আজিজুর রহমান জিদনী : চলছে পবিত্র রমজান মাস। সামনেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। পুরনো ইস্যু হলেও এ সময়টাকে ঘিরে নানা ভেজাল পণ্য তৈরি ও বিপণনের হিড়িক পড়ে যায়। এই প্রবণতা এ বছরও দেখা গেছে। রোজার শুরু থেকেই ভেজাল সেমাই বা ট্যাং তৈরির কারখানাসহ নানা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ভেজালমুক্ত খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারেনি এখনো। ফলে এখনো হুমকিতেই রয়েছে জনস্বাস্থ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতিসহ নানা অন্তরায় থাকায় ভেজাল পণ্য থেকে আমাদের মুক্তি মিলছে না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভোজলবিরোধী অভিযানে সক্রিয় ভূমিকা রাখা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযানে কাজ করে মনে হয়েছে এখানেও দুর্নীতি বড় একটি অন্তরায়। এর সঙ্গে রয়েছে নানা সমন্বয়হীনতা। তিনি বলেন, আমাদের এখানে টাকা দিলেই ছোট-বড় যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বা মানদণ্ডের সনদ মেলে। মনিটরিংয়ের দ্বায়িত্বে যারা রয়েছেন সেখানেও নানা উৎকোচের আদান-প্রদান চলে। যার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অসুবিধায় পড়তে হয় না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের এখানে কাজের প্রক্রিয়াগতও অনেক ত্রæটি রয়েছে। রেস্তেরা আইনে বলা আছে, যিনি কোনো খাবার হোটেল বা রেস্টুরেন্ট করবেন- তার এ বিষয়ে সার্টিফাইড কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ৬ মাসের একটি বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। সেখানে আমাদের দেশে কয়জন রেস্টুরেন্ট মালিকের এমন প্রশিক্ষণ রয়েছে। হাজার-হাজার রেস্তোরা; এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে আসলে কে? আবার একটি রেস্তোরায় যেসব কর্মী কাজ করবে- এমন অন্তত ৬ জন থাকবে যাদের সিভিল সার্জন দ্বারা স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ থাকবে- তারা নিরোগ রয়েছেন। যাতে তাদের দ্বারা সেখানে আসা ক্রেতাদের কোনো রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবে না।
আমরা বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর পুলিশকেও অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করতে দেখলাম। আইনগত প্রয়োগের ধারাবাহিকতা বা মনিটরিং এনফোর্সমেন্টের ঘাটতি উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে রোজায় চাহিদা বেড়ে যায় সেমাই বা ট্যাং জাতীয় পানীয়সহ কিছু পণ্যের। এগুলোই নকলসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয়। এ ধরনের কারখানাগুলো সাধারণত অলিতে-গলিতে হয়ে থাকে। যেখানে অভিযান চালানো একটু কষ্টকর হয়ে পড়ে। অভিযান চালিয়ে যে কারখানাগুলোকে জরিমানা করা হয় ওই কারখানাগুলোই ঘুরে-ফিরে এ কাজগুলো করে আবার। তাহলে এ কারখানাগুলো খুলে কী করে। সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট আরো কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছেন তারা কী করে। ভোক্তাদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা কিছুটা কম মূল্যের জন্য মানহীন পণ্য কিনছেন। আসলে আমাদের জনস্বাস্থ্যকে কখনো সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যার ফলে অনিয়মই নিয়মে দাড়িয়েছে। দূষিত খাবার খেয়ে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
গত ২৩ মার্চ শনিবার রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ভেজাল সেমাই তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে ভেজাল সেমাই উদ্ধারসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযুক্তরা হলেন কদমফুল সেমাই কারখানার মালিক সোনা মিয়া ও ম্যানেজার লোকমান, মিতালী সেমাই কারখানার মালিক মোহাম্মদ আলী ও ম্যানেজার আদর আলী ও নাসির ফুড কারখানার ম্যানেজার আব্দুর রহমান আকাশ। গত ১২ মার্চ অস্বাস্থ্যকর উপায়ে কাপড়ের রং আর চিনি মিশিয়ে নকল ট্যাং তৈরির সময় আবিদ ফুড অ্যান্ড কেমিক্যালস নামে একটি ফ্যাক্টরিতে অভিযান চালিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। অভিযানে অবৈধ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নকল ট্যাং, চানাচুর, ডিটারজেন্টসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের সময় হাতেনাতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আনোয়ার হোসেনকে আটক করা হয়। গত কয়েকদিনে এমন বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবুও ভেজাল সেমাইসহ অন্যান্য ভেজাল পণ্য তৈরির লাগম সেভাবে টেনে ধরা যায়নি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, ভেজাল সেমাই বা অন্যান্য পণ্য যেগুলো ভোক্তাস্বার্থ সংশ্লিষ্ট; সেগুলোর মান নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছি। তবে এ বিষয়টি আমাদের অনেক কাজের মধ্যে একটি অংশ। কিন্তু যাদের কাজ শুধু খাদ্য নিয়ে- সেই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কী করছে? সিটি করপোরেশনের স্যানিটারি বিভাগ কী করছে বা স্থানীয় থানা বা জেলা প্রশাসন কী করছে। তিনি বলেন, আমরা ভোক্তা অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। সেমাইসহ অন্য বিষয়ে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। এছাড়া রেঁস্তোরায় কীভাবে সমন্বয় করে অভিযান চালানো হবে- সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগামী রবিবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়ে একটি বৈঠকের কথা রয়েছে।
এদিকে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জ ও রাজধানীর কামরাঙ্গিচরে সেমাইসহ অন্যান্য ভেজাল পণ্যের কারখানা বেশি। তবে ওইসব এলাকায় অভিযান বেশি চালানোয় এখন দয়াগঞ্জ, ধোলাইপাড় ও যাত্রাবাড়ী এলাকাকে এসব তৈরির জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা। কারণ এসব এলাকা অনেক অলিগলি বেষ্টিত। যাতায়ত কষ্টসাধ্য হওয়ায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আনাগোনাও কম। আর ঝমেলা এড়াতে রাতের আঁধারকেই সেমাই তৈরির সময় হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। ওইসব এলাকায় সরজমিন গিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ধোলাইপাড় হাই-স্কুলের সামনে মহান ফুড প্লাজা, করাতীটোলা মসজিদের কাছে নিউ মদীনা ও এশিয়া বেকারিতে সেমাই তৈরি হচ্ছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের কথা বলতে গেলে তারা সেমাই তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন তারা শুধু বেকারিপণ্য তৈরি করে। এ বিষয়ে আল আমিন নামে দয়াগঞ্জের এক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, দয়াগঞ্জ-ধোলাইপাড় ও আশপাশের এলাকায় বেকারি পণ্যের ফাঁকে রাতের আধারে সেমাই বানানো হয়। দিনে যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য রাতকে বেছে নেয়া হয়। এছাড়া কামরাঙ্গির চড় এলাকায় গত বছর ভেজাল সেমাই তৈরির দায়ে আচার ওয়ালা ব্যান্ডের মালিক দীন ইসলামের সেমাই কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে এবারো তাকে সেমাই তৈরি করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, গত বছরের বিষয় গত বছর গেছে। এর বেশি কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
র্যাবের মুখপাত্র ও বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ প্রতিবেদককে বলেন, ভেজাল পণ্য বন্ধে শুরু থেকেই র্যাব অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা প্রায়ই অভিযান চালিয়ে থাকি। ঈদকে কেন্দ্র করে যা আরো বাড়ানো হয়েছে। তবে শুধু অভিযান করেই এসব বন্ধ করা একবারে সম্ভব নয়। কারণ একটা অভিযান চালানোর পর তার কাগজ তৈরিতেও সময় লেগে যায়। আর চাইলে মাসে কয়টি অভিযান চলানো সম্ভব হবে? মূলত জনগণ বা ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে। আমরা কিন্তু দেখেছি ভোক্তারা তরমুজ বা অনেক দামি পণ্য প্রথমে বর্জন করেছে। এখন কিন্তু কমে এসেছে। আমরা কাজ করছি। এর সঙ্গে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব জাকারিয়া ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা আসলে শাস্তির চেয়ে মোটিভেশনের মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করছি। এজন্য আমরা নানা সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। আমরা আসলে চাই না একটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাক। কারণ এর সঙ্গে রুজি-রুটি কর্মসংস্থানের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আরো বলেন, গত ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু হয় আমাদের। তবে ২০২০ সালে জনবল বরাদ্দ হলে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। সে হিসাবে আমাদের কার্যকাল ৪ বছর। আমাদের আরো জনবল বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। তা নিয়ে কাজ চলছে। ভেজাল খাদ্য বন্ধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।