×

মুক্তচিন্তা

রিফাতের মামলা এবং কিছু কথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২২, ১২:৫০ এএম

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আরফানুল হক রিফাতকে মনোনয়ন দেয়ার পর অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, এই প্রার্থীকে এবং কেমন? কুমিল্লায় আমার বাড়ি, কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনাও কুমিল্লায়; তাই কুমিল্লার বাইরের সাংবাদিক বন্ধুদের কৌতূহল আমার কাছে। কিন্তু কুমিল্লার সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনিয়মিত, দেশের আর ১০টা জেলার মতোই। তাই সবার কৌতূহল মেটানোর মতো পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে নেই। ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পরের আনন্দ মিছিলে কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে আমিও ছিলাম। ঠিক মনে নেই, তবে নিশ্চয়ই আরফানুল হক রিফাতও ছিলেন সেই মিছিলে। তাহলে সেটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ৩২ বছর না দেখা একজন মানুষ কেমন, চট করে সেটা বলে ফেলা সঠিক নয়। বছর দুয়েক আগে আরফানুল হক রিফাত গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। দেশে-বিদেশে দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছেন। শুনেছি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন। আওয়ামী লীগ আমলে বিপুল বিত্তের মালিক হওয়াটা অন্যায় নয়। ব্যবসা করার অধিকার সবার আছে। নিন্দুকরা আরফানুল হক রিফাতের অর্থের উৎস নিয়ে নানা কথা বলেছেন, যার সব বৈধ নয়। তবে যেহেতু আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই, তাই আমি অভিযোগগুলো বিশ্বাসও করিনি, অবিশ্বাসও করিনি, কোথাও উল্লেখও করিনি। তবে গত এক যুগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাদের সম্পর্কে যা যা শুনেছি; তাতে কিছুই আর অবিশ্বাস্য লাগে না। কুমিল্লার মানুষ আরফানুল হক রিফাতকে চিনলেও, বাইরের মানুষের কাছে তিনি সে অর্থে পরিচিত নন। আশা করি এবারের নির্বাচনের পর সারাদেশের মানুষ তাকে চিনে নেবে। তবে কীভাবে চিনবে, সেটা এখনো নির্ধারিত নয়।

আরফানুল হক রিফাত কেমন মানুষ, সেটা সবাইকে জানাতে না পারলেও তিনি কে, সেটা আমি বলেছি। তার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তারচেয়ে বড় কথা হলো তিনি আওয়ামী লীগে হাইব্রিড নন বা সুখের পায়রা নন। আশির দশক থেকেই তিনি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ৮১-৮২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সফিক-জাহাঙ্গীর পরিষদে বহিঃক্রীড়া ও ব্যায়ামাগার সম্পাদক পদে জয়ও পেয়েছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে অনেকবার নির্যাতিত হয়েছেন। আশির দশকে শিবির একবার ধরে নিয়ে তার হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছিল। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ চিকিৎসায় তিনি প্রাণে বাঁচেন। চার দশক ধরে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে থাকা কেউ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলে সেটা বিস্ময় জাগায় না।

তবে সমস্যাটা সৃষ্টি হয়, আরফানুল হক রিফাতের মনোনয়ন পাওয়ার পর। প্রথমে ভোরের কাগজ এবং পরে ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আরফানুল হক রিফাতকে শীর্ষ মাদক কারবারি হিসেবে অভিহিত করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। আরফানুল হক রিফাত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছেন, পরশ্রীকাতর হয়ে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এতদিন রিপোর্ট না করে, মনোনয়ন পাওয়ার পরই তাকে নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করাকে তিনি উদ্দেশ্যমূলক হিসেবে অভিহিত করেন। প্রথম কথা হলো, এমনিতে আরফানুল হক রিফাত জাতীয়ভাবে পরিচিত কেউ নন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পরই তিনি জাতীয় পত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে তার সবকিছু এখন জনগণ এবং গণমাধ্যমের নজরে থাকবে। আরফানুল হক রিফাত দাবি করেছেন, রিপোর্টে প্রকাশিত অভিযোগের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি, কোনো সমন আসেনি। তার দাবি একদম সঠিক। মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে আরফানুল হক রিফাতের বিরুদ্ধে কেউ মামলাও করেনি, তাই সমন পাওয়ারও প্রশ্ন আসে না। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠির সঙ্গে একটি তালিকাও ছিল। সেই তালিকায় মাদক, চোরাকারবারি এবং এদের পৃষ্ঠপোষকদের নাম ছিল। যাচাই-বাছাইয়ের পর তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়। গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় প্রণয়ন করা সেই তালিকায় কুমিল্লা জেলার ১৬ জনের নাম ছিল। যার প্রথম নামটিই আরফানুল হক রিফাত। তালিকায় তাকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাসা মনোহরপুর বলে উল্লেখ করা হয়। আরফানুল হক রিফাত ভাগ্যবান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো সেই তালিকা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাদক ও চোরাকারবারের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো সেই চিঠির সূত্র ধরেই ভোরের কাগজসহ বিভিন্ন পত্রিকা রিপোর্ট করেছে। গত ১৫ মে ভোরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘কুমিল্লার শীর্ষ মাদক কারবারি রিফাত এখন নৌকার কাণ্ডারি’। বাংলাদেশে আমাদের সবার প্রবণতা হলো, অস্বীকার করা। রিফাতও তাই করেছেন। সব অভিযোগ অস্বীকার এবং প্রকাশিত সংবাদকে মিথ্যা দাবি করেছেন। তবে দাবি পর্যন্ত থাকলেও না হয় কথা ছিল। আরফানুল হক রিফাত ভোরের কাগজের প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরী, সম্পাদক শ্যামল দত্তসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ১০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছেন। আরফানুল হক রিফাতের বিরুদ্ধে নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের যে হিসাব শুনেছি, তার আংশিক সত্য হলেও ১০ কোটি টাকা সামান্য মাত্র। তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার পয়েন্টটা পরিষ্কার হলো না। এমনিতে সাংবাদিকরা সবচেয়ে সহজ টার্গেট। সব অপরাধীই নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কেউ মামলা করে, কেউ হামলা করে। সত্য সংবাদ প্রকাশ করেও আজ ভোরের কাগজকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। ভোরের কাগজের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় দলিল আছে। আসলে আরফানুল হক রিফাতের ভোরের কাগজ নয়- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত ছিল। আরফানুল হক রিফাতকে কেন মাদক ও চোরাচালানে কুমিল্লার এক নম্বর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলো, সেই প্রশ্নের জবাব তো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দিতে পারবে, শ্যামল দত্ত নয়। সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ভোরের কাগজ রিপোর্ট করেছে। সঠিক তথ্য পেলে অন্য সব গণমাধ্যমও এটা নিয়ে রিপোর্ট করতে পারে। আরফানুল হক রিফাত কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দেবেন, কয়জনের মুখ বন্ধ করবেন? আর শ্যামল দত্তের বিরুদ্ধে মামলা করলে কী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তালিকা মিথ্যা হয়ে যাবে?

এক সময়ের ত্যাগী ও নির্যাতিত ছাত্রনেতা আরফানুল হক রিফাতকে এখন মাদক ও চোরাকারবারিদের শীর্ষ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভাবতে এবং লিখতে আমারই খারাপ লাগছে। একসময় ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম বলে প্রথমে বিশ্বাসও হতে চায়নি। আরফানুল হক রিফাত ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আওয়ামী লীগ করলেই তিনি মাদক কারবারি হতে পারবেন না, এমন কোনো কথা নেই। বরং গত এক যুগে দেশের সব অপকর্মের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নাম আসে। মুখে মাদক-চোরাকারবারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রমাণ মেলে না। টেকনাফের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে সারাদেশের সবাই ইয়াবাসম্রাট হিসেবে চেনে। কিন্তু তাতেও আওয়ামী লীগের প্রশ্রয় পেতে তার কোনো সমস্যা হয়নি। গত নির্বাচনের আগে সমালোচনার ঝড় সামলাতে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। তবে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন তার স্ত্রী। গত ১২ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে চিহ্নিত মাদকসেবী, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, চিহ্নিত ভূমিদস্যু, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চিহ্নিত চাঁদাবাজদের কোনো পর্যায়ের কোনো নেতৃত্বে রাখা যাবে না।’ এর পরদিন মানে ১৩ মে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় কুমিল্লা জেলার শীর্ষ মাদক কারবারি আরফানুল হক রিফাতকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়।

তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেই জয়- এই সূত্র কুমিল্লায় খাটে না। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম দুই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হেরেছিল। তাই জয় পেতে হলে আরফানুল হক রিফাতকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেই জনগণের কাছে যেতে হবে। গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে তিনি নিজের অপরাধ আড়াল করতে পারবেন না। আমি ভালো না চিনলেও কুমিল্লার মানুষ নিশ্চয়ই ভালো করেই তাকে চেনে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App