ভর্তিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শোকজ

আগের সংবাদ

বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব : বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী

পরের সংবাদ

অনিন্দিতা

প্রকাশিত: জুন ২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২, ২০২৩ , ১:২১ পূর্বাহ্ণ

ইদানীং ফেসবুক সেলিব্রেটি হিসেবে জারিনের পরিচিতির পাশাপাশি জনপ্রিয়তার গণ্ডিও কেবলই বাড়ছে। তার ফ্যান-ফলোয়ারের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। জারিন রহমানকে এখন অনেকে চেনে প্রাণবন্ত-চনমনে, হাসিখুশি, চমৎকার একজন তরুণী হিসেবে। ফেসবুক লাইভে এসে এই সময়ের তারুণ্যের নানা চিন্তাভাবনা, একান্ত ভালোলাগা-মন্দলাগা, আলোচিত নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে নিজের সহজ সরল, অকপট যুক্তিপূর্ণ কথাগুলো সবাইকে খুব সহজে মুগ্ধ করে, আকৃষ্ট করে। বয়স খুব বেশি না হলেও ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পার্সোনালিটি মানে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার পরিচিতি গড়ে উঠেছে। সবকিছু গুছিয়ে নতুন একটা মোটিভেশনাল ভিডিওর রেকর্ডিং করতে ক্যামেরা অন করতে যাবে তখনই মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। ও প্রান্তের অপরিচিত কণ্ঠ কিছুটা হালকা চটুলভঙ্গিতে বলে, ‘হ্যালো, কেমন আছেন?’
জারিনও বিরক্তি প্রকাশ না করে বলে, ‘জি¦, ভালো! আপনি কেমন আছেন?’
‘একটা ভিডিও পাঠিয়েছি হোয়াটসআপে, সেটা আগে দেখুন। তারপর আবার কথা হবে, কেমন।’ অপরিচিতি কণ্ঠস্বর কেমন রহস্যময় হেয়ালি করে কথাগুলো বলে।
হঠাৎ এক ধরনের চিন্তা এসে ভর করে জারিনের মনে। ও প্রান্তের মানুষটির কথাবার্তা বলার ঢংটা সুবিধার মনে হয়নি তার। বদমতলব রয়েছে লোকটির, কথাবার্তা শুনেই মনে হয়েছে। হোয়াটসআপে পাঠানো ভিডিওটা দেখতে গিয়ে ভীষণভাবে চমকে ওঠে। এ রকম কিছু একটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। একবার নয়, কয়েকবার ভিডিওটা দেখে সে। সিসি ক্যামেরায় তোলা ভিডিও ফুটেজটা তাকে মুহূর্তেই কেমন অস্বাভাবিক করে তোলে। এতদিন তার বিভিন্ন মোটিভেশনাল ভিডিও, ফেসবুক লাইভ ভিডিও দেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ আলোড়িত হয়েছে, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকে দেখেছে তার কথা আবিষ্ট হয়ে শুনেছে। এখন সামান্য ১ মিনিট কয়েক সেকেন্ডের একটা ভিডিও ফুটেজে নিজেকে দেখে তার শরীরটা কাঁপছে অল্প অল্প করে। সারা শরীরে এক ধরনের হালকা ঘাম দেখা দিয়েছে। তার মনে এক ধরনের ভয়, আতঙ্কভাব গ্রাস করেছে যেন। এ রকম অবস্থাতেই আবার কিছুক্ষণ আগের সেই অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন কল আসছে দেখেই আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। কী করবে এখন সে? কী করাই বা উচিত তার? ভেবে পায় না।
ও প্রান্তের মানুষটা তখন কিছুটা মুডি ভঙ্গিতে বলে, ‘কী ব্যাপার, ভিডিও দেখে এত ভয় পেয়ে গেছেন! আমার কল রিসিভ করতেই ভুলে গেছেন ভয়ের চোটে! আপনার মতো একজন পাবলিক ফিগার, সেলিব্রেটি পারসনের ভিন্নরূপ জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ার জন্য ওই একটি ভিডিও ক্লিপই যথেষ্ট। এই ভিডিও যদি এখন ভাইরাল হয়ে যায়, তাহলে আপনার মতো একজন বিখ্যাত, জনপ্রিয় সেলিব্রেটির ইমেজ, সম্মান, ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ধারণা করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। আপনাকে এ সম্পর্কে আর কী বোঝাব?’ একটানা কথাগুলো বলে লোকটা থামে। ‘যেখানে আপনি কাণ্ডটা করেছেন, সেই গিফটশপ ‘এক্সক্লুসিভ’ এর ম্যানেজার আমি। আমার নাম জগলুল। আমাদের সিসি ক্যামেরায় ব্যাপারটা ধরা পড়েছে, পুরো ঘটনাটা রেকর্ড হয়েছে। আমাদের সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও ক্যামেরার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি আপনি।’
‘আই অ্যাম সরি, জগলুল ভাই। আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি ক্ষমা চাইছি আমার এই ভুলের জন্য। আর কখনো এমন ভুল করব না আমি’, কাতর কণ্ঠে বলে জারিন। নিজের অপরাধটা ধরা পড়ে যাওয়ায় নিজেকে অসহায় ভাবতে থাকে। লোকটাকে যে করেই হোক থামাতে হবে। যদি সে তার কথামতো ব্যাপারটা সবাইকে জানিয়ে দেয়, সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজটা ছড়িয়ে দেয় তাহলে মহাসর্বনাশ ঘটে যাবে। কারো সামনে নিজের মুখ দেখাতে পারবে না। জারিন রহমানের পরিচিতি, খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, উজ্জ্বল তারুণ্যের আদর্শ প্রতিকৃতির ইমেজ সবই মুহূর্তেই ধুলোয় মিশে যাবে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, চেনাজানা অগণিত মানুষের কাছে তার চরিত্রের ভিন্ন কুৎসিৎ একটি রূপ ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া বাবা-মার সম্মান মর্যাদা পরিচিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। নিজের সন্তানকে নিয়ে তাদের গৌরব মুহূর্তেই ধুলোয় মিশে যাবে।
দুই.
‘আরে, ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তো আপনাকে বিপদে ফেলতে চাই না। বরং বিপদ থেকে রক্ষা করতে চাই। সেজন্যই তো ডেকে এনেছি এখানে। ডোন্ট ফিল আনইজি। ভয়ের কিছু নেই। বলেছি তো,’ গিফটশপে গেলে ম্যানেজার জগলুল হঠাৎ করে বেশ আন্তরিক হয়ে যায়। লোকটা জারিনের কাঁধে হাত রাখে। মৃদু চাপ দিতে দিতে বলে, ‘বসো, তোমাকে হেল্প করতেই তো চাই আমি। আমাকে তোমার শুভাকাক্সক্ষী মনে করতে পারো।’
লোকটির হঠাৎ এরকম গায়ে পড়া আন্তরিক হওয়া এবং তার কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলাটা অসহ্যকর মনে হলেও এটা এই মুহূর্তে চোখে মুখে প্রকাশের উপায় নেই জারিনের। এ সময় জগলুলকে কোনোভাবেই চটানো কিংবা ক্ষুব্ধ করা যাবে না। লোকটা কোনোভাবেই মাইন্ড করলে পরিস্থিতি তার জন্য বিপরীত হয়ে দাঁড়াবে- তেমন ভাবনা থেকে সে নিস্পৃহ, নির্বিকার থাকে। তারপর বলে, ‘ভাইয়া, আমি ভুল করেছি। এ জন্য ক্ষমা চাইছি। আর কখনো তেমন ভুল হবে না। প্লিজ, ভিডিওটা এখন ডিলিট করে দেন। দয়া করে আমার অনেক বড় ক্ষতি করবেন না। ফর গডস সেক, আমার সর্বনাশ করবেন না।’ কথাগুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে জারিন। নিজেকে সম্বরণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। তার কান্নার ফোঁপানি শোনা যায়। মাথা নিচু করে থাকে সে।
‘এখন আমি এ বিশ্রী পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে চাই। প্লিজ, আমাকে বাঁচান। তা না হলে আমার সব অর্জন শেষ হয়ে যাবে। তখন সবাই আমাকে খারাপভাবে চিনবে। কারো সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর উপায় থাকবে না,’ অসহায় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে আবার ফোঁপাতে থাকে জারিন।
জগলুলের কথাগুলো শুনতে শুনতে জারিনের কপালে কেমন যেন চিন্তার ভাঁজ পড়ে। চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। লোকটির মুখের কথাগুলো কেমন দুর্বোধ্য মনে হয় তার কাছে। সে আসলে তাকে কী বলতে চাইছে, হঠাৎ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ‘তাহলে আমি এখন কী করব?’ হঠাৎ জারিনের মুখ থেকে অনেকটা অবচেতনভাবে অস্ফুট স্বরে কথাগুলো বেরিয়ে আসে। জগলুল বলে, ‘আমি চাইলে চুরির দায়ে উপযুক্ত প্রমাণসহ পুলিশের কাছে তোমাকে অভিযুক্ত করে মামলা দিতে পারি। তখন সেই ঘটনার প্রমাণ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পত্রপত্রিকার রিপোর্টার, টিভি চ্যানেলের লোকজন সবাই পাবে। তারা সেটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু আমি তা করব না। যদি, তুমি আমার কথা শোনো এবং আমার কথামতো কাজ করতে রাজি হও,’ বলতে বলতে অশ্লীল ভঙ্গিতে চোখ টিপে জগলুল। তারপর জারিনের পিঠে হাত রাখে। ধীরে ধীরে সেই হাত তার সারা পিঠে বুলাতে থাকে। ঘৃণায়, লজ্জায়, অপমানে, রাগে-দুঃখে জারিনের সারা শরীর শিরশির করতে থাকে। তার চরম দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গিফট শপের ম্যানেজার জগলুল তার কাছে বিনিময়ে কী চাইছে বুঝে নেয় সে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জারিন। নিজের কিছু ভুলের কারণে বিরাট সর্বনাশের ফাঁদে আটকা পড়েছে সে উপলব্ধি করে। মাকড়সার জালে আটকে পড়া ছোট পোকাটির কথা মনে পড়ে যায়। সেই পোকাটির মতো মনে হয় নিজেকে। অসহায় সেই পোকাটিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে মাকড়সাটি এগিয়ে আসছে। নিজেকে সেই জাল থেকে মুক্ত করতে পোকাটি আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তার হাত-পা, পুরো শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেই ভয়ানক জালের ফাঁদে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ খোলা নেই তার। জারিন দ্রুত চিন্তা করে। নিজের বর্তমান অবস্থাটা বিবেচনা করে কেবলই হতাশ হয়। তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একজন দুশ্চরিত্রের লম্পট পুরুষ তার বিকৃত লালসা মেটাতে চাইছে- তেমন অভিযোগ পুলিশকে দিতে পারে সে। কিন্তু অভিযোগ জানাতে গেলে জগলুলও তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগটা প্রমাণসহ হাজির করবে তখন। জানাজানি হবে জারিনের চুরির গোপন অভ্যাসের কথাটা। আর কিছু ভাবতে পারে না সে। পৃথিবীটাকে হঠাৎ তার কাছে ভয়ংকর শ্বাপদসংকুল একটা জায়গা মনে হয়। দমবন্ধ হয়ে আসতে চায় তার। শ্বাস নিতে কেমন হাঁসফাঁস করে ওঠে সে। নিজের ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভাবতে গিয়ে তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজের একটি অপরাধের কথা আড়ালে রাখতে সুযোগসন্ধানী জগলুলের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর তার পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, দ্রুত ভাবতে থাকে জারিন। একবার সুযোগ নিয়ে লোকটা তাকে ছেড়ে দেবে তা তো নয়। একই ছুতোয় কিংবা নতুন কোনো বাহানায় বারবার সে তার বিকৃত লালসা পূরণ করতে চাইবে। এটাই সাধারণত ঘটে থাকে।

তিন.
সবার চোখে নিখুঁত, মেধাবী, চৌকষ, দারুণ উজ্জ্বল প্রাণবন্ত একটি মেয়ে হয়েও ভেতরে ভেতরে নিজের একটি ত্রæটির কথা মনে করে বেশ কুঁকড়ে যায় জারিন। এটা তার একান্ত একটি ব্যাপার হলেও তার খারাপ অভ্যাসটি কোনো একসময়ে চরম লাঞ্ছনা অপমান মর্যাদাহানির প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে ভাবতে পারেনি। এটা তার এক ধরনের মানসিক সমস্যা। বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা পড়ে, অনেকের মুখে শুনে আরো আগেই জেনেছে সে, এই মানসিক সমস্যাটির নাম ক্লেপটোম্যানিয়া। এই পৃথিবীর বহু নারী-পুরুষ এই মানসিক সমস্যাটিতে আক্রান্ত। সবার অগোচরে কারো বাসাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কিংবা দোকানপাট থেকে সুযোগ মতো ছোটখাটো সাধারণ-অসাধারণ আকর্ষণীয়, দুর্লভ কোনো কিছু সরিয়ে নিজের ব্যাগে কিংবা পকেটে অথবা শরীরের কোথাও লুকিয়ে নিয়ে আসাটাই এ মানসিক রোগের লক্ষণ। বাবা-মায়ের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে দেয়ার জন্য গিফট কিনতে সেদিন গুলশানের দুই নম্বরে অভিজাত গিফটশপ ‘এক্সক্লুসিভ’ এ গিয়েছিল জারিন। এই দোকানে আগেও কয়েকবার গেছে সে। তবে এবার বাবা-মায়ের জন্য গিফট কিনতে গিয়ে সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে অনেক দামি একটি শোপিস নিজের ব্যাগে ঢুকিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটি গিফটশপের লোকজনের চোখে না পড়লেও কিছু সময় পর ম্যানেজার জগলুল সিসি ক্যামেরার ফুটেজে জারিনের গোপন কর্মটি দেখে ফেলে, অন্য কাউকে এ ব্যাপারে না বলে নিজে নিজে তৎপর হয়। কম্পিউটারে কাস্টমারস ডিটেইলস ঘেঁটে জারিনের নাম-ধাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর বের করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জগলুলের ফাঁদে এভাবে আটকে তার জীবনটা ক্রমেই চরম দুর্বিষহ হয়ে উঠবে কোনো সময়ে ভাবতে পারেনি। এমন একজন লম্পট, বিকৃত রুচির পুরুষের লালসার বলি হতে হতে জারিন ক্রমেই ধিক্কার দেয় নিজের অসহায়ত্বকে। লোকটির অন্যায় আবদার নীরবে মুখ বুজে মেনে নিতে হচ্ছে। কাউকে এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছে না। একবার সুযোগ নেয়ার পর তার উন্মাদনা যেন আরো বেড়ে গেছে। প্রথমদিন জগলুলের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে জারিন চরম অস্বস্তিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল প্রায়। তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বুকের ভেতরে কষ্ট বেদনাগুলো কেবলই দলা পাকিয়ে উঠছিল। বিকৃত রুচির মানুষটির সামনে নিজের কাপড়-চোপড় খুলে সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে অনেক কান্না পেলেও ওভারশকড হয়ে কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল সে। নির্বাক, নিথর কাঠের পুতুলের মতো জগলুলের সামনে দাঁড়িয়েছিল সে। তার কোনো বাধা কিংবা প্রতিবাদে আচরণ না দেখে নির্বিঘেœ লোকটি তার দুই হাত ব্যবহার করছিল। জারিনের কেবলই মনে হচ্ছিল, গভীর সাগর জলের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে সে। আর সেখানে একটি অক্টোপাস যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে, ক্রমেই গ্রাস করছে। নিজেকে কোনোভাবেই মুক্ত করতে পারছে না সে সেই অবস্থা থেকে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমেই। প্রথমদিন লোকটির অন্যায় আবদার পূরণের সময় দুর্বিষহ মুহূর্তগুলো কাটানোর সময় মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন আর কোনোভাবেই তার ফাঁদে পা দেবে না। এ ব্যাপারে মনে মনে পণ করেছিল সে। কিন্তু জগলুল মোবাইল ফোনে কল দিয়ে বলে, ‘আমাদের দোকানের অনেক দামি একটি গিফট আইটেম চুরির উপযুক্ত প্রমাণসহ পুলিশের কাছে তোমার নামে কমপ্লেইন করব। পুলিশ যাবে তোমাদের বাসায়। তোমার আব্বু-আম্মু ব্যাপারটা জানবে তখন। তখন তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হবে, শুধু একটিবার ভেবে দেখো। সেটা কী উচিত হবে, তুমি বলো?’ তার কথাগুলো শুনে নিজের চরম অসহায়ত্ব এবং দুর্ভাগ্য আবার উপলব্ধি করে জারিন। বাধ্য মেয়ের মতো জগলুলের অফিসে গিয়ে উপস্থিত হয় সে। লোকটির জঘন্য রুচি বিকৃতির শিকার হতে হতে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। অনেক যন্ত্রণা আর কষ্ট অনুভব করলেও দাঁতে দাঁত চেপে সেই কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করে যায়। বান্ধবী, সহপাঠীর মুখে তেমন বিকৃতি রুচির নরপশুদের নানা কাণ্ডকীর্তির কথা শুনতে গিয়ে তার গা গুলিয়ে আসত। মানুষ এতটা জঘন্য রুচির হয় কীভাবে, শুধুই ভাবত সে। অথচ আজ সে নিজেই তেমন ঘটনার শিকার হয়েছে।

চার.
নিজের সব কথা মাকে খুলে না বলা পর্যন্ত একধরনের অস্বস্তিতে থাকে যে মেয়েটা, সেই জারিন কিছুদিন ধরে কেমন যেন চুপসে গেছে। এখন গম্ভীর মুখ নিয়ে বেশিরভাগ সময় নিজের রুমে চুপচাপ বসে থাকে। কোনো ছেলের সঙ্গে অ্যাফেয়ার কিংবা ব্রেকআপ অথবা অন্যরকম কিছু হলেও রুখসানা জানতেন সবার আগে। জারিন তার মায়ের কাছে এসব কোনোদিন লুকোয়নি। এখন তাহলে এমন কী ঘটল? যে কারণে কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে সে। জারিনের মানসিক পরিবর্তনের পাশাপাশি শারীরিক পরিবর্তনটাও তার মাকে কেমন দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ঠিকঠাক মতো খাওয়া-দাওয়া করছে না মেয়েটা। নিজের দিকে খেয়াল করছে না। একটা জামা কয়েকদিন একনাগাড়ে পরে থাকলেও সেদিকে কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই যেন। কয়েকবার মা মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন, কী হয়েছে তার? মাকে কী বলবে সে? গুলশানের গিফটশপে চুরির ঘটনায় তার জড়িয়ে পড়া, সেই চুরির ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে গিফটশপের ম্যানেজার ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার পর থেকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জঘন্য দুর্বিষহ এক জীবনে জড়িয়ে পড়ার কথাগুলো কীভাবে সে তার মাকে খুলে বলবে। আপন সন্তানের এতবড় একটি ত্রæটি এবং সেই সূত্রে ভয়ংকর সর্বনাশের ফাঁদে আটকে পড়ার কথা জানতে পারলে তাদের মানসিক অবস্থা কী হবে, তারা কীভাবে এটা মেনে নেবেন? এতে তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে অনেক। মারাত্মকভাবে শকড হয়ে ভয়ানক কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে তাদের। এতসব ভেবে জারিন নিজের একান্ত কষ্টের কথাগুলো খুলে বলতে পারছে না বাবা কিংবা মাকে। সে একাই বয়ে বেড়াচ্ছে সব দুঃসহ কষ্ট বেদনাগুলো। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আর তো পারছে না সে।
কয়েকদিন ধরে জগলুলের ডাকে সাড়া দেয়নি জারিন। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যতই ভয় দেখাক না কেন সে কোনোভাবেই আর লোকটির অন্যায় আবদার পূরণ করতে যাবে না। তার শরীর খারাপ তাই সে যেতে পারবে না, মুখের ওপর বলে দিয়েছে। জগলুলের ফোনকল রিসিভ না করে চুপচাপ থাকাটা সঠিক কাজ মনে করেছে। কিন্তু এরপর তার জন্য আরো বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছে, যা সে কল্পনাও করতে পারেনি। জগলুল হোয়াটসআপ এবং মেসেঞ্জারে নতুন আরো কিছু ভিডিও ক্লিপস পাঠিয়েছে। সেসব দেখার ব্যাপার কৌতূহল হারিয়ে ফেলেছে জারিন। নতুন আর কী পাঠাবে লোকটা তার কাছে?
মোবাইল ফোনের মেসেঞ্জারে বারবার নোটিফিকেশনের শব্দ কানে আসতেই চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। জগলুল আবার সেই ডিভিও ক্লিপস পাঠিয়েছে এবং মেসেজ লিখেছে ‘কী ব্যাপার? ভিডিওগুলো পাঠালাম। এখনো দেখো নাই! তাড়াতাড়ি দেখো…’ এবার মনের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল হঠাৎ করে তীব্র হয়ে ওঠে তার। দ্রুত ভিডিওগুলো দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জারিন। একের পর এক ভিডিওগুলো দেখে সারাটা পৃথিবী ভীষণভাবে দুলে ওঠে যেন। জগলুল তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফাঁদে ফেলে যা যা করেছে তার অনেক কিছুই জারিনের অগোচরে গোপনে মোবাইলের ক্যামেরায় ভিডিও করে রেখেছে। এর কিছু নমুনা পাঠিয়েছে সে হোয়াটসআপ এবং মেসেঞ্জারে। এগুলো এখন জারিনকে যে কোনো কাজে বাধ্য করার জন্য তার হাতে অনেক বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় কোনদিকে যাবে সে? এখন তার কী করা উচিত? সে একজন লম্পট অসৎ বিকৃত রুচির মানুষের লালসার বলি হতে চায় না আর।
জগলুলের কথামতো কাজ না করলে লোকটা ভয়ংকর সর্বনাশ করবে। তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করলেও চরম বিপদ ঘটবে। তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বারবার সর্বনাশ ঘটিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। এভাবে তো আর চলতে দেয়া যায় না। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে জগলুলের ফাঁদ থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেরিয়ে আসবে সে? কীভাবে সে নিশ্চিন্তে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবে? দ্রুত ভাবতে থাকে জারিন। তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। নিজের একটি সাধারণ ভুলের কারণে ভয়ংকর বিপদের জালে জড়িয়ে পড়েছে সে। সেই জাল ছিঁড়ে নিজেকে মুক্ত করে নিরাপদে বেরিয়ে আসার কোনো পথই যেন খোলা নেই তার সামনে। দারুণ একটা অস্বস্তি বুকের ভেতরটাতে আরো গভীরভাবে চেপে বসেছে যেন। দমবন্ধ হয়ে আসছে, বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে ক্রমেই অস্থির হয়ে ছটফট করতে থাকে জারিন।

পাঁচ.
পরদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একটি সংবাদে অনেকের দৃষ্টি আটকে যায়। এই প্রজন্মের জনপ্রিয় মুখ জারিন রহমান আত্মহত্যা করেছেন। আলোচিত ফেসবুক সেলিব্রেটি, জনপ্রিয় সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে পরিচিত মেধাবী তরুণী জারিন রহমান রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। সবার কাছে সদা প্রাণবন্ত হাসিখুশি মেধাবী তরুণী হিসেবে পরিচিত এবং জনপ্রিয় ফেসবুক সেলিব্রেটি জারিনের আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি। আদাবর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। পুলিশ তার মৃত্যুর কারণ খুঁজতে তদন্ত শুরু করেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়