরবে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ভৈরব বাজার জংশনের আউটার সিগন্যালে যাত্রীবাহী এগারসিন্ধুকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কনটেইনারবাহী একটি ট্রেন পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে এগারসিন্ধু ট্রেনের দুইটা বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরকম অসংখ্য দুর্ঘটনায় হাজার হাজার প্রাণ গেছে রেল দুর্ঘটনায়। রেল দুর্ঘটনার যতগুলো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তার বেশিরভাগ প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে সিগন্যাল ত্রুটি, অথচ আমাদের সক্ষমতা রয়েছে সিগন্যাল ব্যবস্থাকে অগ্রগামী করার কিন্তু সেদিকে আমরা যাচ্ছি না। সাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রেল যেমন একটি আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে ঠিক একইভাবে এই ফাইবার পরিষেবাকে টেলিকমিউনিকেশনে ব্যবহার করে অর্জন করতে পারে হাজার হাজার কোটি টাকা। লেখক: মহিউদ্দিন আহমেদ, সভাপতি, বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App