ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভুয়া চিঠি দেখিয়ে বরিশালের উজিরপুরের চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চে পরিচালনা পর্ষদ নামে একটি কমিটি গঠন করেছেন জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান। এই কমিটির কয়েকজন চার্চে ঢুকে যাজককে পিটিয়েছে, ঢাকায় চার্চের ভবন দখল করেছে। অথচ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠি ঠিক না বেঠিক যাচাই না করেই জেলা প্রশাসক মনগড়া সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের পক্ষপাতিত্বের কারণে প্রতিষ্ঠাতার মতাদর্শে চলতে পারছে না চার্চ। হুমকির মুখে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপাসনালয়টির নিরাপত্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলা প্রশাসক ও তার গঠন করা কমিটির নানা কর্মকাণ্ডে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একাংশ ওই চার্চে এখন যেতে পারেন না। চার্চের বিধান অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন যাজক। এটি পরিচালনায় কোনো কমিটি থাকতে পারবে না। তবু জেলা প্রশাসক নিজের খেয়ালখুশিমতো একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। ফলে দুপক্ষ মুখোমুখি হয়েছে। এর জেরে কয়েকদফা হাতাহাতি হয়েছে। মার খেয়ে এক যাজক চার্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। অথচ জেলা প্রশাসক যেখানে ‘ন্যায়পাল’ হয়ে সমস্যা সমাধান করার কথা, তা না করে তিনি নিজেই সেখানে একটি পক্ষে নেমে গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশালের উজিরপুরের চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চের প্রতিষ্ঠাতার মহাপ্রয়াণের পর পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিরোধ শুরু হয়।
প্রতিষ্ঠাতার পরিবারের সদস্য চাইছেন তার মতো করে চার্চ পরিচালনা করতে। যাজকসহ অন্যরা বলছেন, প্রতিষ্ঠাতা ও চার্চের বিধানমতো চার্চ চালানো হবে। মূলত এখান থেকেই বিরোধ শুরু। বিরোধটি মীমাংসার জন্য স্থানীয় প্রশাসনে আসে। কিন্তু সমাধান না হলে বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ায়। উচ্চ আদালতের ইংরেজি ভাষার আদেশ বাংলায় অনুবাদের সময় কিছু অংশ পাল্টে দেয়া হয়। এরপর সেই আদেশের পাল্টানো অংশের কপি বরিশাল জেলা প্রশাসক ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়।
এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি বরিশাল জেলা প্রশাসক বরারর পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে চার্চ পরিচালনায় ৫ জনের নাম উল্লেখ করে কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়। কিন্তু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিধানমতে ওই চার্চ পরিচালনার জন্য কোনো কমিটি থাকতে পারবে না। এটি পরিচালনা করবেন যাজকরা। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানালেও তিনি আমলে নেননি। কমিটি গঠন সংক্রান্ত ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর দেখে স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সন্দেহ জাগে। এরপর তারা তথ্য অধিকার আইনে ওই চিঠি সত্য কি না ধর্ম মন্ত্রণালয়ে জানতে চান। গত ২০ ফেব্রুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয় জানায়, চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চ নিয়ে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করতে কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে কমিটি গঠন করতে জেলা প্রশাসককেও নির্দেশ দেয়া হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চে থমথমে অবস্থা চলছে।
জানতে চাইলে বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, পুরো ঘটনা লিখে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। তারা যেভাবে নির্দেশনা দেবে সেভাবেই কাজ হবে। তিনি যে কমিটি গঠন করে দিয়েছেন সেটিও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই বলে জানান। কিন্তু তথ্য অধিকার আইনে সেই চিঠি ভুয়া ধরা পড়েছে- এমন তথ্য জানালে, জেলা প্রশাসক বলেন, চিঠি আছে। তবে স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিরোধের কারণে চার্চের পবিত্রতা রক্ষা করা যাচ্ছে না। চার্চ পরিচালনায় আপনি পক্ষপাতিত্ব করছেন- একটি পক্ষের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ২০১৬ সাল থেকে ওই চার্চে ঝামেলা চলে আসছে; আর আমি বরিশালে জেলা প্রশাসক হয়ে এসেছি একবছর আগে। আমি কিভাবে পক্ষপাতিত্ব করব?
ওই চার্চের একজন ভক্ত জন চন্দন কুমার। যিনি ঢাকায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ৭২ বছরের পুরনো এই চার্চ যে বিশ্বাসে চলে এসেছে এখন সেই বিশ্বাসে চলছে না। তিনি বলেন, যে বিশ্বাসে চার্চে যাচ্ছি সেই বিশ্বাসের যাত্রাপথে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সেটি দেখা উচিত। যাজকরা যেন নির্বিঘে্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করতে পারে সেই নিরাপত্তা দেয়া উচিত।
শিরিল সরকার নামে আরেকজন জানান, ৭২ বছর ধরে যে ঐতিহ্য নিয়ে চার্চটি চলে এসেছে সেখানে এখন অন্যপথে চলছে। জন্ম থেকেই চার্চ পরিচালনায় কোনো কমিটি ছিল না। কিন্তু জেলা প্রশাসক ভুয়া চিঠির সূত্র ধরে কমিটি গঠন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। যাজকরা যেভাবে চার্চ চালিয়ে এসেছেন সেটি যেন অব্যাহত থাকে- আর্জি শিরিল সরকারের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের উজিরপুরের চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চের (গির্জাবাড়ি) জমি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি চক্র। এ কারণে চার্চের সদস্যদের ওপর তারা হামলাও করছে। এখানকার যাজকদের তাড়িয়ে গির্জাবাড়ি দখল নিতে তারা বেছে নিয়েছে নির্যাতনের পথ। প্রতিনিয়ত হামলা ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে চক্রটি। এমনকি চার্চের সীমানার তারকাটা বেড়াও কেটে ফেলেছে তারা। নিরাপত্তার উদ্বেগ জানিয়ে চার্চের যাজক উজিরপুর থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি করেও কোনো সুফল পাননি। তবে ওই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মেরই কিছু ‘পথভ্রষ্ট’ মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে অসিম সমদ্দার কুন্ডু, লিটন সমদ্দার, সৈকত সমদ্দার, মিল্টন সমদ্দার, তিমন সমদ্দার, দ্বিজেন সমদ্দারসহ আরো কয়েকজন। তারা চার্চের নিয়ম-কানুন মানেন না। কেউ কেউ অন্য চার্চভুক্ত।
জানা গেছে, হৃদয় রঞ্জন সমদ্দার ১৯৭৪ সালে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের বৈরকাঠি গ্রামে এ অঞ্চলের ধর্ম প্রচারকদের জন্য ‘অল-ওয়ান-ইন-ক্রাইস্টচার্চ ফেলোশিপ’ চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে এই অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে চার্চটির নিবাসীরা কাজ করে আসছেন। ধর্ম প্রচারকরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে এখানে রাতযাপন ও আহার গ্রহণ করেন। যার অর্থের সংস্থান হয় মানুষের দানের টাকায়।
১৯৭৩ সালে চার্চ প্রতিষ্ঠার সময় এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠাতা নিজে ও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চার্চের জন্য ২ একর ৯৭ শতাংশ জমি কিনে প্রতিষ্ঠা করেন এই চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চ। চার্চটির বিশেষত্ব হচ্ছে- এখানে শুধু সেই থাকতে পারবে, যে ধর্ম প্রচারক, বিয়ে-সংসার থেকে দূরে থেকে ‘একমাত্র যিশুর প্রেমে সহভাগিতামণ্ডলী সম্পূর্ণ পৈরিতিক ও ভাববাদিক শিক্ষার ভিত্তিমূলে’ চলবে। এই বিশ্বাস ও শিক্ষা থেকে বেরিয়ে ভ্রান্তপথে চলে যাওয়া একটি চক্র পবিত্র এই চার্চকে অপবিত্র করার চেষ্টা চালাচ্ছে। চার্চটি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এখানকার বাসিন্দা ও ধর্ম প্রচারকরা। আর জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বাইরের লোক এসে থাকাকেই চার্চটির বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন।
© ভোরের কাগজ 2002 – 2020
প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী । মুদ্রাকর: তারিক সুজাত
কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, তৃতীয় তলা, ৭০ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, (নিউ সার্কুলার রোড, মালিবাগ), ঢাকা-১২১৭ ।
ফফোন: ৯৩৬০২৮৫, ৮৩৩১০৭৪ ফ্যাক্স: ৯৩৬২৭৩৪, সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন : ৮৩৩১৮০৬ । ইমেইল: [email protected]