Print

Bhorer Kagoj

স্বচ্ছ মানুষ কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী

প্রকাশিত হয়েছে: মে ২৮, ২০২১ , ১২:১৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: মে ২৮, ২০২১, ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ

অনলাইন ডেস্ক

আমীরুল ইসলাম

শহীদ মিনার চত্বরে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। ষাটের অন্যতম কবি রফিক আজাদ শায়িত। বিষণ্ন পরিবেশ। বসন্তের বাতাস বয়ে যাচ্ছে শহীদ মিনারে। উজ্জ্বল কালো রঙের কৃষ্ণচূড়া জ্বলছে। রফিক আজাদ আমাদের গুরু। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কবি রবিউল হুসাইন, কবি তারিক সুজাত সবাই ব্যস্ত। বিষণ্ন বদলে দাঁড়িয়ে আছেন রফিকুল নবী। আমরা চ্যানেল আইতে লাইভ প্রচার করছি। ধারা বর্ণনা ও সাক্ষাৎকার।

একটু পেছনে দাঁড়িয়ে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। চলমার ফাঁকে টের পেলাম তার চোখ অশ্রুসিক্ত।

আমি গিয়ে বললাম, গুরুÑ ‘গুরু’ সম্পর্কে কিছু বলবেন। ক্যামেরার সামনে আসবেন একটু।

সিরাজী তাই হাত ইশারায় থামতে বললেন।

প্লিজ আমীরুল। আজ মাফ করবেন। আজ কিছুই বলতে পারব না। গুরু রফিক আজাদ হাতে ধরে আমাকে কবিতা লেখা শিখিয়েছেন।

আপনার কবিতা তো খুব ভিন্নধর্মী।

সেটাও গুরুই আমাকে পথ দেখিয়ে ছিলেন। তার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। কেন এভাবে ফাঁকি দিয়ে গুরু চলে গেল?

ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন ষাটের আরেক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। কবি হৃদয় তার। শিশুর মতো কাঁদছেন। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় তিনি কাতর।

আমি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার মাতাল পাঠক। সেই বিশদ আলোচনা অন্যত্র করা যাবে।

তবে দুচারটে স্মৃতিকথা উল্লেখ করি। একবার কলকাতা গেছি আমরা দলেবলে। জাতীয় কবিতা পরিষদের তিনি সভাপতি। তিনিও গেছেন। একদিন বিকেলে আমরা ডায়মন্ড হারবারে গেলাম। সাকিলদের ওখানে। কবি আসলাম সানীর পাগলামি। আমাকে পুরস্কার দেয়া হবে। সিরাজী ভাইকে সভাপতি বানানো হলো। এরপর আমীরুল বন্দনা শুরু হলো। আমি লজ্জায় কুণ্ঠিত। আমি জানি, সিরাজী ভাই অসম্ভব মেধাবী ও জ্ঞানী মানুষ। তার কাছে ছোট হয়ে গেলাম। খুব মানসিক পীড়ায় আছি। কিন্তু সিরাজী ভাই সংক্ষিপ্ত অথচ অসাধারণ বক্তৃতা দিলেন। শাহাদাৎ হোসেন নিপু কিছু ছড়া আবৃত্তি করেছিল আগেই। সিরাজী ভাই অনবদ্য বিশ্লেষণ আমার লেখালেখির চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলেন।

শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে গেল। সেই কলকাতা ভ্রমণে একদিন পার্ক স্ট্র্রিটে অলিপাপে বসলাম দলে বলে। তরুণতম লেখকরাও যাবে সেদিন সিরাজী ভাইয়ের চারপাশে ঘিরে বসেছিল। দীপ মুখোপাধ্যায় একাই একশ। বারে আমাদের নরক গুলজার চলছে। সিরাজী ভাইকে সেদিন অন্য মাত্রায় অনুভব করলাম। উদার হৃদয়ের ব্যক্তি তিনি। সব বয়সির সঙ্গে সমানভাবে মিশতে পারেন।

কিছুদিন আগে নিউইয়র্ক বইমেলায় প্রধান অতিথি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এলমহার্স্ট হোটেলে পাশাপাশি রুমে উঠেছি। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। খুব সকালে তিনি ওঠেন। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ। কানাডায় তার মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ। তারপর ফ্রেশ হয়ে তৈরি। একটা হাফ সামার জ্যাকেট পরনে। সেটার গোপনে পকেটে পাসপোর্ট। টেলিফোন খুব যত্নে রাখেন। মানিব্যাগ জিপারঅলা পকেটে। নিজে হারিয়ে যাবেন। তবে এসব হারাবে না। পেশায় প্রকৌশলী। প্রকৌশলীদের সঙ্গে নন্দনতত্ত্বের সম্পর্ক আছে। আর নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে কাব্যের।

খুবই প্রতিভাবান ব্যক্তি। কখনো প্রচলিত ধারায় কবিতা লেখেননি। অনুপ্রাস, ছন্দ, সমাজ বাদ শব্দ, বিষয় সব নিয়ে বাংলা ভাষায় তার কণ্ঠস্বর একেবারেই স্বতন্ত্র।

যাহোকÑ নিউইয়র্কে বইমেলার চারটা দুর্দান্ত আনন্দে কাটল। জ্যাকসন হাইটে ‘ইত্যাদি’ রেস্টুরেন্টের সামনের চত্বরে নরম রোদে পিঠ ঠেকিয়ে আমাদের আড্ডা। আহমাদ আযহার, কবি দিলারা হাফিজ, প্রকৃতিবিদ মোকাররম হোসেন চেয়ার সাজিয়ে সিরাজী ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা। গুরু তখন সদ্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। খুবই সম্মানীয় পদ। আমরা তা মাথায় রেখেই অনেক সহজ আড্ডা দিচ্ছি। মূল অনুষ্ঠানের এক সকালে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে স্মৃতি গল্প আড্ডা হলো ফর্মালের মধ্যে ইনফরম্যাল। সিরাজী ভাই খুব সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তি। সব তার চোখে ধরা পড়ে। কথা কম বলেন। কিন্তু সারবাম্ভ ছাড়া খামাখা কথা বলেন না। খুব সুন্দর বক্তৃতা দেন। সভাপতির ভাষণে তিনি অসাধারণভাবে পুরো বিষয়টার সংক্ষিপ্তকরণ করতে পারেন।

অসম্ভব কর্মী পুরুষ। আশ্চর্য দক্ষতায় তিনি ২০২০ সালের ব্যাপক বইমেলার আয়োজন করলেন। এবং সুষ্ঠুভাবে তা সমাপ্ত হলো। সিরাজী ভাই অসম্ভব সাংগঠনিক দক্ষ এক ব্যক্তি বেক্সিমকোতে থাকাকালীন প্রশাসনিক দক্ষতা ছাড়াও সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি অনবদ্য। কাছ থেকে দেখেছি, দীর্ঘদিন তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদের হাল ধরেছেন। কবি তারিক সুজাতের সঙ্গে মিলে অসম্ভব দক্ষতায় প্রতি বছর দুদিনব্যাপী কবিতা উৎসব সফল করেছেন। বাজেট আসবে, আপ্যায়ন-থাকা, অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করা সবই করতেন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে। কখনো তাকে উত্তেজিত হতে দেখিনি। যেহেতু তিনি প্রকৌশলী তাই সহজাত কবিদের মতো তিনি উদাসীন নন। তিনি আংশিকভাবে সব কাজ গুছিয়ে করে থাকেন।

দায়িত্ব পাবার পর বাংলা একাডেমিতেও তিনি গতির সঞ্চার করেছেন।

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে আমাদের বাসাতেও আড্ডা দিয়েছি। আমরা সামান্য পানাহারে মত্ত উন্মাদ। কিন্তু সিরাজী ভাইয়ের আশ্চর্য রকম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পান করলেন। কিন্তু তিনিই সবচেয়ে বেশি সুস্থ ও স্বাভাবিক রইলেন। এমন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার কবি আর কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আড্ডার মধ্যে সিরাজী ভাইকে কত বিব্রতকর প্রশ্ন করেছি। সিরাজী ভাই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সব উত্তর দিয়ে যান। তিনি কখনো প্রশ্নকর্তাকে ছোট করেন না। কবিতার নন্দনতত্ত্ব তিনি উচ্চস্তরে বোঝেন। কবিতার কলকব্জা সম্পর্কে তার মতো ধারণা কারো নেই।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার পরে আমরা মহাখুশি। খুবই আনন্দিত। বললাম, গুরু এই উপলক্ষে একটা পার্টি হবে বাসায়। ডেট দ্যান গুরু। কবে বসব আমরা? বিস্মিত হাস্যে সিরাজী ভাই বললেন,

মনে কিছু করবেন না আমীরুল। এখন কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলে গল্পের ডালপালা ছড়িয়ে পড়বে। মদ্যপান থেকে এখন বিরত থাকব।

তার এই সূক্ষ্মদর্শী চিন্তার কথা শুনে খুবই ভালো লাগল। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থাকাকালীন তার সঙ্গে আড্ডা হবে না। অফিসে কিয়ৎক্ষণের জন্য হতে পারে।

খুবই স্বচ্ছ মানুষ কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তার কবিতাও খুব স্বচ্ছ। তার জীবনের প্রতিফলন তার কবিতায় পাওয়া যায়।

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

© ভোরের কাগজ 2002 – 2020

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী । মুদ্রাকর: তারিক সুজাত

কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, তৃতীয় তলা, ৭০ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, (নিউ সার্কুলার রোড, মালিবাগ), ঢাকা-১২১৭ ।
ফফোন: ৯৩৬০২৮৫, ৮৩৩১০৭৪ ফ্যাক্স: ৯৩৬২৭৩৪, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন : ৮৩৩১৮০৬ । ইমেইল: [email protected]