করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে দেশজুড়ে। কোথাও ত্রাণের গাড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। কেউ বারবার ত্রাণ পাচ্ছে, আবার কারো ভাগ্যে জুটছে না একবারও। ত্রাণ নিয়ে মারামারি ও চুরির ঘটনাও ঘটছে বিভিন্ন স্থানে। ত্রাণ বিতরণে সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয় না থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যা দুর্যোগ মোকাবিলাকে আরো জটিল করে দিচ্ছে।
দেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণা করে বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। যে কারণে কার্যত লকডাউনে চলে যায় দেশ। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে বিপাকে পড়ে। এ অবস্থায় সরকারি-বেসকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়। গতকাল শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং ৮ হাজার ৪৫০ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। এর আগে দুই দফায় ১১ কোটি ২৪ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা এবং ৩৯ হাজার ৬৬৭ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, ত্রাণ বিতরণ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা প্রশাসনকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ ত্রাণ বিতরণ করা হবে। এ জন্য অগ্রাধিকার তালিকা করতে বলা হয়েছে কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের। স্থানীয় পর্যায়ের বিত্তশালী ব্যক্তি বা এনজিও ত্রাণ সহায়তা দিতে চাইলে জেলা প্রশাসকের তালিকার সঙ্গে সমন্বয় করতে বলা হয়েছে, যেন দ্বৈততা এড়ানো যায় এবং সমবণ্টন হয়। নিরাপদ দূরত্ব রেখে, প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ বিরতণের কথা বলা হয় নির্দেশনায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেসব মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর রামপুরায় ‘ত্রাণ বিতরণ সমন্বয় কমিটির’ নামে কিছু ব্যক্তিকে অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। পুষ্পশ্রী আবাসিক এলাকার বাড়িওয়ালা আবুল হাশেম জানান, এলাকার গরিব মানুষদের মধ্যে তারা এই ত্রাণ বিতরণ করবেন। কামরাঙ্গীর চরের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে কয়েক যুবককে। তবে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি বলে স্বীকার করেন অর্থ সংগ্রহকারীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানের চিত্রও একই রকম।
সিটি করপোরেশন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিও এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও দেখা গেছে নিজেদের ইচ্ছেমতো ত্রাণ বিতরণ করতে। আবার অনেক স্থানে জনপ্রতিনিধিদের দেখাও মিলছে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাছে ৫০০ জন নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা চাওয়া হয়। তবে এ নিয়ে অনেকের মনে ক্ষোভ রয়েছে।
ডিএসসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন জানান, তার ওয়ার্ডে নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক বেশি। তবুও তিনি তালিকা করে জমা দিয়েছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছু পাওয়া যায়নি। ডিএসসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিসুর রহমান জানান, তিনিও তালিকা জমা দিয়েছেন, কিন্তু এখনো কোনো বরাদ্দ পাননি। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছেন বলে জানান। ডিএনসিসির ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আব্দুল মান্নান বলেন, তার ওয়ার্ডের কল্যাণপুর বস্তিতেই আছে দুই হাজার ৬০০ পরিবার। ৫০০ জনকে দেয়ার জন্য দুই লাখ ৭১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কীভাবে এই টাকা বিতরণ করব সেটা ভাবছি। তিনি জানান, কল্যাণপুর সমাজকল্যাণ সমিতি ১৭৫টি পরিবারের মধ্যে ত্রাণ দিয়েছে। আবার স্থানীয় এমপি আসলামুল হক আসলামও কিছু ত্রাণ দিয়েছেন। এতে সমন্বয়হীনতা হচ্ছে। কেউ দুই-তিনবার পাচ্ছে। কেউ মোটেই পাচ্ছে না।
ত্রাণ বিরতণের শুধু সমন্বয়হীনতাই নয়, বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে অনেক। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় না করেই গত মঙ্গলবার ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নেন। খবর পেয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হলে বিতরণ স্থগিত করা হয়। পরে গভীর রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে তা বিতরণ করা হয়। জনসমাগম না করার নির্দেশনা উপেক্ষা করে ত্রাণ বিতরণ করার অভিযোগ ওঠে কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমলের বিরুদ্ধে।গত রবিবার লালবাগের সংসদ সদস্য হাজি সেলিমকেও দেখা গেছে ইসলামবাগ এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করতে। এ সময় তার চারপাশে ঠাসাঠাসি করে ছিলেন নেতাকর্মীরা। ত্রাণ নিতে আসা মানুষের মধ্যেও ছিলনা কোনো দূরত্ব।
অন্যদিকে ত্রাণ বিরতণে অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে গত বুধবার আউশকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুন তিন সাংবাদিককে মারধর করেন। গত মঙ্গলবার ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় সাংবাদিক নির্যাতন করে পরদিন গ্রেপ্তার হন বড় মানিকা ইউপি চেয়ারম্যান জসিম হায়দারের ছেলে নাবিল হায়দার। আর নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা আয়েত আলীর গুদাম থেকে ভিজিডির ১৩৮ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয় গত বৃহস্পতিবার। সরকারি কর্মকর্তা না থাকায় নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এসব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম শাহীন খান বলেন, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় থাকা যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলারই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সেটা প্রায়ই দেখা যায় না। যে যার মতো ত্রাণ দিচ্ছেন। এতে অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, এ জন্য সবার আগে দরকার একটা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা। সেখানে সঠিক তালিকা থাকবে এবং সে তালিকা ধরে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদহারণ এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। ড. শাহীন আরো বলেন, ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করেও আমরা সমাধান পেতে পারি। ত্রাণ বিতরণ সঠিকভাবে না হলে অভাবী মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। এতে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ত্রাণ বিতরণ নিয়ে কিছুটা অব্যস্থাপনা হচ্ছে এটা সত্যি। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহায্য করতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন না। যে কারণে কমিউনিটি সংক্রমণের শংকা বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, জেলা প্রশাসকদের তত্ত¡াবধানে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত যে তালিকা হচ্ছে, সে তালিকা ধরে বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সংগঠনসহ বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তার ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করতে বলা হয়েছে।
© ভোরের কাগজ 2002 – 2020
প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী । মুদ্রাকর: তারিক সুজাত
কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, তৃতীয় তলা, ৭০ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, (নিউ সার্কুলার রোড, মালিবাগ), ঢাকা-১২১৭ ।
ফফোন: ৯৩৬০২৮৫, ৮৩৩১০৭৪ ফ্যাক্স: ৯৩৬২৭৩৪, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন : ৮৩৩১৮০৬ । ইমেইল: [email protected]