১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্ট দেশভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করার অল্পদিনের মধ্যেই ত্রিপুরা রাজ্য কোন রাষ্ট্রাধীনে যোগ দেবে এ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। রাজপরিবারও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানে যুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন মহারাজকুমার দুর্জয়কিশোর দেববর্মন, তিনি ত্রিপুরার রাজপরিবারের সদস্য এবং রিজেন্সি কাউন্সিলের মন্ত্রী ছিলেন। রিজেন্সি কাউন্সিলের অপর মন্ত্রী বাঙালি সত্যব্রত মুখার্জী, ত্রিপুরার আঞ্জুমান-এ-ইসলামিয়ার নেতা আবদুল বারিকসহ রাজপরিবারের অনেক সদস্যই পাকিস্তানে যুক্ত হতে নানা তৎপরতা চালিয়েছিল। কিন্তু রাজপরিবারের একাংশ, ত্রিপুরার উপজাতি ও হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তানভুক্তির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে ভারতভুক্তিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১২ জানুয়ারি কাউন্সিল অব রিজেন্স রহিত করে সদ্য স্বাধীন ভারত সরকার মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবীকে একক রিজেন্ট বা রাজ্যপরিচালনার দায়িত্ব দেয়। মহারানির সহযোগী হিসেবে অবণীভূষণ চট্টোপাধ্যায়, বিজয়কৃষ্ণ আচার্য এবং রণজিৎকুমার রায়কে ভারত সরকার কর্তৃক দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়। ওদিকে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর ত্রিপুরাজুড়ে রটেছিল পূর্ব বাংলার সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুসলিম গার্ড কর্তৃক ত্রিপুরা আক্রমণ করে দখল অভিযান পরিচালনার জন্য এগিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার সীমান্ত অংশে মুসলিম লীগ নেতা তফাজ্জল আলীর জোর প্রস্তুতির কথাও প্রচারিত হয়েছিল। ত্রিপুরা রাজ্য ভারতভুক্তি নিশ্চিত হওয়ার পরও ওই আতঙ্ক ত্রিপুরাজুড়ে বিরাজ করছিল। এ সংবাদে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে ৪ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র ও উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে ত্রিপুরা সম্পর্কে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। ইতোপূর্বে আসাম সরকারকে এ সম্পর্কে অবহিত করেন এবং পাকিস্তান সরকারকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে সতর্ক করেন। ত্রিপুরা রাজ্য যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায় সেজন্য ভারত সরকার আসাম থেকে অস্ত্রশস্ত্রসহ বিশাল সেনাবাহিনী ত্রিপুরায় প্রেরণ করে। তার কারণটি হচ্ছে ত্রিপুরা রাজ্যটির তিনদিকে বেষ্টিত পূর্ব বাংলা। মাত্র একদিকের সড়ক পথে আসামের মধ্য দিয়ে ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্তি। মিজোরামের ক্ষেত্রেও সেরূপ। মাত্র একদিকের আসাম রাজ্যের স্থলপথ দিয়ে ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে ত্রিপুরা রাজ্যের যুক্ততা থাকায় ত্রিপুরা পূর্ব বাংলার পেটের ভেতর ঢুকে রয়েছে।
ত্রিপুরা রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পূর্ব বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়া অসঙ্গত ছিল না। সেজন্য ত্রিপুরাজুড়ে গুজব রটেছিল পূর্ব বাংলার বিস্তৃত সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে পাকিস্তানি মুসলিম গার্ডেরা ত্রিপুরা দখলের প্রস্তুতি নিয়েছে। বাস্তবে তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আরাকান রাজ্যের রাজাও পূর্ব বাংলার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিল কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। পূর্ব বাংলাকে শক্তিধর প্রদেশ হিসেবে গড়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের। মালদহ ও মুর্শিদাবাদ মুসলিম সংখ্যাধিক্য হওয়ার পরও পূর্ব বাংলায় যুক্ত হতে পারেনি। সামান্য হিন্দু সংখ্যাধিক্যে খুলনা জেলা পূর্ব বাংলায় অন্তর্ভুক্তির অজুহাতে মালদহ, মুর্শিদাবাদ ভারতের নিকট ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, খুলনা জেলার বিনিময়ে।
ভারত সরকার ত্রিপুরা রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং রটানো গুজবকে আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরেু ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে একটি জরুরি তারবার্তায় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ত্রিপুরা রাজ্য দখলে নেয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ত্রিপুরা রিজেন্টের চিফ মিনিস্টার সত্যব্রত মুখার্জীকে এবং রাজপরিবারের সদস্য দুর্জয়কিশোর দেববর্মনসহ পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে যারা অভিমত জানিয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর শাস্তিস্বরূপ তাদের পদ থেকে বহিষ্কার এবং দুর্জয়কিশোর দেববর্মনকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হয়। মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মাণিজ্যর অকাল প্রয়াণের পর নাবালক পুত্র কিরীট বিক্রমকিশোর দেববর্মণ ত্রিপুরা রাজ্য এবং চাকলা রোশনাবাদের জমিদারি প্রাপ্ত হন। রাজা নাবালক থাকায় ব্রিটিশ সরকারের পরামর্শক্রমে রাজমাতা মহারানি কাঞ্চন প্রভাব দেবীর নেতৃত্বে রাজপ্রতিনিধি পরিষদ বা রিজেন্সি কাউন্সিল গঠন করা হয়। ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে নাবালক পুত্র কিরীট বিক্রমকিশোর দেববর্মনের পক্ষে মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী ত্রিপুরার ভারতভুক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুসারে ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরা রাজ্য ভারতের অপরাপর রাজ্যের ন্যায় ভারতভুক্ত হয়ে যায়। ১৯৫০ সালে ত্রিপুরা রাজ্যকে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে ‘গ’ শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করা হয়। ত্রিপুরার ভারতভুক্তির চুক্তিতে কুমিল্লা, নোয়াখালী, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কসবা, চাঁদপুরসহ সমতলের ওই সব অঞ্চলের অনেকাংশ চাকলা রোশনাবাদের জমিদারির অঞ্চলের উল্লেখ না থাকায় চাকলা রোশনাবাদের জমিদারি অঞ্চল পূর্ব বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ঞৎরঢ়ঁৎধ রহ ঞৎধহংরঃরড়হ গ্রন্থের লেখক ত্রিপুরচন্দ্র সেন এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, চাকলা রোশনাবাদের জমিদারি সম্পর্কে ত্রিপুরার ভারতভুক্তি চুক্তিতে মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবীর নীরবতা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেয় না। যদি চাকলা রোশনাবাদের জমিদারি অঞ্চল ত্রিপুরা রাজ্যে যুক্ত থাকত তাহলে উদ্বাস্তু সমস্যা এতটা প্রকট হতো না। ত্রিপুরার ভারতভুক্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে দীর্ঘকালের মাণিক্য-রাজাদের শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। ত্রিপুরা ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। মাণিক্য-রাজাদের শাসনাধীনে ত্রিপুরা শুরুতে রাজাদের পূর্ণ স্বাধীনতায় রাজ্য শাসন সম্ভব হলেও পরবর্তী সময়ে মোগল, বাংলার নবাব, আরাকান রাজা এবং পরে ইংরেজ আগ্রাসনে বারবার পর্যুদস্ত হয়েছিল। রাজ্যের অস্তিত্ব এবং রাজারা নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে মোগল দরবারে হস্তিকর দিতে বাধ্য ছিল। ভারতের মধ্যে ত্রিপুরার হাতির কদর ছিল সর্বাধিক। ভারতের অন্য কোনো অঞ্চলের হাতি শক্তি, সামর্থ্য,ে সৌন্দর্যে ত্রিপুরার হাতির ন্যায় ছিল না। তাই ত্রিপুরার হাতির আকর্ষণে মোগলরা বারবার ত্রিপুরা হানা দিত। বাংলার নবাবের দরবার মুর্শিদাবাদে এবং ঢাকার মোগল সুবাদারদের নিকট ত্রিপুরা রাজার নিকটাত্মীয়কে প্রতিভূ (ঐড়ংঃধমব) জিম্মায় রাখা হতো। রক্ষিত প্রতিভূদের ‘তুল’ বলা হতো। রাজারা মোগলদের বশ্যতা স্বীকারে হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর পাশাপাশি হাতি-কর হিসেবে মোগলদের প্রদান করত। মোগলদের প্রতি অধিক আনুগত্য প্রকাশের পরও রাজা অদল-বদলের ঘটনাও ঘটেছিল, মোগলদের দ্বারা। ত্রিপুরার রাজারা স্বাধীনভাবে রাজত্ব কায়েম করতে পারেনি বহিঃশক্তির কারণে। নিজেদের শাসন ক্ষমতা রক্ষায় বারবার নতজানু নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। প্রজাদের ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন-অত্যাচার চলেছে। মাণিক্য-রাজাদের শাসনামলে কুকি, রিয়াং, জমাতিয়া প্রভৃতি উপজাতির বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সব বিদ্রোহের মূলেই ছিল রাজাদের নিপীড়ন, বৈষম্য, মহাজনী ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি যৌক্তিক কারণ।
রাজ সিংহাসনের অধিকার নিয়ে দ্ব›দ্ব, সংঘাত, হত্যার ঘটনা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে অতি স্বাভাবিক বিষয় ছিল। কেবল ত্রিপুরা নয়, ভারতবর্ষে সুলতানী, মোগল, নবাব, রাজা-মহারাজাদের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল তেমনি বিশ্বের প্রতিটি রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব অসংখ্য নৃশংস ঘটনা ইতিহাসখ্যাত। এক্ষেত্রে অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতানেরা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে নিজ ও বৈমাত্রেয় ভাইদের সবাইকে একযোগে হত্যা করত এবং ধর্মীয় নেতারা তাতে স্বীকৃতিও দিয়েছিল। সুলতানের যদি আকস্মিক মৃত্যু হয় সেক্ষেত্রে বংশধর একজন ভাইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ধর্মীয় নেতারা পরামর্শ দেয়ার ফলে উত্তরাধিকারী এক ভাইকে বাঁচিয়ে রাখলেও সুলতানের জীবদ্দশায় তাকে অন্ধ-কারাগারে বন্দি করে রাখা হতো। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ত্রিপুরা স্থানীয় শাসকদের শাসনাধীন রাজ্য ছিল বটে, তবে ব্রিটিশদের খবরদারি মুক্ত ছিল না। রাজারাও পূর্ণ স্বাধীনতা প্রাপ্ত ছিলেন না। রাজাদের স্বাধীনতা ছিল সীমাবদ্ধ। ব্রিটিশদের স্বার্থহানির আশঙ্কায় পলিটিক্যাল এজেন্ট নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে সতর্ক দৃষ্টি রাখত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম দেশীয় রাজাদের শাসনাধীন দেশীয় রাজ্য ও অঞ্চলে সেজন্য বিস্তার লাভ করতে পারেনি। জনসংখ্যায় ত্রিপুরার উপজাতিদের পরেই ছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের স্থান। ১৯৪৭-এর দেশভাগে মুসলিম সম্প্রদায় ত্রিপুরা ত্যাগ করে পূর্ব বাংলায় চলে আসে। অনুরূপভাবে পূর্ব বাংলার কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া, কসবা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, মিরসরাই অঞ্চলের অগণিত হিন্দু সম্প্রদায় নিকটবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যায়। বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ হচ্ছে বাঙালি আর ৩০ শতাংশ তিপ্রা, রিয়াং, কুকি, জমাতিয়াসহ বিভিন্ন জাতিসত্তা এবং মাত্র ৮ শতাংশ বাঙালি মুসলমান অথচ দেশভাগের পূর্বে বাঙালি মুসলিম ছিল দ্বিতীয় এবং বাঙালি হিন্দু ছিল তৃতীয় অবস্থানে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আদি উপজাতিরা সেখানে এখন মোট জনসংখ্যার মাত্র ত্রিশ শতাংশ।
মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]