×

প্রবাস

নিজেকে কখনো অন্যের সঙ্গে তুলনা নয়

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:০৩ পিএম

নিজেকে কখনো অন্যের সঙ্গে তুলনা নয়

বিশ্ব পুণ্যভূমি আজ রক্তাক্ত ও বিধ্বস্ত। বিশ্বমানবতার প্রার্থনা, আমার প্রার্থনা, পৃথিবীর সকল মানুষকে ঘিরে। আমার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে, তাদের ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততাকে নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখতেই পারি। আমার সেই জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা দিনগুলি কিন্তু আমার বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। যেমন যে ছেলে বা মেয়েটি ক্লাসে বেশি মনোযোগী, নিয়মিত পড়াশুনা করে এবং বাড়িতে এসেও হোম ওয়ার্ক করতে ভুলে না, সে সবার কাছে প্রিয় হয়ে বেড়ে ওঠে। সে বছরের পর বছর পরীক্ষার ফলাফল ভালো করে। তাকে সবাই আদর করে এবং সম্মানের চোখে দেখে। এ ধরণের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অবধি সবার প্রিয় হয়ে থাকে।

অন্যদিকে যে ছেলে বা মেয়েটি কোনোরকম টেনেটুনে পাশ করে হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছায়, সে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যে দিয়েই কিন্তু তার ছাত্রজীবন শেষ করে। এরা একই সমাজের দুটো ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। সমাজের পাঠশালা বলতে পুঁথিগত বিদ্যাকেই বোঝানো হয়। সেক্ষেত্রে এই অভাগা অবহেলিত ছাত্র বা ছাত্রীটির মধ্যে পুঁথিগত মেধা ছাড়া অন্য কোনো গুণ থাকলেও তা প্রকাশ করার মতো হিম্মত তার হয়ে ওঠে না সমাজ এমনকি বাবা-মা বা বন্ধু-বান্ধবীর কাছে।

কোনো এক সময় হয়তোবা সেই পুঁথিগত বিদ্যাধারী মস্তবড় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়, অন্যদিকে সেই অবহেলিত শিক্ষার্থী সমাজের ছোটখাটো কাজে যোগদান করে। যখন কিছুই করার থাকে না তখন রাজনীতি করে। এরা কখনও সমাজের চোখে ভালো অ্যাসেট হয়ে স্বীকৃতি পায় না। এরা শুরু থেকেই জানে যে এদের কাজকর্মে কখনও তারা প্রত্যাশিত ফিডব্যাক পাবে না। সেক্ষেত্রে এদের মধ্যে গড়ে উঠে 'হারাবার কিছুই নেই' ধরনের মনোভাব এবং ভাবতে শেখে, যা কিছুই করিনা কেন সবটাই বেটার দ্যান নাথিং।

স্কুল কলেজে পিছনের বেঞ্চে বসা সেই শিক্ষার্থী দেখা যায় মন্ত্রী, ইন্ডাস্ট্রি বা ক্লিনিকের মালিক হয়ে শেষে সেই খ্যাতনামা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের হায়ার করে মোটা অংকের টাকা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয় এবং তখনই ওই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। কোনো একদিন দেখা গেল একটি মডার্ন ক্লিনিকের মালিক ডাক্তারকে ডেকে বলে দিল, শুনুন ডাক্তার বাবু, আমার এখানে কাজ করছেন ভালো বেতনে। এখন যদি বেতনের টাকাটা না তুলে আনতে পারেন তাহলে তো আপনাকে চাকরিতে রাখা সম্ভব হবে না।

ডাক্তার হয়ত বললো, তাহলে আমাকে কী করতে হবে? কী করতে হবে মানে বুঝতে পারছেন না? তাহলে শুনুন গত মাসে ৩০টি ডেলিভারির রোগী এসেছে। তাদেরকে নরমাল ডেলিভারি না করে যদি সিজার করতেন তাহলে আমার ক্লিনিকের যে সমস্ত ইকুইপমেন্ট রয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার হতো, নার্স থেকে শুরু করে সবাই ফুল টাইম কাজ পেতো। আমার যে ইনভেস্ট তা উঠে আসতো, সঙ্গে আপনার বেতনসহ কিছু এক্সট্রা সুবিধা পেতেন। ডাক্তারের বিষয়টি না বোঝার কোনো কারণ থাকার কথা নয়।

সারাজীবন পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে যাদের উঠাবসা তারা জানে দুই প্লাস দুই চার হয়। অতএব মালিককে খুশি করতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখন শুরু হয়ে গেল কসাইখানা। এমতাবস্থায় রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের সম্পর্কটা কখনও মনঃ-পূত হতে পারে কি? মালিক গড়ছে টাকার প্রাসাদ, রোগী গড়ছে ঘৃণার প্রাসাদ আর ডাক্তার গড়ছে সুচিন্তাহীন নতুন জীবন। প্রতিনিয়ত ভাবছে কেন পুলিশ বা প্রশাসন ক্যাডার হলাম না? কী করলাম লেখাপড়া করে? কী লাভ হলো সারাজীবন ভালো ছাত্র হয়ে ইত্যাদি। কে এর জন্য দায়ী? সমাজ, রাষ্ট্র, দরিদ্রতা, দুর্নীতি, মরাল ভ্যালুর অবক্ষয়, সিস্টেমের অভাব, নাকি সব কিছুর সমন্বয়?

নাগরিকের জন্মের শুরুতে কে ক্লাসে পড়াশোনায় ভালো আর কে খারাপ এটা বিচার না করে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ জায়গা থেকে ব্যক্তির নিজের চিন্তা চেতনার ওপর গুরুত্ব দিন। তাকে সম্মানের সঙ্গে গড়ে উঠতে সাহায্য করুন এবং পরস্পরের মধ্যে ভেদাভেদের পার্থক্যটি কমান। সমাজে প্রত্যেকটি কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইজ মাস্ট। ছোট বেলা থেকে কেউ যেন অবহেলিত হয়ে গড়ে না ওঠে সেদিকে নজর দিন। অবহেলিত নাগরিক নিজের অস্তিত্বকে মজবুত করতে অনৈতিক কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। 

কারণ ছোটবেলা থেকে লাঞ্ছিত আর বঞ্চিত জীবনে বিবেক কী তা তো তাদের জীবনের অভিধানে কখনও ছিল না। সমাজের বর্ণবৈষম্য, ধনী-দরিদ্রে ভেদাভেদ কমাতে চেষ্টা করি, যদি স্যাক্রিফাইস করতে শিখি বা ছাড় দেবার মনমানসিকতা তৈরি করি তবে সব কিছুই সম্ভব। একই সাথে মনে রাখতে হবে আমরা প্রতিটি সময় দৌড়ের পর আছি। যেমন ধরুন কেউ দৌড়ে অনেককে পিছিয়ে খেলা শেষ করতেই সামনে তার বাবাকে দেখছে। বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিচ্ছে, সন্তানটি বাবাকে বলছে, বাবা দৌড়ে ১৫তম হয়েছি! বাবা বলছে, না মা তুমি প্রথম হয়েছ ওই ৩০ জনের মধ্যে! তাকিয়ে দেখ তোমার পেছনে ২৯ জন!

মেয়ে বাবাকে উত্তরে বলছে, (খুশি হয়ে) কিন্তু বাবা সামনেও যে ১৪ জন রয়েছে তাকি দেখেছো? বাবা তখন বলছে মেয়েকে, তার কারণ ওরা আরও বেশি প্রাকটিস করেছে, পায়ের পেশি শক্তপোক্ত করতে যত্ন নিয়েছে। পরেরবার তুমি আরও ভাল করে চেষ্টা করো, নিশ্চয়ই আরও ভালো হবে। মেয়ে বাবার কথায় মুগ্ধ হয়ে বলছে, বাবা আমি খুব চেষ্টা করবো, অনেক প্রাকটিস করবো, আর পরের বার দেখবে প্রথম হবো।

বাবা তার মেয়ের জন্য দোয়া করছে, অল দ্য বেস্ট কিন্তু মনে রেখো বেটি, পরেরবারও এই দৌড়ে বা কোনো না কোনো দৌড়ে দেখবে কেউ না কেউ তোমার থেকে এগিয়ে থাকবে, আর কেউ না কেউ থাকবে তোমার থেকে পিছিয়ে। তারপরও এ নিয়ে কখনো মন খারাপ করবে না। বরং সামনে যারা থাকবে, তাদের সাফল্যে আনন্দ করবে। কারণ মনে রাখবে তাদের মধ্যে সত্যিই এমন কিছু আছে যা তোমার চেয়ে আলাদা। মন থেকে প্রশংসা করবে। আর যারা পিছিয়ে থাকবে, তাদের উৎসাহ দিবে। তাহলে জীবনের বড় দৌড়ে সবসময় এগিয়ে থাকতে পারবে।

নিজেকে কখনো অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করো না, কারণ প্রত্যেকের পরিবেশ, পরিস্থিতি, সুযোগ, দুর্যোগ, প্রতিভা সব আলাদা আলাদা হয়। কোনো না কোনো জায়গায় কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেকে সেরা হয় নিজ নিজ জায়গায়। 

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]


সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App