×

তথ্যপ্রযুক্তি

ব্যাংকিং সফটওয়্যারে বিপ্লব সৃষ্টি করেছি: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক

মিজানুর রহমান সোহেল

মিজানুর রহমান সোহেল

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৫ পিএম

ব্যাংকিং সফটওয়্যারে বিপ্লব সৃষ্টি করেছি: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বহুল সমাদৃত কোর ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার “ফ্লোরা ব্যাংক” এর প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক। ছবি: ভোরের কাগজ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে বিএসসি ও এমএসসি করেছেন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের দিকপাল মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার জিই ক্যাপিটাল ও কম্পিউটারল্যান্ডে কাজ করেন। ১৯৯৭ সাল থেকে মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম দেশের সবচেয়ে বড় তথ্যপ্রযুক্তির নির্ভর ও সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা টেলিকম ও ফ্লোরা সিস্টেমস পরিচালনা করে আসছেন। ফ্লোরা সিস্টেমস প্রতিষ্ঠার পর তিনি তৈরি করেন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বহুল সমাদৃত কোর ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার “ফ্লোরা ব্যাংক”। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কর্মাস ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, দ্য ট্রাস্ট ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক এবং জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ২৫৫টি শাখায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

দেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসে (বেসিস) প্রথম মেয়াদে (২০০২ সাল) অর্থ-সম্পাদক এবং দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৪ সাল) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দুই দফায় সফলভাবে যুক্ত ছিলেন। তার নেতৃত্বেই বেসিসের বিডিবিএল ভবনে স্থাপিত হয় দেশের প্রথম সফটওয়্যার ইনকিউবেটর এবং তিনিই ছিলেন দেশের প্রথম বেসিস সফটএক্সপোর আহ্বায়ক। তিনি চারবার যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত কমডেক্সফলে সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রপ্তানি প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের হয়ে নেতৃত্ব দেন। তিনি এফবিসিসিআই-এর সঙ্গে দেশের প্রথম জাতীয় আইসিটি নীতিমালার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক এবার বেসিস ২০২৪-২৬ মেয়াদের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন।

যে পথ সহজে কেউ মাড়ায় না, যে পথে প্রতিবন্ধকতা আর চ্যালেঞ্জ বেশি, সাধারণত সেই পথই বেশি টানে মোস্তাফা রফিকুল ইসলামকে। অনেকেই তাকে চেনেন ডিউক নামে। যখন প্রশ্ন করা হলো তাকে, কেন কঠিন পথেই হাঁটেন? সহজ জবাব তার- “এই পথেই মেলে আলোর সন্ধান।” আলোর ছটায় সবসময় নিজেকে মেলে ধরতে চান না তিনি। বরং পর্দার পেছন থেকেই কাজ করে যেতে ভালোবাসেন; ভালোবাসেন “নেপথ্যের নায়ক” হয়ে থাকতে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে পড়াশোনা করা এই প্রযুক্তিবিদ শুধু মুখের বুলি দিয়ে নন, গভীরভাবে প্রযুক্তিখাতের প্রতিটা বিষয়ের সঙ্গে জুড়েছেন। ব্যক্তিজীবন ও নিজ হাতে গড়া স্বপ্নের ফ্লোরা ব্যাংকের গল্প ভোরের কাগজকে শোনালেন বাংলাদেশের প্রযুক্তিজগতের সফলতম উদ্যোক্তা মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম।

ভোরের কাগজ: ফ্লোরা লিমিটেড বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের একটি বহুল সমাদৃত প্রতিষ্ঠান। ফ্লোরা লিমিটেডের পথচলা কিভাবে শুরু হয়েছিল?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই শুরু হয় ফ্লোরা ব্যাংকের যাত্রা। সে সময় এর নাম ছিল ফ্লোরা এন্টারপ্রাইজ। আমার বাবা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। তার হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় এই কোম্পানি। তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক। সেই সঙ্গে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতেও কাজ করেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর বাবা ঠিক করলেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের চেষ্টায় কোনো ব্যবসা শুরু করবেন। নতুন একটি দেশে শুরু করবেন নিজের হাতে গড়া নতুন একটি দেশি কোম্পানি। সেই লক্ষ্যেই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ফ্লোরা লিমিটেডের জন্ম হয়।

পারিবারিকভাবে ব্যবসার মানসিকতা আমাদের ভেতর গড়ে উঠেছে। আর তাই এটা আমার রক্তেই ছিল। আমার দাদা ইয়াঙ্গুনে (বর্তমান রেঙ্গুন: মিয়ানমারের রাজধানী) ব্যবসা করতেন। বছরের ৬ মাস থাকতেন ইয়াঙ্গুনে, ৬ মাস চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ মানুষের মন মানসিকতাই ব্যবসাবান্ধব। আমার খুবই সামান্য পরিমাণ পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। তিনি নতুন নতুন স্বাধীন হওয়া এই দেশের মানুষকে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবান্ধব সরঞ্জামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনিই প্রথম দেশে টাইপরাইটার নিয়ে আসেন। দেশের বাজারে আনেন ডিজিটাল ক্যালকুলেটর। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো নিয়ে আসেন ক্যানন কপিয়ার। তখন থেকেই বাংলাদেশে ক্যাননের বিশেষ আমদানিকারক হিসেবে কাজ করছে ফ্লোরা।

আমার বাবা পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে খুঁজে খুঁজে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক লেখাগুলো পড়তেন। শুরুতে এভাবে কয়েকটি ম্যাগাজিনের লেখা পড়ে বাবা কম্পিউটার আর তথ্যপ্রযুক্তির বিষয় নিয়ে ভীষণ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে আসে রেডিওস্যাক, আর ক্যান্ডি কম্পিউটার্স শুরু করে এর প্রচার-প্রচারণা। রেডিওস্যাক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ ওয়ারলেস ও ইলেকট্রিক পণ্যের স্টোর।

ভোরের কাগজ: বাবার ব্যবসায় আপনি কিভাবে যুক্ত হন?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: ১৯৮৭ সালে সেন্ট যোসেফ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করি। সেই সময় একদিন বাবা আমাকে বললেন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বেসিক কম্পিউটার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। আমাকে ওতে ভর্তি হতে বলেন তিনি। আমিও খুব আগ্রহের সঙ্গে ট্রেনিং শুরু করি। আমার সঙ্গে বুয়েটে দুই ছাত্র ছিল ওই ট্রেনিংয়ে। ট্রেনিং শেষে আমাদের একটা পরীক্ষা হয়। তাতে ১০০ তে ৯৯ পেয়েছিলাম। অনেক কিছু শিখেছিলাম ওই ট্রেনিং থেকে। বলতে গেলে ওই ট্রেনিং থেকেই আমার কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার আগ্রহ জন্মায়।

এরপর আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। সেখান থেকে ১৯৮৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভর্তি হই পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করি। পারডিউ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ যুক্ত করা হয়েছিল। পারডিউ এই বিভাগ চালু করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ১ মিলিয়ন ডলারের তহবিল পেয়েছিল। আমার পড়ার বিশেষায়িত বিষয়টি ছিল এইচটিএমএল, যা ঠিক ওই সময়টাতেই চালু হয়েছিল। অপারেটিং সিস্টেমের প্রতি আমার ছিল বিশেষ আগ্রহ। আমি সে সময়ই একটা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরি করেছিলাম, নাম দিয়েছিলাম ‘বি’।

আমার অনুপ্রেরণা ছিলেন প্রফেসর ডগলাস কমার। টিসিপি/আইপি প্রোটোকল নিয়ে কাজ করে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাওয়া খ্যাতনামা অধ্যাপক তিনি। টিসিপি/আইপি প্রোটোকল নিয়ে তার লেখা বইটিকে টিসিপি/আইপির বাইবেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জিনু নামে একটি অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করেছিলেন তিনি, ইংরেজিতে উল্টো করে লিখলে তা হয় ইউনিক্স। ১৯৮০ সালে পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এই অপারেটিং সিস্টেমটি তিনি তৈরি করেন। তার জিনু ল্যাবে আমি কাজও করেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় লম্বা ছুটি পেলে যখন বাংলাদেশে আসতাম, তখন ছুটির ফাঁকে ফ্লোরায় ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করতাম। তেমনই এক ছুটিতে কাজ করতে গিয়ে জানতে পারি, বিশ্বখ্যাত কম্প্যাক কোম্পানি চিঠি পাঠিয়েছে ফ্লোরা লিমিটেডে। তারা বাংলাদেশে তাদের পণ্য আমদানির দায়িত্ব আমাদের দিতে চায়। বাবা চিঠিটা খুলেও দেখেননি। আমি যখন পারডিউয়ে মাস্টার্স করছিলাম, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কম্পিউটার ফ্রাঞ্চাইজি কম্পিউটার লাইনে কাজ করতাম। তাদের হয়ে কম্পিউটার বিক্রি করতাম। তাই আমি জানতাম কম্প্যাকের ব্যাপারে, আর কম্প্যাক দিন দিন যুক্তরাষ্ট্রে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সেটাও। এমনকি সে সময় আইবিএম পর পরই তারা বাজারে প্রথম নোটবুক এনেছিল।

বাবাকে বললাম, এটা আমাদের জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগ। আমাদের কম্প্যাকের সঙ্গে কাজ করা উচিত। আমি কম্প্যাককে চিঠি লিখে জানালাম, আমরা বাংলাদেশে তাদের পণ্যের আমদানিকারক হতে আগ্রহী। এরপর ছুটি শেষে আবার ফিরে যাই যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে একদিন বাবর ফোন এলো। জানালেন, কম্প্যাক থেকে চিঠি এসেছে, ফ্লোরাকে তারা তাদের পণ্য আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে।

১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি। ফিরে আসার আগে ওখানে জেনারেল ইলেকট্রিক ক্যাপিটালে বেশ লোভনীয় বেতনের একটা চাকরি পাই, কিছু দিন কাজটাও করি। কিন্তু নানা কারণে আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। প্রথমত, বাবার বয়স হয়ে গিয়েছিল। তিনি চাইছিলেন আমি যেন দেশে এসে ফ্লোরার কম্পিউটার ব্যবসার হাল ধরি। আর দ্বিতীয়ত, যেমনটা আমি আগে বলেছি, ব্যবসা আমার রক্তে ছিল। আমিও ব্যবসাই করতে চাইছিলাম, মোটা অংকের বেতনের চাকরি না। ওই সময়টায় ফ্লোরাও দুর্বার গতিতে এগোচ্ছিল। ফিরে এসেই আমি বাংলাদেশে ইপসনের পণ্যও আমদানির জন্য চুক্তি করি।

ভোরের কাগজ: যখন দেশে ফিরে এলেন, তখন বাংলাদেশের কম্পিউটার ব্যবসার অবস্থা কেমন ছিল?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: ১৯৯৩ সালে যখন আমি ফিরলাম, তখন সবেমাত্র দেশের ব্যবসা জগতে পার্সোনাল কম্পিউটারের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করেছে। ফ্লোরা থেকে প্রতি মাসে ৩-৪টা করে কম্পিউটার বিক্রি হতো। সে সময় একেকটা কম্পিউটার ১ লাখ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হতো। প্রতিটি কম্পিউটার থেকে আমাদের গড়ে ৩০ হাজার টাকার মতো লাভ হতো। অতিরিক্ত দামের কারণেই সে সময় শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি হতো পারসোনাল কম্পিউটার। 

ভোরের কাগজ: ব্যাংকিং সফটওয়্যার ডেভেলপ করার পরিকল্পনা প্রথম কখন ও কিভাবে মাথায় এলো? ফ্লোরা ব্যাংকের যাত্রা শুরু হলো কিভাবে?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: ১৯৯১ সালের কথা। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। বাবা ফোন করে আমাকে একটা ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে কাজ শুরু করতে বলেন। তিনি যেহেতু এক সময় ব্যাংকার ছিলেন, তাই বুদ্ধিটা তার মাথাতেই আগে আসে। তা ছাড়া সে সময় বিদেশি ব্যাংকগুলো সফটওয়্যারের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেছিল। বাবা চেয়েছিলেন দেশের স্থানীয় ব্যাংকগুলোর জন্য একটা সফটওয়্যার বানাতে। সে সময় আমি তাকে বলেছিলাম, এত বড় পরিসরের সফটওয়্যার ডেভেলপ একা একজনকে দিয়ে সম্ভব না। এর জন্য লোকবল লাগবে। সেই যাত্রায় ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে কাজ শুরু না হলেও, মাথার ভেতর এর পরিকল্পনার বীজ বোনা হয়ে যায় তখনই।

এরপর আসে ১৯৯৭ সাল। ৪ বছর কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও মেশিনারিজ ব্যবসার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি ‘ফ্লোরা লিমিটেড’ নামে একটি সফটওয়্যার কোম্পানি গড়ে তুলি। শুরুতেই আমরা ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে কাজ শুরু করিনি। এমনকি হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া কেউই সে সময় ব্যাংকিং সফটওয়্যার কাজ শুরু করেনি। ‘ইজ কম্পিউটার্স’ বলে একটা কোম্পানি ছিল। তারা ব্যাংকিং সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছিল। ওই সময়ে বাজারে সবচেয়ে প্রতাপশালী ছিল বেক্সিমকো কম্পিউটার্স। তারা বেক্সিব্যাংক নামে একটি ব্যাংকিং সফটওয়্যার ছেড়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল শুধু ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং সফটওয়্যার, কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার না।

তারপর হলো কী, ইজ কম্পিউটার্স জনতা ব্যাংকের একটি শাখার জন্য ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং সফটওয়্যার বানানোর চুক্তি নিয়েও তা করতে পারেনি। এই খবর শুনে আমার ব্যক্তিগত সহকারী, যিনি নিজেও আইটি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, আমাকে প্রস্তাব দিল আমরা সফটওয়্যারটি ডেভেলপ করতে পারি। তখন তাকে বললাম, এটা তো ২-৩ বছরের কাজ। এরপরও তিনি আমাকে এ নিয়ে বলে যেতেই লাগলেন। তাই শেষমেশ এক সময় জনতা ব্যাংকে আমাদের আগ্রহের কথা জানালাম, প্রকল্পটা পেয়ও গেলাম, কাজ শুরু করে দিলাম নিজেদের ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে।

১৯৯৭ সালেই আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে। ওই বছর প্রথমবারের মতো বিল গেটস ভারত সফরে আসেন। বাংলাদেশে মাইক্রোসফটের প্রতিনিধি ও আমদানিকারক ছিল ফ্লোরা। সেই সুবাদে বিল গেটসের সঙ্গে ভারতে একটি ডিলারশীপ মিটিংয়ের জন্য আমি আমন্ত্রণ পাই। ভারত থেকে ২০ জন ও বাংলাদেশ থেকে মাত্র ২ জন এই বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, যেখানে সরাসরি পাওয়া যাবে বিল গেটসের সাক্ষাৎ। মুম্বাইয়ের ওবেরয় হোটেলে মিটিংটা হয়। স্পষ্ট মনে আছে, এটা ছিল ওই সময়ের অনেক বড় একটা ঘটনা। ভারতের সব বড় বড় পত্রিকার প্রথম পাতায় বিল গেটসের খবর ছাপা হয়েছিল। একদিনে ভারত সফরে আসে ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ রামোস, কিন্তু বিল গেটসের সামনে এই খবর  কোনো গুরুত্বই পায়নি।

মিটিংয়ে অংশে নেওয়া মাইক্রোসফটের প্রত্যেক ডিলারকে বিল গেটসের কাছে একটা করে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, “ভবিষ্যতে এসকিউএল সার্ভারের কী হবে?” তাকে এই প্রশ্ন করার কারণ ছিল আমি বিপুল পরিসরে ব্যাংকিং সফটওয়্যারের পেছনে বিনিয়োগ করতে চাইছিলাম। তাই আমার মূল চিন্তা ছিল আমাদের ব্যাংকিং সফটওয়্যারের ডেটাবেজ ওরাকল নাকি এসকিউএলে করা উচিত হবে? তিনি জবাবে বলেছিলেন, “নোভেল আর উইন্ডোজ সার্ভারের বেলায় যা ঘটেছে, ওরাকল আর এসকিউএল সার্ভারের বেলাতেও তাই ঘটবে ধরে রাখো। তার এই মন্তব্য ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ এর মধ্য দিয়ে তিনি ভবিষ্যতের জন্য খুব মূল্যবান পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। নোভেক্ল নেটওয়ার্ক ছিল সবচেয়ে বৃহৎ নেটওয়ার্কিং টুল এবং ৮০’-৯০’ এর দশকে তারা রীতিমতো একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল প্রযুক্তির বাজারে। তাদের টপকে যাওয়ার কথা কোনো প্রতিষ্ঠান ওই সময় কল্পনাও করতে পারত না। ল্যান অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যারে বাজারে তারা ছিল রাজা। নোভেলের সফটওয়্যার ছাড়া নেটওয়ার্কিংয়ের যেকোনো কাজ ছিল অসম্ভব। কিন্তু উইন্ডোজ সার্ভার একটু একটু করে তাদের জায়গা দখল করে নেয়। একইভাবে ওরাকল কয়েক দশক ধরে ডেটাবেজ সফটওয়্যারের বাজারে আধিপত্য কায়েম করেছিল। কিন্তু বিল গেটস সবসময় বিশ্বাস করতেন ওরাকলের এই জায়গা একসময় দখল করে নেবে এসকিউএল সার্ভার। এবং তার সেই বাণীর ১৯ বছর পর সত্যিই তাই হয়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ওরাকল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ডেটাবেজ প্রডাক্ট হিসেবে ভূষিত হয়। আর প্রথম হয় এসকিউএল সার্ভার।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বহুল সমাদৃত কোর ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার “ফ্লোরা ব্যাংক” এর প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক

ভোরের কাগজ: ফ্লোরা সিবিএস নিয়ে কাজ শুরু করার পর কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: ওই সময় বাংলাদেশে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল না। তাই আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল যোগ্য, দক্ষ ও সুশিক্ষিত লোকবল খুঁজে পাওয়া। তখন প্রথম কাজ হিসেবে আমি লোকবল খোঁজা ও তৈরি করতে শুরু করি।

আমি মাইক্রোসফটের কয়েকজন কনসালটেন্টও নিয়োগ দিয়েছিলাম, যারা আমাদের এসকিউএলের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। হোটেল পূর্বাণীতে বুট ক্যাম্পের আয়োজন করে আমরা সেই কনসালটেন্টদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এসকিউএল সার্ভার ম্যানেজমেন্টের ওই ট্রেইনিংয়ে ৫টি ব্যাচে ১০০ জন করে অংশ নিয়েছিল মোট ৫০০ জন। ভারত থেকে লোক এসেছিল এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। ওই সময় ক্লায়েন্ট সার্ভারের ব্যাপারে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদের পণ্যই ছিল দেশের প্রথম ক্লায়েন্ট-সার্ভার প্রোডাক্ট।

আমার স্বপ্ন ছিল এমন একটি প্রডাক্ট তৈরির যা রিয়েল-টাইম অনলাইন ব্যাংকিং সহ যাবতীয় ব্যাংকিং কাজের চাপ নিতে পারবে ও টেকসই হবে। মাইক্রোসফটের সেই উপদেষ্টারা সে সময় আমাদের ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মূল কাঠামো নকশা করতে ও তৈরিতে ভীষণ সাহায্য করেছিলেন। কাঠামো তৈরি হওয়ার পর আমরা সফটওয়্যার তৈরিতে নেমে পড়ি।

এর পরপরই আমরা জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের কাছ থেকে অর্ডার পেতে শুরু করি। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও আমাদের কাছ থেকে ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিতে শুরু করে। আমরা ২০০০ সালের শুরুর দিকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ও যমুনা ব্যাংকের কাছ থেকে অর্ডার পাই।

২০০২ সালের দিকে এমটিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহি আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, তিনি এমটিবি সব শাখাকে একসঙ্গে এক সফটওয়্যার দিয়ে যুক্ত করতে চান। তিনি জানতে চান, আমি কি এমটিবির জন্য এমন একটা অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম তৈরি করে দিতে পারব কিনা। আমি তাকে ‘হ্যাঁ’ বলে দিই আর তিন মাসের সময় নিই। ওই সময় দেশের কোনো স্থানীয় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়নি। শুধু স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং এএনজেড গ্রিন্ডলেইস ব্যাংকের মতো মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকে এমন সুযোগ ছিল। এর পেছনের কারণ হলো, এ ধরনের অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা তৈরির জন্য ব্যাংকের অত্যাধুনিক সিবিএস থাকতে হতো, যার জন্য প্রায় ৭-৮ কোটি টাকা খরচ হতো। স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য এই খরচ অকল্পনীয়।

তবে এমটিবি এই খরচ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা আমাদের এই কাজ করার জন্য যাবতীয় সহযোগিতা করেছিল। তারাই ছিল প্রথম কোনো ব্যাংক যারা নিজেদের অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যার তৈরির জন্য একটি স্থানীয় কোম্পানির ওপর আস্থা রেখেছিল। যখন ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান এই ব্যাপারে জানতে পারে, তখন তারাও একই ধরনের সার্ভিস নেওয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

সে সময় এ ধরনের অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যার তৈরি যে কতটা কঠিন ছিল, তা এখন কেউ ধারণাও করতে পারবে না। তখন ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল ইন্টারনেট ছিল না। ডায়ালআপ কানেকশন ব্যবহার করতে হতো। যদিও ব্যাংকের জন্য অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার ছিল। ১৯৯৮ সালে এএনজেড গ্রিন্ডলেইস ব্যাংকের জন্য প্রথমবার অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি করেছিলাম। ওটার জন্য প্রথমবার সিসকো রাউটার কিনেছিলাম। সেসময় ভারতেও সিসকো রাউটার পাওয়া যেত না। আমাদের তখন হংকংয়ের ডেটা ট্রাস্ট (যারা সিসকোর পণ্য বিশ্বের এই প্রান্তে আঞ্চলিক ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে আমদানি করত) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করি, শুধু একটি রাউটার বাংলাদেশে আনার জন্য। আমি আমার কয়েকজন কর্মীকে সিঙ্গাপুরে পাঠাই সিসকোর ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। আমরা সফলভাবে এমটিবির জন্য প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। পর্যায়ক্রমে সেই সেবা ট্রাস্ট ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংককেও দেওয়া হয়েছিল।

এই সাফল্যের রেশ ধরেই, কৃষি ব্যাংকও তাদের জন্য অনলাইন ব্যাংকিং প্লাটফর্ম তৈরির কাজ আমাদের দেয়। দেশজুড়ে তাদের প্রায় ১০০০ শাখা ছিল। এদের সবগুলোতে এক প্লাটফর্মে আনা ছিল ভীষণ কঠিন কাজ। তখন আমরা ২০০৯ সালে প্রাথমিকভাবে ৪০টি ব্রাঞ্চ নিয়ে কাজ শুরু করার প্রস্তাব দিই। শুরুতে তাদের আপত্তি থাকলেও, আমরা ৩ মাসের মধ্যে পুরো কাজ করে দেখিয়েছিলাম। এখন আমরা এই ব্যাংকের বাকি ৯৫০+ শাখাতেও আমাদের সেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছি। এই কাজ সম্পন্ন হলে এটাই হবে সর্ববৃহৎ কোনো ব্যাংক যার পুরোটাই পরিচালিত হয় স্থানীয় সফটওয়্যার কোম্পানির বানানো অনলাইন ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।

ভোরের কাগজ: সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত টেমেনোস সিবিএসের জায়গায় ফ্লোরা ব্যাংকের সফটওয়্যার ব্যবহারের বিষয়টি এ দেশে রীতিমত একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: হ্যাঁ, এসবিএসিতে টেমেনোসের জায়গা নেওয়া ছিল আমাদের ফ্লোরা ব্যাংকের জন্য এক বিরাট অর্জন। এসবিএসির আইটি বিভাগের প্রধান মিজানুর রহমান টেমেনোসের বদলে ফ্লোরার সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রস্তাব নিয়ে আসার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের এক নম্বর সিবিএসের (কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার) জায়গায় আমাদের প্রডাক্ট ব্যবহার করা হবে, এই প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই আমরা লুফে নিই। একটা চলমান বাণিজ্যিক ব্যাংকের সক্রিয় সিবিএসের জায়গা নেওয়া এক বিরাট ঝক্কির ও কঠিন কাজ, কিন্তু এটা করার সাহস ও আত্মবিশ্বাস দুটোই আমাদের ছিল। মাত্র নয় দিনে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালাম, টেমেনোস সিবিএসের বদলে সক্রিয় করে ফেললাম ফ্লোরা ব্যাংকের সিবিএস।

আমার ধারণা, আমাদের সাফল্যের পেছনের আসল কারণ হলো আমরা দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল ডেটা মাইগ্রেশনের মধ্য দিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে বিকশিত করে গেছি। আমরা যখন জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রায়ত্তে থাকা ব্যাংকের তথ্য নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন দেখেছিলাম অনেক বড় অংশের তথ্য সংরক্ষিত ছিল ম্যানুয়াল খতিয়ান খাতায়। আমরা সেগুলোকে ডিজিটাল ফরম্যাটে বদলে সংরক্ষণ করি। এই প্রক্রিয়ার জন্য ওই সময় আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ কর্মীকে একটানা দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কাজ করতে হয়েছে।

আমরা শুধু এই ব্যাংকগুলোর হয়ে ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটাল ফরম্যাটে ডেটা মাইগ্রেশনই করিনি, আমরা তাদের হয়ে প্রথম ৩ মাস ব্যাংক ট্রানজেকশনও করে দিয়েছিলাম। পাশাপাশি সে সময় তাদের কর্মীদের আমরা প্রশিক্ষণও দিচ্ছিলাম। তাই আমাদের যোগ্যতা শুধু সফটওয়্যার তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ডেটা মাইগ্রেশনের মধ্য দিয়েও আমরা টেমেনোসকে স্থানান্তরের আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলাম।

পাশাপাশি, আমরা টেমেনোসের ব্যাপারেও সচেতন ছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু জটিল রিপোর্টিং ফর্ম ছিল (সিএল১-সিএল৫ এবং এসবিএস১-এসবিএস৫)। সফটওয়্যারের জন্য এই রিপোর্টিং প্রোভিশন তৈরি করতে আমাদের প্রায় ২-৩ বছর লেগেছিল। এই ধরনের প্রোভিশন তৈরির ব্যাপারে টেমেনোসের কোনো ধারণাই ছিল না। কারণ সেই রিপোর্টগুলো ছিল সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের দেশ ভিত্তিক। টেমেনোস আমাদের কাছে এসে বলেছিল, তাদের সিবিএস যেসব ব্যাংকে আছে আমরা যেন সেসবে গিয়ে ওই রিপোর্টিং প্রোভিশনের কাজগুলো করে দিই। তাই ওই কাজগুলো করতে গিয়েই আমরা টেমেনোসের ভেতর-বাহির সব কিছুই জানতে পেরেছিলাম। এমনকি আমাদের ফ্লোরা ব্যাংকে প্রায় ৩০ জন টেমেনোস স্পেশালিষ্ট ছিল।

ভোরের কাগজ: ফ্লোরা ব্যাংক সিবিএসের কোন বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যদের চেয়ে আলাদা? এটা কি বিদেশি সিবিএসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো সক্ষমতা রাখে?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: এক যুগের বেশি সময় ধরে ফ্লোরা ব্যাংক সফটওয়্যার নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এই দীর্ঘ সময়ের যাত্রায় আমরা দেশের প্রথমসারির স্বনামধন্য ৯টি ব্যাংকের ২ হাজার ২৫৫টি শাখায় আমাদের সেবা দিয়েছি, এবং প্রতিটি শাখাই এখন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে আমাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করে যাচ্ছে। যেকোনো ধরনের সমস্যার সূত্রপাত হলেই আমাদের সাপোর্ট টিম গ্রহণযোগ্য সমাধান নিয়ে সবসময় প্রস্তুত। আমার মতে, এই যে সাপোর্ট টিমের সার্বক্ষণিক সহায়তার মনোভাবই হলো আমাদের সেবার বিশেষত্ব, যা আমাদের বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকে আলাদা করে, এগিয়ে রাখে। কারণ বিদেশি কোনো সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান আমাদের মতো রক্ষণাবেক্ষণ ও সাপোর্টের জন্য সার্বক্ষণিক সহায়তা দেয় না।

আমার মতে, এই যে আমাদের ভোক্তাবান্ধব মানসিকতা এবং সবসময় ব্যাংকিং পণ্যের জন্য নতুন ও অভিনব ব্যবসায়িক চিন্তা উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাওয়াই হলো ফ্লোরা ব্যাংকের সাফল্যের মূল কারণ। এর পাশাপাশি, আমরা সবসময় আমাদের সিস্টেমকে নতুন ও আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের মধ্য দিয়ে হালনাগাদ রাখি। যেমন- আমাদের একটা দলই আছে যারা সবসময় অন্য সিবিএসগুলোর কার্যক্রম ও উন্নতি নিয়ে গবেষণা করে, পর্যালোচনা করে। এরপর ওই কার্যক্রম ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিক নিয়েই কাজ করে দলটি। তারপর সেই সিবিএসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বিশেষত্ব যুক্ত করা হয়ে আমাদের সিবিএসে।

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ফ্লোরা ব্যাংক সিবিএস হলো একটি অনলাইন, রিয়েল টাইম ও কেন্দ্রীভূত একটি কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার, যা একই সঙ্গে কর্পোরেট ব্যাংকিং, রিটেইল ব্যাংকিং এবং ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সমান ও কার্যকরভাবে সব সমস্যার সমাধান করবে। এটা নিষ্ঠার সঙ্গে সবচেয়ে সমন্বিত, সুরক্ষিত ও সুসংগঠিতভাবে তথ্য সংরক্ষণ, তথ্য আহরণ ও তথ্য সংযোজনের কাজ করবে।

আমাদের ফ্লোরা ব্যাংক সিবিএসের বেশ পোক্ত প্রডাক্ট কনফিগারেশনের ক্ষমতাও আছে, যা দিয়ে অনেক সৃজনশীল প্রডাক্টও উদ্ভাবন করা সম্ভব। সেটা হতে পারে ডিপোজিট বা লোন প্রডাক্ট, অথবা এসএমই লোন প্রডাক্ট। আরো হতে পারে কাস্টমার ইনফরমেশন সিস্টেম, কাস্টমার ডিপোজিট, লোন অ্যান্ড অ্যাডভান্স, ইসলামিক ব্যাংকিং প্রডাক্ট, বিল এবং রেমিট্যান্স, ট্রেজারি, ট্রেড ফিন্যান্স, জেনারেল লেজার, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের জন্য কেওয়াইসি এবং ক্রেডিট মনিটরিং সিস্টেম।

আমাদের পণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যও আমরা প্রচুর বিনিয়োগ করি। সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করা এখন ব্যাংকগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আমরা নিশ্চিত করি যে আমাদের পণ্যগুলো বাজারে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত ও সবচেয়ে দৃঢ়তম নিরাপত্তাবলয় সমৃদ্ধ। অর্থাৎ আমাদের সিস্টেমে ঢুকতে হলে, একজনকে অবশ্যই আঙুলের ছাপ ও একেকটি মেশিনের জন্য নির্ধারিত সিরিয়াল নম্বর দিতে হবে। এভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে আমাদের সিস্টেম থেকে ট্রানজেকশন করা যায় না। অন্যদিকে বড় আকারের ট্রানজেকশনের জন্য একজনকে অবশ্যই ডাবল অথেনটিকেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের আলাদা আলাদা ট্রানজেকশন লক আছে, যার ফলে যদি কোনো সমস্যা হয়ও হ্যাকার কোনোভাবেই পালিয়ে পার পাবে না।

ভোরের কাগজ: আমাদের দেশের অন্য কোম্পানির জন্য কি সিবিএস তৈরি করা খুবই কঠিন? আমরা কেন বাংলাদেশে অন্য কোনো কোম্পানিকে এ ধরনের বড় পরিসরের সফটওয়্যার তৈরি করতে দেখি না?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: বড় আকারের সফটওয়্যার তৈরির জন্য সবার আগে দরকার উদার মানসিকতা, প্রচুর লোকবল এবং বিনিয়োগের ক্ষমতা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো না থাকলে, সিবিএস তৈরি যেকোনো কোম্পানির জন্যই অসম্ভব। কারণ সিবিএস তৈরি কোনো খন্ডকালীন কাজ নয়। এটা সময়সাপেক্ষ এবং অনেক অনেক বছর এর পেছনে বিনিয়োগ করতে হয়। ফ্লোরা টেলিকম, ফ্লোরা লিমিটেড ও ফ্লোরা সিস্টেমসের মতো আমার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগ অর্জন আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে ফ্লোরা ব্যাংকের সিবিএস তৈরিতে।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ সফটওয়্যার কোম্পানি স্থিতিশীল কর্মীর সংকটে ভুগছে। আমি ঠিক জানি না বাংলাদেশের আইটি সেক্টরে কর্মীদের স্থিতিশীলতার হার নিয়ে কোনো জরিপ বা সমীক্ষা আছে কিনা। তবে এসব ছাড়াও আমি বলতে পারি যে, এ দেশের আইটি ও সফটওয়্যার সেক্টরে কর্মীদের চাকরি ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা সবচেয়ে কম। বেশিরভাগ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও প্রোগ্রামার ২ থেকে ৩ বছর পরপরই চাকরিক্ষেত্র বদলে ফেলে, এক কোম্পানি থেকে আরেকটায় চলে যায়। কিন্তু একটা সিবিএস ডিজাইন করে তা দাঁড় করাতে সময় লাগে অন্তত ৪ থেকে ৫ বছর। তাই যখন একজন প্রোগ্রামার সিবিএস প্রকল্পে কাজ করার মাঝপথে কোম্পানি ছেড়ে চলে যায়, তাতে করে পুরো প্রকল্পে সমস্যার সৃষ্টি হয়।

যেহেতু আমি একজন প্রোগ্রামার, তাই আমি জানি আরেকজন প্রোগ্রামার কিভাবে চিন্তা করে। আমি তাদের চাহিদাগুলো বুঝি এবং এটা জানি যে কী করলে তারা আর আমার কোম্পানি ছেড়ে যাবে না। প্রোগ্রামাররা হলো ভিন্ন জগতের মানুষ। তারা শুধু টাকার জন্য কাজ করে না। বস হিসেবে যদি তাদের ভাষা, তাদের অভিব্যক্তি, তাদের চিন্তাধারা না বোঝা যায়, তাহলে তাদের সৃজনশীলতা তুলে ধরতে আমি ব্যর্থ হবো, আমি কখনোই তাদের প্রিয় হতে পারব না। এটা হচ্ছে অনেকটা বুদ্ধিবৃত্তিক খেলার মতো, যেখানে প্রত্যাশিত সম্মানটুকু পাওয়ার জন্য নিজেকে একজন পরীক্ষিত নেতা হিসেবে প্রমাণ করতেই হবে। সেই সম্মান অর্জন করে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস ও যোগ্যতা আমার মধ্যে ছিল। তাই তো সিবিএস তৈরির মতো বড় আকারের প্রকল্প হাতে নেওয়ার সাহস দেখিয়েছি।

তবে এখনো দক্ষ ও উচ্চশিক্ষিত লোকবলের সংকট এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকট। বুয়েট থেকে প্রতি বছর অনেক অনেক মেধাবী তরুণ বেরিয় আসে। কিন্তু এদের প্রায় সবাই ভালো ফলাফল করে স্নাতক পাশের পর বিদেশে চলে যায়। বুয়েটের পরই আরো এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ বেরিয়ে আসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমরা সেইসব তরুণ প্রোগ্রামারদের কর্মসংস্থান করি। সেই সঙ্গে আমাদের ট্রেনিংয়ের আওতায় এনে তাদের প্রোগ্রামিং দক্ষতাকে আরো ধারালো করি।

ভোরের কাগজ: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি প্রচলিত মতবাদ আছে, বোর্ড মেম্বাররা (যাদের অধিকাংশই বয়স্ক ও রক্ষণশীল চিন্তাধারা লালন করে) নাকি প্রতিষ্ঠানের আইটি খাতে অত বেশি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায় না। আপনার কী মনে হয়, এখন কি সেই ধারণা বদলে গেছে?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: আমি বিশ্ব করি এখন সময় ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। ব্যাংকের হিসেবে এখন যদি কেউ আইটি সেক্টরে বিনিয়োগে উৎসাহী না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সে মূলত প্রস্তর যুগে থাকতে চায়। এখন প্রায় সব ব্যাংকই নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সিবিএস ব্যবহার করছে। কারণ তারা বুঝে গেছে, বর্তমানে দাঁড়িয়ে কাস্টমারদের স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবিক ডিজিটাইজড সেবা দিতে না পারলে, কাস্টমার অন্য কোথাও চলে যাবে। যদিও ডিজিটাইজেশন বলতে শুধু সিবিএস তৈরি বোঝায় না। বরং এটা হলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাস্টমার যোগ করা, লোন প্রফিটিং এবং লোনের সুযোগ-সুবিধাগুলো তুলে ধরা। আর এগুলো করার জন্য পুরো ইঞ্জিনকে ডিজিটাইজ করা লাগবে। এমনকি ভবিষ্যতে এটাও হতে পারে যে কোনো ব্যাংকার ব্যাংকের ব্রাঞ্চে বসে কাজ করবে না। কারণ এক সময় দেখা যাবে যে ব্যাংকের একটা শাখা খুলে রাখা মানে হলো বিরাট এক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার।

ভোরের কাগজ: আপনি এবার চতুর্থ দফায় দেশের সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বেসিস ২০২৪-২৬ মেয়াদের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। বিজয়ী হলে সফটওয়্যার সেবা খাতে আপনার কি কি করার পরিকল্পনা রয়েছে?

মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক: আমি টিম সাকসেসের পক্ষে এবার বেসিস নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। নির্বাচনে বিজয়ী হলে দ্রুততম সময়ে বেসিসের সংবিধান সময়োপযোগী এবং দূরদর্শী করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে চাই। সদস্যদের সবচেয়ে জরুরী দাবী কর অব্যাহতির সময় বাড়াতে কাজ করতে চাই। ২০২৪ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হবার আগেই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে, বিশেষত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করে বিষয়টি সুরাহা করতে চাই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০৪১ সাল পর্যন্ত আমরা এই সুবিধা পেতে চাই। বর্তমানের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায়, বিশ্বে কেউই আমরা একা চলতে পারি না। অন্যান্য দেশের, অন্তত পক্ষে এশিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেধার আদান-প্রদান বজায় রেখে বৈশ্বিক রাজনীতি মোকাবেলা করার জন্য আমরা অন্য দেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। সফলতার প্রথম ধাপেই দরকার আর্থিক স্বচ্ছলতা। যেকোনো সাফল্য সামগ্রিকভাবে আনতে হলে দরকার অর্থনৈতিক সহায়তা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই কাজ করার ইচ্ছে আছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। আইটি কোম্পানির জন্য সহজ আর সুলভে ঋণ পাওয়ার কাজ করতে নীতিমালা পরিবর্তন, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সর্বোপরি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থিক প্রণোদনা বা সহায়তা পাওয়া নিয়ে আমরা টিম সাকসেস কাজ করবো। নীতিমালা প্রণয়ন করে আমরা ডিজিটাল ব্যাংকগুলোতে সম্ভাবনাময় আইটিখাতে স্বল্প সুদে ঋণ দেবার একটা সুযোগ রাখার অনুরোধ আর ব্যবস্থা দুটিই করতে সচেষ্ট থাকবো। আমাদের প্রস্তাবিত নীতিমালাতে ডিজিটাল ব্যাংকের মোট ঋণ প্রদানের একটা অংশ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা থাকবে। ঢাকা সিটি উত্তরের মেয়র এবং রাজউক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বেসিস সদস্যদের জন্য খুব তাড়াতাড়ি একটা নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা গড়তে চাই। সেইসঙ্গে আমাদের শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করতে চাই। এই লক্ষ্যে টিম সাকসেস কাজ শুরু করেছে বেশ কয়েক মাস আগেই। নির্বাচনে বিজয়ী হলে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব বাস্তবায়ন করবো ইনশাল্লাহ। এবারের বেসিস নির্বাচনে তিনটি প্যানেলে মাত্র তিনজন নারী অংশগ্রহণ করছেন। তাদের মধ্যে দুইজন নারী সদস্য আমাদের প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে কোনো কোনো সময় এই দুইজন নারী যোগ্যতা ছেলেদের চেয়েও বেশি। আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের প্রিয় সংগঠন বেসিসের মূল নেতৃত্বে আসবে নারী। তারাই এই সংগঠনকে লিড দেবে।

টাইমলাইন: বেসিস নির্বাচন ২০২৪-২৬

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App