(শেষ পর্ব)
বলেছিলেন প্রথমে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসবেন, অল্প পরেই আসবেন পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান এম এম আহমদ; তারপর ভুট্টো। এরপর ইয়াহিয়া খান সামরিক পদক্ষেপ নেবেন এবং তাতে পাকিস্তান শেষ হয়ে যাবে। সেসব ঘটনাই ঘটেছে এবং ওই অনুক্রমেই। নিজের সম্পর্কে মুজিব বলেছিলেন, তাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হবে; আর সেটা যদি না ঘটে তাহলে তিনি নিহত হবেন হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে, নয়তো তার নিজের লোকদের দ্বারা। আসগার খান এসব কথা লিখেছেন তার ‘জেনারেলস ইন পলিটিকস ১৯৫৮-১৯৮২’ নামের বইতে। উল্লেখ্য, মার্চে ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের সময়ে একদিন ঢাকার প্রেসিডেন্টের ভবনে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হলে একান্তে ডেকে নিয়ে ভুট্টোকে মুজিব এই বলে সতর্ক করে দেন, সেনাবাহিনী আগে তাকে (মুজিবকে) হত্যা করবে, তারপর ভুট্টোকে। ভুট্টো সেই সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করেননি; তার মাথায় তখন খেলা করছে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আরোহণের স্বপ্ন। অথচ মুজিব যা বলেছিলেন সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সেটাই। তারা মুজিবকে হত্যা করতে চেয়েছিল, পারেনি; পরে ভুট্টোকে হত্যা করতে চেয়েছে, পেরেছে। মুজিবের সতর্কবাণীর কথা ভুট্টো নিজেই বলেছেন, তার ‘দি গ্রেট ট্র্যাজেডি’ বইতে। সেটা লেখা হয়েছিল ওই একাত্তর সালেই, আগস্টের দিকে। দৃষ্টির এই প্রখরতা না থাকলে মুজিব অত বড় নেতা হলেন কী করে, সমসাময়িক ও সমবয়স্ক সবাইকে ছাড়িয়ে? সঙ্গে ছিল অতুলনীয় সাহস। জানতেন কী ঘটতে যাচ্ছে, তবু সাহস হারাননি। প্রাণসংশয় যখন দেখা দিয়েছে তখনও অবিচলিত থেকেছেন।
পাকিস্তানি নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান; ইয়াহিয়ার শাসনশুরুর প্রথম পর্যায়ে তিনি এসেছিলেন পূর্ববঙ্গের গভর্নর হয়ে। আহসানও ছিলেন মুজিবের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার ব্যবস্থাপনাতে ১৯৭০-এর নভেম্বরের শেষে ও ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঢাকায় মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার একান্ত বৈঠক হয়েছে। মুজিবের প্রতি আহসানের আকৃষ্ট হওয়ার কারণ, তিনি মনে করতেন পাকিস্তানকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আহসানের জন্য মুজিবের ওপর ভরসা করবার আরো একটি কারণ অবশ্য ছিল; সেটি হলো কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ। আহসান অঙ্গীকারবদ্ধরূপে কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী ছিলেন এবং তার সময়ে পূর্ববঙ্গ সরকার বামপন্থিদের হেনস্তা করার ব্যাপারে হেন পদ্ধতি নেই যে ব্যবহার করেনি। মুজিব না থাকলে কমিউনিস্টরা এসে যাবে, এটা ছিল তার শঙ্কা। আহসান পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিগুলোর ঘোরতর সমর্থক ছিলেন। কমিউনিস্টদের প্রতি এই বিদ্বেষ সেনাবাহিনীতে সুবিস্তৃত ছিল বৈকি।
রাজনীতিতে শেখ মুজিব দু’জনকে অগ্রপথিক ও পথনির্দেশক হিসেবে পেয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। শুরুতে এরাও জাতীয়তাবাদী নেতাই ছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। পরে তারা পৃথক হয়ে যান এবং সেটা ঘটে ওই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই। সোহরাওয়ার্দী শুরুতে যেমন শেষ পর্যন্তও তেমনি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; ভাসানী যা ছিলেন না। ভাসানী বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই। মুজিবও তাই। তবে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মুজিবের বিচ্ছেদ ঘটেনি, বিচ্ছেদ বরং ঘটেছে ভাসানীর সঙ্গে, সেই ১৯৫৭ সালে; ভাসানী যখন ন্যাপ গঠনের উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বের হয়ে যান তখন। এর কারণ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ভাসানী সমাজতন্ত্রমুখী করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন; মুজিব অতটা যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। সমাজতন্ত্র ছাড়া যে উপায় নেই, এটা তিনি জানতেন এবং মানতেনও; কিন্তু তার পক্ষে কমিউনিস্ট হওয়া, এমনকি কমিউনিস্টদের সহযাত্রী হওয়া সম্ভব ছিল না, যেটা তিনি নিজেও বলেছেন। আগে বলেছেন সমবয়সি রাজনীতিকদের, স্বাধীনতার পর বলেছেন সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিতে উদ্যত তার অনুসারীদের।
কিন্তু সাতচল্লিশের সেই মর্মান্তিক দেশভাগের পরপরই তার চিন্তা চলে গিয়েছিল পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করবার দিকে। ঘটনা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, পাকিস্তানের শাসন হচ্ছে ঔপনিবেশিক, এবং সেখান থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে বাঙালির মুক্তি নাই। ১৯৬৬’তে ছয় দফার পক্ষে যখন তিনি একের পর এক জনসভা করছিলেন, তখন তার শেষ বক্তৃতাটি তিনি দেন নারায়ণগঞ্জে। সভা শেষে ঢাকায় ফিরে গভীর রাতে বন্দি হন। সেই সভাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি পুঁজিপতিরা ধর্মের নামে পূর্ব বাংলার জনগণকে শোষণ করছে।’ এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার মতপার্থক্য ছিল, বিরোধই বলা চলে। এই বিরোধের মীমাংসা যে সম্ভব ছিল এমন নয়। আইয়ুবের সামরিক শাসন যখন রাজনৈতিক দলের জন্য কাজের ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দেয়, তখন থেকেই শেখ মুজিবের আগ্রহ ছিল আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার। সোহরাওয়ার্দী সেটা চাইছিলেন না। এক্ষেত্রেও মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর পরই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ এবং দলের পুনরুজ্জীবন- উভয় ক্ষেত্রেই মুজিব খুব দ্রুত এগিয়ে যান। সোহরাওয়ার্দী যদি আরো দীর্ঘজীবী হতেন, তাহলে মুজিব কি বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছিলেন সেটা নিতে পারতেন? আমাদের ধারণা পারতেন; কারণ তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জাতি প্রশ্নের মীমাংসা; তার পক্ষে সেটাকে বাদ দেয়া সম্ভব ছিল না। এমনকি দলের পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারেও সোহরাওয়ার্দী তাকে থামিয়ে রাখতে পারতেন বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই গভীর হোক না কেন, রাজনীতির মুজিব যে তার ওই নেতাকে ছাপিয়ে উঠবেন এটা অনিবার্য ছিল।
বাঙালিকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করাটাই তার জন্য প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর জীবিত অবস্থাতেই তিনি পথের সন্ধান করছিলেন। নিজের হাতে ইশতেহার লিখে ও ছাপিয়ে গোপনে বিলির বন্দোবস্ত করেছেন। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, আইয়ুববিরোধী যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলা যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা করবার জন্য। আগরতলাতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের দুঃসাহসিক ও বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেনাছাউনীতে যে বাঙালিরা বিদ্রোহের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের উৎসাহিতও করেছেন। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের পর লন্ডনে গেছেন, একটা উদ্দেশ্য সাহায্যের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
কিন্তু তার মূল ভরসা ছিল নির্বাচনের ওপরই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ১৯৪৬-এর নির্বাচনে তিনি কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন; দেখেছেন নির্বাচনী তৎপরতার ভেতর দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তোলাটা সম্ভব। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি সুবিধাবাদী নামসর্বস্ব ও ভুঁইফোঁড় দলগুলোর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়ে যাওয়ার পরে নির্বাচনের প্রচারণায় ছিলেন একেবারে সামনে। ১৯৬৫-এর প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আইয়ুবী নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী কাজেও তার অসামান্য সাংগঠনিক ও নেতৃত্বদানকারী দক্ষতার প্রকাশ ঘটেছে। আর ১৯৭০-এর নির্বাচনে তো কথাই নেই; ওই নির্বাচনকে তিনি স্বাধীনতার পক্ষে রেফারেন্ডাম হিসেবেই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। এককথায় জাতীয় প্রশ্নের তিনি একটি জাতীয়তাবাদী সমাধান খুঁজেছিলেন। স্বভাবতই সে সমাধান সমাজতান্ত্রিক ছিল না।
ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ তাদের নিজেদের জন্য একজন নেতা খুঁজছিল। এবং সে নেতাকে তারা পেয়ে গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে; আচার-আচরণ, কথাবার্তা ও ভাষার ব্যবহার সবদিক দিয়েই তিনি কেবল যে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি ছিলেন তা নয়, মেহনতি মানুষও তাকে প্রিয়জন মনে করতেন, তিনিও তাদের আপনজন হিসেবে দেখতেন। তার প্রিয় উক্তি ছিল, ‘দেশের মানুষকে আমি ভালোবাসি এবং দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে।’ তবে মধ্যবিত্তই তাকে পেয়ে বিশেষভাবে খুশি হয়েছে, এবং তার ওপর ভরসা করেছে। তাকে সমর্থন জানিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকদের জন্য তার ছয় দফা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি টাইম বোমা; তাদের শঙ্কা ছিল যে ওটি বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে এবং সেটির বিস্ফোরণও ঘটেছিল বৈকি- সত্তরের নির্বাচনে। ওই বিস্ফোরণের পর পাকিস্তানকে রক্ষা করতে অর্বাচীন সশস্ত্র জেনারেলরা গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।
মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার ব্যাপারে তার ছিল ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা; এবং পারতপক্ষে কাউকেই দূরে ঠেলে দিতে চাইতেন না। যেমন খন্দকার মোশতাক আহমদ। ইনি যে একজন অসন্তুষ্ট রাজনীতিক এবং অসন্তুষ্টরা যে বিপজ্জনক হয়, বিশেষ করে যদি তাদের মাথায় থাকে দুষ্টবুদ্ধি, সেটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অজানা থাকবার কথা নয়। খন্দকারকে তবু কাছে রেখেছিলেন, হয়তো ভেবেছিলেন দূরে ঠেলে দিলে ষড়যন্ত্র পাকাবে। মোশতাক আহমদরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে সরাসরি বিচ্যুতও হননি, কিন্তু তাদের ওপর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের প্রেতাত্মাটির আছর ছিল এবং তার নিজের মধ্যে ছিল ঘোরতর কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ; নিজেকে নিজেই তিনি নন-কমিউনিস্ট নয়, অ্যান্টি-কমিউনিস্ট বলেই ঘোষণা করেছিলেন। আর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর যে লোকগুলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মতো অবিশ্বাস্য রকমের ভয়াবহ কাজটি করেছে সংক্ষেপে বলতে গেলে তারা ছিল মোশতাকপন্থিই। বাঙালির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তৈরি করার প্রয়োজনে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটাই যে যথেষ্ট নয়, বঙ্গবন্ধু সেটা পদে পদে বুঝতে পারছিলেন, নতুন ধরনের একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য নতুন ধরনের মানুষ দরকার এ কথাও তিনি বারবার বলেছেন এবং তেমনি মানুষকে যে পাওয়া যাচ্ছে না এ নিয়েও তার দুঃখ ছিল, সেই দুঃখ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও করছিলেন- তার নিজের মতো করে।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরে; আরো একটি বিপ্লব যে আবশ্যক, সেটাও তিনি বুঝেছিলেন। সেই বিপ্লবের জন্য সর্বপ্রথম যা করতে হবে সেটি যে রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনা, সেটা তার উপলব্ধিতে ছিল। মনে করেছিলেন ‘বাকশাল’-এর মধ্য দিয়ে কাজটি করা যাবে। বাকশালের ফলে অর্জন কী হতো সেটা দেখার সময় তিনি পাননি, তার আগেই চলে গেছেন। তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, সে বলাটাকে সাম্রাজ্যবাদীরা, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা পছন্দ করেনি। তারা তাকে সরিয়ে দিয়ে বিশ্বস্ত লোককে বসাতে চেয়েছে। তারা সাধারণত ব্যর্থ হয় না। এক্ষেত্রেও হয়নি।
তার অকাল প্রয়াণে সোহরাওয়ার্দী শোকাভিভূত হতেন, যদি তিনি জীবিত থাকতেন; মওলানা ভাসানী শুধু শোকাভিভূত নন, অত্যন্ত বিপন্নও বোধ করেছিলেন; তিনি তখনো জীবিত। সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানী- এ দুই নেতার পারস্পরিক সম্পর্কটা মধুর ছিল না; কিন্তু তারা দু’জনই শেখ মুজিবের অসামান্যতা সম্পর্কে জানতেন, তবে ভাসানী যতটা জানতেন, সোহরাওয়ার্দী ততটা জানতেন না। জানা সম্ভব ছিল না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।