গণতন্ত্র মঞ্চের হুঁশিয়ারি : সমাবেশে বাধা দিলে পরিণতি ভালো হবে না

আগের সংবাদ

পাহাড় কাটার হিড়িক, দুই ফসলি জমির টপ সয়েল যাচ্ছে ভাটায়

পরের সংবাদ

বাজেট : ভোট-ভোটারে ভাত-ভাতা

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাজেটে এখন আর ভাতের কথা বলা হয় না। বলতে হয় না। বলার দরকার পড়ে না। আগের মতো ভাতের অভাবে নেই বাঙালি। ভাতের অধিকার এখন তাদের কব্জায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সিংহভাগই কেটেছে ভাত আর ভোটের অধিকারের সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধেও গুলির সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে ভাতের আওয়াজ। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাজেটগুলোতে ধারাবাহিক এসেছে ভাতের নিশ্চয়তার কথা। ওই ভাত নিয়ে বক্তৃতা, গল্প, কাব্য, ব্যঙ্গ, ছড়াসহ কত সাহিত্য, কত রাজনীতি! ব্যানার, পোস্টার, সেøাগান। সেই জায়গায় এখন ভাত কম খাওয়ার প্রেসক্রিপশন। কার্বোহাইড্রেটসহ ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি৬, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি গুণাগুণের ভাতের অপকারিতার আলাপও কম নয়। এটাই বাস্তবতা। ভাতের অভাব থাকলে কথা ও আলাপের ধরন নিশ্চয়ই এমন হতো না।
কম-বেশি প্রতি বছরই বাংলাদেশের অর্থনীতির আদল পাল্টাচ্ছে। আকার বড় হচ্ছে। যথানিয়মে, প্রথাগতভাবে প্রতি অর্থবছরে সরকার দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র জানায় বাজেট প্রকাশের মাধ্যমে। দেশের কোন খাতে কোথায় কত ব্যয় হবে সরকারের এই আর্থিক পরিকল্পনার চিত্র প্রতিফলন ঘটে বাজেটে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট থেকে শুরু করে এ বছর পর্যন্ত প্রতিটি বাজেটের আকার বাড়তে বাড়তে এবার দেয়া হয়েছে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট। বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে তা ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের পঞ্চম বাজেট, টানা ১৫তম এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পঞ্চম বাজেট।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে (১৯৭২ সালের ৩০ জুন) তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। শত কোটির সেই বাজেট এখন লক্ষ-কোটি। প্রায় প্রতি বছরের বাজেটকেই ঐতিহাসিক-যুগান্তকারী-সময়োপযোগী-সাহসী ইত্যাদি বিশেষণ দেয়া হয়। কিন্তু সব মত-পথের অর্থনীতিবিদদের কাছে স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দেয়া ওই বাজেটটিই বাংলাদেশের ‘ঐতিহাসিক বাজেট’ মানে উত্তীর্ণ। তখন দেশে একদিকে উদ্বাস্তু, সমাজে নৈরাজ্য, হাজার হাজার সেতুসহ অবকাঠামোর ভগ্ন দশা। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল না, তেমন রাজস্ব আদায়ও ছিল না। বৈদেশিক সাহায্যের লক্ষণও ছিল না। ওই অবস্থায় দেশ স্বাধীনের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে কিছুটা সমাজতন্ত্রের মিশেলে মিশ্র ধাঁচের অর্থনীতির বাজেট দেয়া কীভাবে সম্ভব হলো- এ প্রশ্নে তা আজও গবেষণার বিষয়। তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনটি বাজেটে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৭৮৬ কোটি টাকা, ৯৯৫ কোটি টাকা এবং ১ হাজার কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের মতো ওই বাজেটগুলোতে বেশি বেশি করে উল্লেখ ছিল ভাতের কথা। ভাতের পাশাপাশি তাগিদ ছিল বৈষম্য কমানোর, কর্মসংস্থান সৃষ্টির, বৈদেশিক প্রভুত্ব কমানোর, সর্বোপরি স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদ। গুরুত্ব ছিল রেশন ও ন্যায্যমূল্যের ওপর। বাংলাদেশের বাজেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাজেট পেশ করেছেন এম সাইফুর রহমান ও আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তারা দুজনেই ১২টি করে বাজেট পেশ করেছেন। দিনে দিনে বাজেট বড় হতে হতে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ভূমিকা সীমিত করা হয়েছে। বড় হয়েছে ব্যক্তি খাত। তা বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও। এক পর্যায়ে ঘোষণা দিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি বরণ। নিজস্বতা শেষ। ধীরে ধীরে ‘ভাত’ ইস্যু বেদরকারি হয়ে যায়। গত ১৫ বছরে ভাতের বদলে ভৌত অবকাঠামোকে গুরুত্ব দেয়ার এক প্রতিযোগিতা। রাস্তাঘাট, সেতুসহ নানা স্থাপনার সঙ্গে বিদ্যুতের ওপরও গুরুত্বারোপ। ভাত শব্দের বদলে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষির বহুবিধিকরণ, যান্ত্রিকীকরণকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ভিন্ন মাত্রায়। সেই সঙ্গে নানা নামের ভাতার ছড়াছড়ি। দেশে এখন কত যে ভাতা! ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভাতা আরো বাড়ছে। গরিব, বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি কিছুটা বাড়ানোর ঘোষণা রয়েছে বাজেটে। উপকারভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হবে। এসব ভাতা দেয়া হয় সামাজিক সুরক্ষার কার্যক্রম হিসেবে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবনায় জানানো হয়েছে, বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে যৌক্তিকভাবে সাজানো হয়েছে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম খাতে মোট বরাদ্দ ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়িয়ে ৫৮ লাখ ১ হাজার জন করার টার্গেট রয়েছে সরকারের। মাসিক ভাতার হার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হবে। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হবে। বর্তমানে এই শ্রেণির ভাতাভোগী ২৪ লাখ ৭৫ হাজার জন। আগামী অর্থবছরে তা ১ লাখ বাড়িয়ে ২৫ লাখ ৭৫ জনে নেয়া হবে। তাদের মাসিক ভাতার হার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে ডাটাবেজ করে সব প্রতিবন্ধীকে ভাতার আওতায় আনা হবে। ফলে এই শ্রেণিতে মোট ভাতাভোগী দাঁড়াবে ২৯ লাখ প্রায়। এতে গত অর্থবছরের তুলনায় ভাতাভোগী প্রতিবন্ধী বাড়বে প্রায় ৫ লাখ ৩৫ হাজার। প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তির হার বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে এই হার প্রাথমিক স্তরে ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০০ টাকা, মাধ্যমিকে ৮০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে হিজড়া জনগোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৮১৫ থেকে বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৮৮০ জনে। আরো নানা কিছিমের ভাতা কার্যক্রম রয়েছে সরকারের। বিশেষ ভাতাভোগী আছে ২ হাজার ৬০০ জনের মতো। তা বাড়িয়ে ৫ হাজার ৬২০ জন করা হয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ৫৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৫০৩ জন করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এই শ্রেণিতে বিশেষ ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪৫ হাজার ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫৪ হাজার ৩০০ জন করা হয়েছে। এ ছাড়া এই শ্রেণিতে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১ হাজার ৯০৩ থেকে বাড়িয়ে ২৬ হাজার ২৮৩ জন করা হয়েছে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ১২ লাখ ৫৪ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৩ লাখ ৪ হাজার করা হয়েছে। এছাড়া অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কার্যক্রমে উপকারভোগীর দৈনিক ভাতার হার ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করার আয়োজন রয়েছে। এসব ভাতাভোগীর ভাতের অভাব নেই। সরকারি ভাতায় তাদের অনেকেই বেশ ফুরফুরে। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এসব ভাতার ২৫টি হচ্ছে ক্যাশে। ২২টির টাকা মেলে সরকার থেকে ব্যক্তি-জিটুপি পদ্ধতিতে। মোটমাটে ৮০ শতাংশ টাকাই যাচ্ছে জিটুপিতে। সামনে শতভাগই দেয়া হবে সরাসরি। ভাতা ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির এ কার্যক্রম ভোটের রাজনীতিতে মোক্ষম ফল দেবে বলে আশা সরকার করতেই পারে। নির্বাচনী বাজেট বিবেচনায় ভাতার আওতার ঐতিহাসিক বিস্তার ঘটানোর এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। অবশ্য সেটা ভাতা নামে হবে না। হবে সম্মানের সঙ্গে পেনশনের আওতায়। বাজেটে প্রস্তাবিত কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলে ১৮-৫০ বছর বয়সি একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের বেশি বয়স পর্যন্ত একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর পর্যন্ত চাঁদা দিলে পেনশন পাবে আজীবন। আর পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছরের আগে কেউ মারা গেলে তার নমিনি বাকি সময়ের পেনশন পাবেন।
সর্বজনীন এ পেনশনের আওতায় আনা হবে প্রবাসীদেরও। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই পেনশন ব্যবস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ ঋণ হিসেবে নেয়া যাবে। নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। মাসিক পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। শিগগির একটি পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এ কর্তৃপক্ষকে কার্যকর করা হবে।
অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছর থেকেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর আভাস দিলেও তা পেছাতে পারে। কারণ ১ জুলাই থেকেই সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালুর প্রস্তুতি সরকারের এখন পর্যন্ত নেই। এ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সদস্যসহ ১৬ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ এখনো গঠন হয়নি। এছাড়া তহবিল কর্মসূচির বিধিমালা তৈরির কাজও বাকি। এরপরও ভোটের রাজনীতিতে এটি হাওয়া জাগানোর মতো চিন্তা। যথাসময় ভাবলে ভোটের বাকি আর মাস সাত-আটেক। স্বাভাবিকভাবেই ভোটচিন্তার সঙ্গে বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নির্বাচন কমিশন-ইসির জন্যও ভালো বাজেট রাখা হয়েছে। ইসির জন্য এবারের বরাদ্দ প্রস্তাব ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে তা ছিল ১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়