×

মুক্তচিন্তা

কোন পথে হামাস ইসরায়েল যুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৪৯ পিএম

কোন পথে হামাস ইসরায়েল যুদ্ধ
হামাস ইসরায়েল যুদ্ধ প্রায় ষোলো দিন অতিক্রান্ত হতে চলল। বিশ্ব গণমাধ্যমে এই ষোলো দিনের যুদ্ধে উভয় পক্ষে জীবন ও সম্পদের কি পরিমাণ ক্ষতি হলো তা ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে; যদিও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার আড়ালে তাদের অনেকের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে। আল জাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ইত্যাদি গুটিকতক গণমাধ্যমের সাহসী এবং বিপ্লবাত্মক ভূমিকার কারণে এ যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। এর বাইরেও হামাস এবং হিজবুল্লার মত মিলিশিয়া সংগঠনগুলো তাদের প্রতিটি আক্রমণের যে চমৎকার ভিডিও ফুটেজ (কোন কোন ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট ইমেজসহ) নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে তা এই যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র অনুধাবনে আমাদের জন্য যথেষ্ট সহায়ক হচ্ছে। সুতরাং প্রোপাগান্ডা ওয়ারে ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা একরকম ধরাশায়ী হয়েছে বলা চলে। পুরো বিশ্ব দেখছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইসরায়েলের বর্বরতা; সেই সাথে কাপুরুষতাও। ফলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ইসরায়েলের এ বর্বরতার বিরুদ্ধে শান্তিকামী মানুষ হয়েছে উচ্চকিত। ইসরায়েল সৃষ্টির পর থেকে এত বড় ইমেজ সংকটে দেশটি এর আগে কখনো পড়েনি। এ যুদ্ধের মাস্টারমাইন্ড আসলে কে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধের মাস্টারমাইন্ড সম্ভবত ইরান। তবে একটা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন সব পক্ষই চেষ্টা করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি (সেটি যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে অথবা যুদ্ধ থেকে দূরে থেকে) জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করতে, প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তৃত করতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে আদর্শকে সমুন্নত করতে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকে এ দেশটি যে বিদেশনীতি অনুসরণ করে চলেছে তার অন্যতম প্রধান একটি দিক হলো আল আকসা পুনরুদ্ধার এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের বিলুপ্তি। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ইরান যেমন তার সমর শিল্পকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে পাশাপাশি দেশের বাইরে তৈরি করেছে বেশ কিছু মিলিশিয়া বাহিনী। এদের মধ্যে অন্যতম হলো লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও জিহাদ মুভমেন্ট, ইরাকের পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্স (পিএমএফ) এবং ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়া। এছাড়াও সিরিয়ার শাসক বাহিনী ইরানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। দশকের পর দশক ধরে অত্যন্ত অবিচলতার সাথে ইরান তার লক্ষ্য পূরণে এই বাহিনীগুলিকে অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং টেকনোলজি সরবরাহ করে এসেছে। আব্রাহাম অ্যাকর্ডের পথ ধরে ইসরায়েল যখন মধ্যপ্রাচ্যের নিউক্লিয়াস সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকিরণের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল ঠিক তখনই ইরান হামাসের মাধ্যমে এই আক্রমণ সংঘটিত করার মোক্ষম সময় বিবেচনা করেছে। এ কয়দিনের যুদ্ধে ফলাফল কী? নিঃসন্দেহে ইসরাইলি সেনাবাহিনী সর্বাধুনিক যুদ্ধ-সরঞ্জামে সমৃদ্ধ একটি আধুনিক সেনাবাহিনী। কিন্তু এই সেনাবাহিনীর বর্তমান সেনাসদস্যরা ময়দানী যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি অনুপযুক্ত। যুদ্ধ করার জন্য যে সাহস, মানসিক দৃঢ়তা এবং আত্মোৎসর্গের মনোভাব প্রয়োজন তার কোন কিছুই এদের মধ্যে নেই। পক্ষান্তরে হামাসের কাছে আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জামের অপ্রতুলতা থাকলেও তাদের আছে সাহস, কৌশল এবং আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার ঐকান্তিক বাসনা। এই যুদ্ধে যাতে কোন নিরীহ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার না হয় সে ব্যাপারে হামাস সর্বোচ্চ সর্তকতা বজায় রেখে চলেছে। এ পর্যন্ত আনুমানিক তারা প্রায় একশত সৈন্য হত্যা করেছে এবং আরো প্রায় দুইশত সৈন্যকে ইসরায়েলের ভেতর থেকে গ্রেফতার করে গাজায় জিম্মি করে রেখেছে। নিশ্চিতভাবে এ এক অভাবনীয় সাফল্য। পক্ষান্তরে ইসরাইলি সেনাবাহিনী নির্বিচারে গাজায় বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ নারী ও শিশুসহ অসংখ্য মানুষ হত্যা করে চলেছে। তাদের বোমার আঘাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি কোন উপাসনালয়। পাশাপাশি গাজায় যাতে পানি, বিদ্যুৎ ও নিত্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছতে না পারে সেজন্য চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। অপর পক্ষে গাজার আশেপাশে প্রায় তিন লক্ষ সৈন্য সমাবেশ করেও অভিযান পরিচালনা করার সাহস দেখাতে পারছে না। তারা গাজায় একজন হামাস সদস্যকেও হত্যা কিংবা গ্রেফতার করতে পেরেছে এমন নজির দেখাতে পারেনি। যুদ্ধে কোন পক্ষ কতজন নিরীহ মানুষ হত্যা করতে পারলো তা যুদ্ধ জয়ের মাপকাঠি নয়; বরং তা কাপুরুষতা। সুতরাং এ কয়দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল কাপুরুষতার পরিচয় দিলেও স্পষ্টতই হামাস জয় লাভ করেছে। কী হবে গাজার সাধারণ মানুষের? কথায় কথায় গাজায় বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ মানুষ হত্যা করা ইসরায়েলের জন্য একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। সুতরাং গাজায় আরো সাধারণ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে তা অবধারিত। তবে বিশ্ব জনমত ইসরায়েলের এই গণহত্যার বিরুদ্ধে যেভাবে ফুঁসে উঠেছে তা ইজরায়েল উপেক্ষা করতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তা উপেক্ষা করা বেশিদিন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ইসরায়েল যদি সর্বোচ্চ আগামী পনেরো দিনের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং অবরোধ প্রত্যাহার না করে তবে নিশ্চিতভাবে এ যুদ্ধের পরিধি বিস্তৃত হতে বাধ্য। ইরান কি সরাসরি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে? যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরগুলিকে অতি দ্রুত ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইরান যেন সরাসরি এই যুদ্ধে সম্পৃক্ত না হয়। তাছাড়া ইরানকে ঘিরে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পঁচিশটি সেনা ঘাঁটি রয়েছে। সুতরাং ইরান এই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্র সর্বশক্তি নিয়ে ইরানের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইরানের শক্তি এবং সামর্থ্য সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তাতে মনে হয় এ অঞ্চলে একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে মোকাবেলা করার মত যথেষ্ট সামরিক সক্ষমতা ইরানের রয়েছে। কিন্তু যে জায়গায় ইরান সবচেয়ে দুর্বল সেটি হলো ইরানের নিজস্ব কোন ঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্র নেই। কিন্তু এমন হতে পারে যে ইরান ইতিমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রযুক্তি করায়ত্ব করে ফেলেছে। অথবা এমনও হতে পারে যে রাশিয়া কিংবা চীনের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে যাতে করে সে আক্রান্ত হলে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পাবে। ইরান যদি সরাসরি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায় তবে অবশ্যই তার পূর্বে সে বিশ্বকে জানান দেবে তার পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পর্কে অথবা এ চুক্তি সম্পর্কে। তুরস্ক, সৌদি আরব এবং মিশর সহ অন্যান্য আরব দেশের ভূমিকা কী হবে? ন্যাটোর অন্যতম সদস্য হিসেবে তুরস্কের এই যুদ্ধে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে তুরস্কের গোয়েন্দা বাহিনী এম আই টির একসময়ের পরিচালক এবং বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাঁকান ফিদান যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত যে ডিপ্লোম্যাটিক ভূমিকা পালন করে চলেছেন তা এক কথায় অনন্য। পুরো আরব বিশ্বকে এই যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে তুরস্ক অবশ্যই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। ভবিষ্যতে এই যুদ্ধে এরদোগানের তুরস্ক আর কী ভূমিকা পালন করে তা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে বিশ্ব মুসলিম। ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য মিশরে যুক্তরাষ্ট্রের তথা ইসরায়েলের অনুগত সরকার ক্ষমতায় থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এই কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মিশরের একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন সেই সময়ের সেনাপ্রধান বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি। সিসি ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের সাথে মিশরের একটি বৈরী সম্পর্ক বলবৎ ছিল। হাঁকান ফিদান এই বৈরিতা অবসানে এবং মিশরের সাথে একটি সহযোগিতামূলক ডিপ্লোম্যাটিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইসরায়েলের সিসির প্রতি প্রচণ্ড চাপ ছিল যাতে গাজার অন্তত অর্ধেক অধিবাসীকে রাফা ক্রসিং এর মাধ্যমে মিশরে স্থানান্তর করে নেয়া হয়। সেটি হলে পরবর্তীতে কার্পেট বোম্বিং ও বাঙ্কার ব্লাস্টারের মাধ্যমে জনশূন্য পুরো অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে দখলে নিতো ইসরায়েল। তুরস্কের ডিপ্লোম্যাটিক প্রচেষ্টায় ইসরায়েলের এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছে মিশর যা এই যুদ্ধের একটি অন্যতম টারনিং পয়েন্ট। অপর পক্ষে সৌদি আরবসহ এতদঞ্চলের অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলি কৌশলগত কারণে এই যুদ্ধে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারবে না। তবে তারা যদি সকলে একত্রে এ গণহত্যার বিপক্ষে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে এবং একটি পর্যায়ে অন্তত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে সেটি অনেকাংশে এ যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা কী হবে? রাশিয়া বা চীন কোন দেশই সরাসরি এ যুদ্ধে সম্পৃক্ত হবে না। তবে এই যুদ্ধ থেকে তারা তাদের ফায়দা হাসিল করতে চেষ্টা করবে। এর আগে যেমনটি বলছিলাম, রাশিয়া বা চীনের কোন একটি দেশ যদি ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক হুমকিকে কোনভাবে প্রশমিত করতে সহায়ক হয় তা এ যুদ্ধে অনেক বড় ডমিনেটিং ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেটি হতে পারে ইরানের সঙ্গে কোন একটি পারমাণবিক চুক্তি অথবা ইরানের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের মত পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ নৌবহর স্থাপন। এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে সেই ক্ষেত্রে খুব সম্ভবত চীন তাইওয়ান আক্রমণের মাধ্যমে পুরোপুরি দখলে নিতে চেষ্টা করতে পারে। আর রাশিয়া চেষ্টা করবে ইউক্রেনে আক্রমণ আরো জোরদার করে যত দ্রুত সম্ভব কিয়েভ পদানত করতে। পরিশেষে বলা যায় এই যুদ্ধ ইসরায়েলকে তার অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত করেছে। যুদ্ধকে দীর্ঘদিন টেনে নেয়ার মত সামর্থ্য যেমন তার নেই ঠিক একইভাবে ইসরায়েল যদি একটি যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হয় তারপরেও ইহুদিদের নিরাপদ আবাস হিসেবে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে তা ইসরায়েলের অস্তিত্ব কতদিন অক্ষুণ্ণ রাখবে তা সময়ই বলে দেবে। লেখক: মো. তৌহিদুল ইসলাম, প্রভাষক, পদার্থ বিজ্ঞান, মসজিদ মিশন একাডেমি (স্কুল এন্ড কলেজ), রাজশাহী

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App